ধর্মভিত্তিক দল এখন আপনাআপনিই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে- ৫ম সংশোধনী বাতিলের পর by বিকাশ দত্

সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ_ হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরম্নদ্ধে আপীল খারিজ হওয়াতে সবাই একবাক্যে বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধানে মূল চেতনায় যাবার পথকে প্রশসত্ম করেছে।
হাইকোর্টের রায় পুরোপুরি বহাল থাকলে সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরে আসবে। দেশে সামরিক শাসনের বৈধতা দেবার পথ রম্নদ্ধ হলো। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো আপনা-আপনিই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সভ্য দুনিয়ার কাতারে শামিল হলো। আপীল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ রায়ে কোন দিকনির্দেশনা দিলে সে ৰেত্রে সংসদে যাবার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে সামরিক শাসন যে সম্পূর্ণ বেআইনী অবৈধ অসাংবিধানিক তা এদেশের জনগণের মধ্যে জোরালোভাবে চর্চা ছিল না। হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে দেশের জনগণ অনেকটা সচেতন হয়েছে। এমনকি সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও সচেতন হয়েছে। যে কারণে ওয়ান ইলেভেনের সময় সেনাবাহিনী ৰমতা দখল করেনি। বাইরে থেকে সরকারকে সহায়তা করেছে। এ রায়ের ফলে এটা প্রমাণ হয়েছে সামরিক শাসন জারি করে কোনভাবেই বৈধতা পাওয়া যায় না। হাইকোর্টের রায় বহাল থাকায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যনত্ম খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনী ঘোষণা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, সামরিক শাসন সামগ্রিকভাবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক এবং সামরিক আইনের অধীনে সব কার্যক্রম, আইন ও বিধিও অবৈধ।
পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল থাকাতে, দেশ বাহাত্তরের সংবিধানে কিভাবে ফিরে যাবে? সামরিক শাসন বলে আসে না, তাদের পথ কিভাবে রম্নদ্ধ হলো, জিয়াউর রহমান সংবিধান বাতিল করেননি, সংবিধান রেখেই বেশ কিছু আইন করেছেন। তাঁর কাজগুলো আপীল বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনবিদগণ তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা মূলত বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাব। তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আপীল বিভাগ এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়নি। আপীল বিভাগের রায় দেখে চূড়ানত্ম সিদ্ধানত্ম নেয়া হবে। সংবিধানের চার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়া না যাওয়া সব কিছু নির্ভর করছে আপীল বিভাগের দিকনির্দেশনার ওপর। প্রয়োজন হলে বিষয়টি সংসদেও উপস্থাপিত হতে পারে।
ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সুন্দর জাজমেন্ট হয়েছে। সরকারকে এখন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ের পর বাহাত্তর সালের সংবিধানে দেশ ফিরে যাবে। এৰেত্রে সংসদে যাবার প্রয়োজন নেই। এটা মন্ত্রিসভায় সিদ্ধানত্ম নিতে পারে। তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন, অষ্টম সংশোধনীর মামলা হলে অর্ডার দেয়া হলো সেৰেত্রে পার্লামেন্টে যেতে হয়নি।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, যারা বলছে এই রায়ের ফলে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া যাবে। যারা বলছে, তারাও জানে আমি বুঝি।
এ ৰেত্রে আপীল বিভাগ চূড়ানত্ম রায়ে কি বলে। তারা তো এর উপর দিকনির্দেশনাও দিতে পারে। পথ বাতলিয়ে দিতে পারে। তারা (আদালত) ওখানে না গেলে জাতীয় সংসদে যেতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি এ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, এ্যাটর্নি জেনারেল সাহেব বলেছেন, রায়ের পর সংবিধান নতুন করে ছাপা হবে। কি যুক্তিতে ছাপিয়ে দেবে এটা বোধগম্য নয়। এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে জাতীয় সংসদেই যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সামরিক আইন যে অবৈধ, অসাংবিধানিক সে বিষয়ে এদেশের মানুষ ছিল অনেকটা অজ্ঞ। আইয়ুব খানের মামলায় বলা হয়েছিল দেশ ও জাতির প্রয়োজনে হতে পারে। তারপর ইয়াহিয়ার মার্শাল ল। দেশ ও জাতির কারণে, পরিস্থিতির কারণে সামরিক শাসন বৈধ হতে পারে। এখন এই রায়ের ফলে অবৈধ হয়েছে। এখন সবাই বুঝতে পারছে ভবিষ্যতে সামরিক শাসন আসার পথে বড় বাধা হবে। ভারতে রাজনৈতিক বিবর্তনের কারণে জনগণের সচেতনতা অনেক আগে হয়েছে। আমাদের দেশে এই রায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও টনক নড়েছে। ভবিষ্যতে এ রায় আরও ভাল হবে।
আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেছেন, এই মুহূর্তে চূড়ানত্মভাবে মনত্মব্য করা সমীচীন হবে না। আপীল বিভাগ আবেদন খারিজ করে দিলেও তারা বলেছে দিকনির্দেশনা দিবেন। মূলত এই রায় বহাল থাকাতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকবে না। এটা অবাসত্মব কথা। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করা হয়েছে অষ্টম সংশোধনীতে। বিসমিলস্নাহ থাকবে। তিনি বলেন, ৫ম সংশোধনীর মূল রায় বহাল থাকলে সংবিধানের চার মূলনীতি বহাল থাকবে। তবে প্রশ্ন হলো আপীল বিভাগে কোন দিকনির্দেশনা দিলে সংসদে যাবার প্রয়োজন হতে পারে। '৭২ সালের সংবিধানে সরাসরি চলে গেলাম বলা এই মুহূর্তে ঠিক হবে না। তবে এর কাছাকাছি চলে এলাম।
এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেছেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হবার ফলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রসত্ম করে ৰমতা দখল উচ্চ আদালত চিরতরে পথ বন্ধ করে দিল। মুক্তিযুদ্ধের ফলে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হয়। '৭২ সালে চার মূল চেতনা লিপিবদ্ধ ছিল। পঞ্চম সংশোধনের তা বাতিল হলো। এ রায়ের ফলে সংবিধানের মূল চেতনার পথ প্রস্তুত হলো। সামরিক শাসন দিয়ে ৰমতা গ্রহণ করা যাবে না। এটা সুপ্রীমকোর্ট মেনে নেবে না।
টিএইচ খান বলেছেন, হুবহুভাবে '৭২ সালের সংবিধানে যাওয়া যাবে না। বা সহজও হবে না। এ জন্য অবশ্য সংসদে যেতে হবে। তিনি বলেন, রায় দিয়ে সামরিক শাসন বন্ধ হবে এটা ঠিক নয়। মার্শাল ল পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। এর কোন ছক নেই। রায় দিয়ে মার্শাল ল' তাড়িয়ে দেয়া হবে এটা বেশি বলা হয়েছে।
ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, হাইকোর্টের অর্ডার শতভাগ ঠিক না। যতৰণ পর্যনত্ম আপীল বিভাগের রায় না পাব, ততৰণ এর উপর কিছু বলব না।
সাবেক স্পীকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, আমি কিছু বলব না। এমনিতেই আওয়ামী লীগ আমার ওপর ৰেপে আছে। আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় হোক, তারপর দেখা যাবে।
সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি শ. ম রেজাউল করিম বলেছেন, হাইকোর্টের রায় বহাল থাকাতে দেশ বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবে। তবে পুরোপুরি যাওয়া যাবে না। সে ৰেত্রে রায়ে পাওয়া বিভিন্ন ঘটনাকে সমন্বিত করার জন্য সংসদে কিছু কিছু বিষয়ে বিল পাস করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।
আপীল বিভাগের পরিমার্জনাটি কতদূর ও কি পর্যায়ে হবে তার উপরই সব কিছু নির্ভর করছে। সামরিক শাসন জারি করে বৈধতা পাওয়া যায় না। তার চূড়ানত্ম সিদ্ধানত্ম হলো এই রায়ের মধ্য দিয়ে। ফলে ভবিষ্যতেও অবৈধ উপায়ে ৰমতা দখলের অভিলাষকারীদের জন্য এই রায়টি গুরম্নত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে কাজ করবে।

No comments

Powered by Blogger.