রূপকথার বুনন কথা by ইব্রাহিম নোমান

সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে,সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ বিশ্বসাহিত্যের দিকপাল শিশু সহিত্যিকেরা রবীন্দ্রনাথের এই বাণী অনুসরণ করেছেন বলেই তাদের বর্ণিত বুনন কথা সর্বযুগে সমাদৃত হয়ে আসছে।
বিশ্বসাহিত্যর বিস্তীর্ন অঙ্গন জুড়ে সাজানো রয়েছে মনোমুগ্ধকর রূপকথার পসরা। প্রতিটি দেশ ও ভাষায় এ এক অর্পূব রতœভান্ডার। জাতির শৌর্য-বীর্য আশা আকাঙ্খা ও আনন্দ বেদনার স্বপ্নীল আবেশ বিস্তৃত হয় রূপকথায়। আপাত দৃষ্টিতে এর কাহিনী অলীক ও অবিশ্বাস্য মনে হলেও শিশু মনের কৌতুহল ও স্বপ্ন এতে ফুটিয়ে তোলা হয় অপূর্ব বর্ণনাশৈলীতে। জ্বীন- পরী ও সুন্দরী রাজকন্যা , দৈত্যদানব, রাক্ষস- ক্ষোকস,যাদুর চেরাগ এসবের কাহিনী সম্পূর্ণ অবাস্তব মনে হতে পারে , কিন্তু চিন্তাশীল মানুষের জীবনের স্বপ্ন আকাঙ্খা,বাধা বিপত্তি ,বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং সাফল্য- ব্যর্থতার কাহিনী রুপক হিসেবে এসেছে রূপকথার স্বপ্নীল রাজ্যে। এ রাজ্য তাই শিশুমনের সব ধরণের স্বপ্ন ও ভাবনা ব্যঙ্গময় হয়। শিশুর অবচেতন মনে যেসব ভাবনার উদ্রেক ঘটে তার এক বর্ণাঢ্য অভিব্যক্তি পাওয়া যায় রূপকথায়। তাই রাজ্যহারা রাজকুমার রাক্ষস মেরে আবার তার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে এমন কাহিনী স্বপ্নীল আবেশে উদ্বেলিত হয়। আর এখানেই রূপকথার সার্থকতা। শিশুতোষ কাহিনী হিসেবে তাই রূপকথার আবেদন আজকের এই বিজ্ঞানের যুগেও ম্লান হয়ে যায়নি। আর তাই দেখা যায় বাংলার রূপকথার গল্পের যাদুকর উপেন্দ্রকিশোর রায়ের রাজা- রাজকুমার গল্পের সঙ্গে বর্তমান সময়ের জে কে রাওলিং-এর হ্যারিপটারের কাহিনী সমান আবেদনময়। এমনকি বুড়ো খোকারা পর্যন্ত রূপকথা পড়ে এর মায়াবী রাজ্য হারিয়ে যান।
শিশুদের জগত বড়দের চেয়ে আলাদাই শুধু নয়, অনেক অনেক রঙিন আর প্রাণবন্তও। বিশ্বের ও বাংলা ভাষার অনেক শিশুসাহিত্যিক এই রংদার জগতটাকে ফুটিয়ে তুলেছেন আকর্ষণীয় করে। মজার মজার গল্প, ছড়া, রূপকথা দিয়ে তারা তৈরি করেছেন অন্যরকম এক ভুবন। কাজটা কিন্তু খুব সহজ নয়।
সাধারণভাবে যেসব লেখা শিশুদের উপযোগী করে লেখা হয় তাকেই শিশুসাহিত্য বলে। মজার মজার গল্প, ছড়া, রূপকথা ইত্যাদি শিশুসাহিত্যের কয়েকটি দিক। অনেকে মনে করে শিশুদের জন্য লেখা এমন আর কঠিন কী কাজ!
শিশুসাহিত্যের শাখাটি বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয়। বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যের কথা বললে চলে আসে উপেন্দ্রকিশোর বা সুকুমারের নাম। তেমনিভাবে বিশ্বসাহিত্যের কথা ভাবলে মনে হবে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, লুইস ক্যারলের মতো জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিকদের কথা।
যেখান থেকে শুরু“
১৬৫৮ সালের কথা। মোরাভিয়ার (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র অন্তর্গত) আমোস কোমেনস্কি নামের এক ভদ্রলোক ‘অরবিস পিকটাস’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইটি কোন গল্পের বই ছিল না। ছিল তথ্যমূলক বই, কিন্তু এর পাতায় পাতায় ছিল ছবি আর ছবি। স্রেফ ওইসব ছবির কারণেই এ বইটি শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রথম শিশুতোষ বই হিসেবে অনেকে এটাকেই বিবেচনা করেন। ধারণা করা হয়, ক্ষুদে পাঠকদের কথা ভেবেই প্রকাশ করা হয়েছিল এই বইটি।
এরপর ১৭৪৪ সালে শিশুসাহিত্যের জন্য ঘটে যায় আর একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই বছরই জন নিউবেরি নামে এক লেখক ‘এ লিটল প্রেটি পকেট বুক’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইটি কিনলে ছেলেদের একটি বল এবং মেয়েদের একটি পিনকুশন উপহার দেওয়া হতো। সব চেয়েও বড় কথা, এই বইটি ছিল শিশুদের আনন্দ দেবার জন্য প্রকাশিত প্রথম বই।
তারপর একে একে চার্লস পেরো, গ্রিম ব্রাদার্স, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসন, লুইস ক্যারলের মতো লেখকরা শিশুদের জন্য লিখতে থাকেন মজার মজার গল্প, রূপকথা, ছড়া আরও অনেক কিছু। সে সময় থেকেই সাহিত্যের এই শাখাটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেব বেড়ে উঠতে থাকে। ফুলে ফলে ভরে উঠতে থাকে। আর এখন তো এই শাখাটিই দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে।
বিশ্বসাহিত্যে উঁকি দিয়ে
পৃথিবীতে যত দেশ, যত জাতি আছে তাদের সবার মধ্যে না হলেও অধিকাংশের মধ্যেই শিশুসাহিত্যের চর্চা আছে। সব দেশেই আছেন সে দেশের জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিকরা। কিন্তু আমরা এখানে বলব সারা বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এমন কিছু রূপকথার বুনন শিল্পীর কথা।

চার্লস পেরো (১৬২৮-১৭০৩)
আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে রূপকথা পড়ি, হারিয়ে যাই কল্পনার রাজ্যে। কিন্তু অনেকেই হয়ত জানি না এই রূপকথার জনক চার্লস পেরো। ফ্রান্সে ১৬২৮ সালের জানুয়ারিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত রূপকথাগুলো এখনও সারা বিশ্বেই সুপরিচিত। তার বিখ্যাত রূপকথার মধ্যে ‘সিøপিং বিউটি’, ‘সিন্ডারেলা’। এছাড়া ‘লিটল রেড রাইডিং হুড’, ‘পুস ইন বুটস, ব্লুবেয়ার্ড’ ইত্যাদিও তার উল্লেখযোগ্য রচনা। তার এসব রূপকথার অনেকগুলোই এনিমেটেড মুভি নির্মাণ করেছে ওয়াল্ট ডিজনি।

গ্রিম ভাইদের কথা
১৮১২ সালের ২০ ডিসেম্বর। জার্মানিতে প্রকাশিত হলো একটি বই। নাম- উরব করহফবৎ ঁহফ ঐধঁংসব্ধৎপযবহ, নামটা ইংরেজীতে এ রকম- চিলড্রেন’স এ্যান্ড হাউজহোল্ড টেইলস। হ্যাঁ, সেটা ছিল একটা রূপকথার বই। আর তাতে ছিল জার্মানি আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা মোট ৮৬টি রূপকথা।
অংপযবহঢ়ঁঃঃবষ, উবৎ ঋৎড়ংপযশস্খহরম, ঐব্ধহংবষ ঁহফ এৎবঃবষ, জঁসঢ়বষংঃরষুপযবহ, ঝপযহববরিঃঃপযবহ কি, তাও চিনতে পারছেন না? আচ্ছা, খটমটে জার্মান নাম বাদ দিয়ে, গল্পগুলোর বাংলা নাম বলছি; সিন্ডারেলা, ব্যাং রাজকুমার, হ্যানসেল এ্যান্ড গ্রেটেল, রাপুনজেল, স্নো হোয়াইট;
প্রত্যেকটা জাতির রূপকথার গল্পগুলো যেমন সেই জাতির নিজস্বতার প্রতীক, তেমনি নিজস্ব ঐতিহ্যও বহন করে। তাই, প্রত্যেকটা জাতির জন্যই তাদের রূপকথার গল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিম ব্রাদার্স বা গ্রিম ভাইয়েরা ছিলেন জার্মান অধিবাসী। জ্যাকব লুডউইগ কার্ল গ্রিম এবং উইহেম কার্ল গ্রিম ছিলেন দুই ভাই। তাদের দু’জনকে একত্রে বলা হয় গ্রিম ব্রাদার্স বা গ্রিম ভাইয়েরা। গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয় জার্মানির রূপকথার গল্পগুলো সংগ্রহ করছেন, তখন এই কথাগুলো মানুষ মাত্র বুঝতে শুরু করেছে। আর এ বিষয়ে পড়াশোনা তো ওভাবে শুরুই হয়নি। পুরনো দিনের শিল্প-সাহিত্য, মানে গল্প, ছড়া, নাচ, গান, ছবি, ধাঁধা-এসব নিয়ে যে বিষয়ে পড়াশোনা করা হয়, সেটাকে বলা হয় ফোকলোর। এই ফোকলোরের অনেক কিছুই ঠিক করে দিয়ে গেছেন এই দুই ভাই। এমনকি, কীভাবে রূপকথার গল্প সংগ্রহ করতে হয়, তারও অনেক কিছুই তারা ঠিক করে দিয়ে গেছেন।
আর গ্রিম ভাইরা যে শুধু ফোকলোর বিষয় নিয়েই কাজ করেছেন তাই না, তারা ফিলোলোজি আর জার্মান স্টাডি বিষয় দুটিকেও প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন। জার্মান স্টাডি তো বুঝলাম, কিন্তু ফিলোলোজিটা আবার কী? ওই যে, রূপকথার একটা বৈশিষ্ট্য বললাম না, সেখানে মনের অজান্তেই মানুষ নিজেদের জীবনের অনেক কিছু ঢুকিয়ে দিত। সাহিত্যের এসব বিষয় নিয়েই কাজ-কারবার হয় ফিলোলোজিতে। বিশ্বে জুড়েই তাদের সংগৃহীত এসব রূপকথা এখনও জনপ্রিয়।

হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন (১৮০৫-১৮৭৫)
মনে আছে, সেই কুৎসিত হাঁসের ছানার গল্পটা? কিংবা থাম্বেলিনা গল্পটা? স্নো হোয়াইট অথবা ছোট্ট মৎস্যকুমারীর গল্প? ডেনমার্কের হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসন তার রূপকথাগুলোর জন্যই অমর হয়ে আছেন। তার বিখ্যাত কিছু কবিতাও আছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটার নাম জেগ এর এন স্ক্যান্ডিনেভ, ইংরেজি করলে হয়Ñ আই এম এ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান।
হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসনের জন্ম হয় ১৮০৫ সালের ২ এপ্রিল, মঙ্গলবার; ডেনমার্কের ওডেন্স শহরে। তার বাবা ছিলেন জুতোর কারিগর, আর মা ধোয়ামোছার কাজ করতেন। এ্যান্ডারসন ছিলেন বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ছোট্ট থাকতেই ওদের পড়াশোনা করা বাদ দিয়ে চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়। শিক্ষানবিস হিসেবে প্রথমে কাজ করলেন এক কাপড়ের কারিগরের কাছে, এরপর এক নাবিকের কাছে। এর মধ্যেই কিন্তু এ্যান্ডারসনের একটা কবিতা বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে। ইংরেজিতে কবিতাটির নাম- দ্য ডাইং চাইল্ড। কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ১৮২৭ সালে। আর তখনকার কোপেনহেগেনের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকাতেও নিয়মিতই তার কবিতা ছাপা হচ্ছিল।
১৮২৯ সালে অভিনীত হয় তার প্রথম নাটকও। বেশ জনপ্রিয়ও হয় নাটকটি। ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই। এ্যান্ডারসন বিখ্যাত মূলত দু’টি কারণে, তার রূপকথার জন্য তো তিনি বিখ্যাতই, আরেকটি তার ভ্রমণ ডায়েরির জন্য (ট্রাভেলগ)। আর তার প্রথম ভ্রমণ ডায়েরিও প্রকাশিত হয় ওই বছরই। জার্মানি ঘুরে এসে তিনি তার সেই ভ্রমণকাহিনী প্রকাশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার ভ্রমণবিষয়ক বইগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি ১৮৩৩ সালে ভ্রমণের জন্য রাজার আর্থিক সহায়তাও পান। আর তা দিয়ে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ট্যুর দেন, জার্মানি-ফ্রান্স-ইতালি ট্যুর। ১৮৪৫ সালে তার লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে প্রকাশ করা শুরু হয়। জার্মান ভাষায় প্রথম তার লেখার অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ সালে। আর ফরাসী ভাষায় ১৮৪৮ সালে তার প্রথম যে লেখাটি অনুবাদ হয়, সেটি ছিল রূপকথা। তার লেখা এসব রূপকথা বিশ্বের ১০০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তার নিজের মূর্তি আছে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক আর ক্যালিফোর্নিয়ায়; আছে সেøাভাকিয়ার ব্রাতিস্তাভা শহরেও। জাপানে তার নামে একটা থিম পার্কই আছে। আর পোল্যান্ডে তার নামে আছে একটা আস্ত থিয়েটার, যেখানে অভিনয়ের পাশাপাশি পাপেট শো-ও হয়। ওদিকে ২০০৬ সালে চীনের সাংহাই শহরে রীতিমতো এলাহীকাণ্ড হয়ে গেছে। সেখানে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটা থিম পার্ক বানানো হয়েছে। আর এই পার্কটি শুধু তার নামেই করা হয়নি, পার্কটির সবগুলো রাইড তার জীবন আর রূপকথার গল্প নিয়ে বানানো হয়েছে।

লুইস ক্যারল (১৮৩২-১৮৯৮)
পৃথিবীর সব মানুষকে দুইভাগে ভাগ করা সম্ভব। একদল যারা ‘এ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ পড়েছে। আরেকদল আছে যারা এই চমৎকার গল্পটি এখনও পড়েনি। এই অপূর্ব গল্পটি লিখেছেন লুইস ক্যারল নামের এক লেখক। ১৮৩২ সালে তিনি ইংল্যান্ডের চেশায়ারে জন্মেছিলেন। তিনি লুইস ক্যারল নামে সুপরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল চার্লস লুটউইজ ডডসন। তবে মজার ব্যাপার, তিনি একাধারে গণিতবিদ, ফটোগ্রাফার, যুক্তিবিদও ছিলেন। কিন্তু শিশু-কিশোরদের কাছে তিনি আজব দেশে এ্যালিসের এ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর স্রষ্টা হিসেবেই আরও অনেক দিন বেঁচে থাকবেন।
লুইস যখন বেঁচে ছিলেন তখন ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা তার কাছে চিঠি লিখত। লুইস খুব যতœসহকারে এসব চিঠির জবাব দিতেন। চিঠির সঙ্গে এ্যালিসের আঁকা ছবিও থাকত অনেক সময়। এসব চিঠি আর আঁকা নিয়ে ১৯৭৯ দুই খণ্ডের বই প্রকাশিত হয়েছিল।

এনিড ব্লাইটন (১৮৯৭-১৯৬৮)
বিশ্বের সব সেরা লেখককে যদি জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বিচার করা হয়, তাহলে লেখিকা এনিড ব্লাইটন হবেন ষষ্ঠতম। তিনি বিশ শতকের সেরা শিশু-সাহিত্যিকদের অন্যতম। তার পুরো নাম ইনিড মেরি ব্লাইটন। ১৮৯৭ সালে তিনি ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বেকেনহাম লন্ডনের একটি শহরতলির নাম। এই শহরতলিতেই বেড়ে ওঠেন জনপ্রিয় এই লেখিকা। তিনি ‘ফেমাস ফাইভ’, ‘সিক্রেট সেভেন’, এবং ‘এ্যাডভেঞ্চার নামের তিনটি জনপ্রিয় সিরিজ লিখেছিলেন শিশু-কিশোরদের জন্য। তার রচিত এসব সিরিজ আজও বিশ্বব্যাপী শিশু-কিশোরদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। তার লিখিত এসব সিরিজগুলো বিশ্বের প্রায় ৯০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এসব সিরিজগুলোর মধ্যে তার সৃষ্ট নডি চরিত্রটি শিশু-কিশোরদের কাছে সুপরিচিত।

সি এস লুইস (১৮৯৯-১৯৬৩)
নার্নিয়ার কথা আর নতুন করে কী বলব! শুধু নার্নিয়া সিরিজের বইই নয়, এই বই নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রও দেখেছো অনেকেই। এই জনপ্রিয় নার্নিয়া সিরিজটির লেখক হচ্ছেন সি এস লুইস। তার পুরো নাম ছিল ক্লিভ স্ট্যাপলস লুইস। তিনি আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে ২৯ নভেম্বর। নার্নিয়া সিরিজ ছাড়াও তিনি আরও অনেক কিছুই লিখেছিলেন। কিন্তু তার নার্নিয়া সিরিজের কাছে সেগুলো সুবিধা করতে পারেনি। তিনি নার্নিয়া সিরিজের ৯০টি উপন্যাস লিখেছেন। এসব বই বিশ্বের প্রায় ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এদিকে ২০০৫ সালে ডিজনি এই সিরিজের একটি বই অবলম্বনে নির্মাণ করেছে ‘দি লায়ন, দি উইচ এ্যান্ড দি ওয়ারড্রোব’ নামের চলচ্চিত্র।

রোয়াল্ড ডাল (১৯১৬-১৯৯০)
রোয়াল্ড ছিলেন একজন ব্রিটিশ লেখক। এই লেখক অনেকগুলো উপন্যাস, ছোটগল্প এবং চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। কিন্তু এসব অগণিত কাজের ভিড়ে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত শিশু-সাহিত্যিক হিসেবে। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি মোট ১৯টি বই লিখেছেন। তার লিখিত এসব বইয়ের মধ্যে ‘ফ্যানটাসটিক মি. ফক্স’, ‘ড্যানি দি চাম্পিয়ন অব দি ওয়ার্ল্ড’ ‘দি বিএফজি’, ‘মাটিলডা’, ‘চার্লি এ্যান্ড দি চকোলেট ফ্যাক্টরি’ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
রোয়াল্ড ডাল ১৯১৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ওয়েলস শহরে জন্মেছিলেন। এখন ইংল্যান্ডে ডালের জন্মদিনকে ‘রোয়াল্ড ডাল ডে’ বা রোয়াল্ড ডাল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন তিনি সে দেশে কতটা জনপ্রিয়। শুধু ইংল্যান্ডেই নয় তার অপূর্ব লেখার জন্য তিনি এখন সারা বিশ্বের শিশু-কিশোরদের কাছে অতি জনপ্রিয় একটি নাম।

জে কে রাউলিং
রাউলিংয়ের নাম এলেই চলে আসে হ্যারি পটারের নাম। ১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ডের ইয়েট শহরে জন্মেছিলেন লেখিকা রাউলিং। তার পুরো নাম জোয়ান রাউলিং হলেও তিনি জে কে রাউলিং নামেই সুপরিচিত। ১৯৯৭ সালে তার প্রথম বই ‘হ্যারি পটার এ্যান্ড দি ফিলোসফারস স্টোন’ প্রকাশিত হয়। তারপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
অল্পদিনের মধ্যেই এই বইটি শিশু-কিশোরদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। এরপর একে একে বের হতে থাকে এই সিরিজের অন্য বইগুলো। আর হলিউডের কল্যাণে হ্যারি পটার নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র এই জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। দিন দিনই বাড়তে থাকে এই সিরিজের ভক্তদের সংখ্যা। ২০০৭ সালে বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফর্বস বিশ্বের ক্ষমতাবান সেলিব্রেটিদের একটি তালিকা তৈরি করে তাতে জে কে রাউলিং ছিলেন ৪৮তম। টাইম ম্যাগাজিন ২০০৭ সালের পার্সন অব দি ইয়ারে তাকে রানার-আপ ঘোষণা করে। এখানেই শেষ নয়। ইংল্যান্ডের এডিনবার্গ শহরের পক্ষ থেকে সম্প্রতি তাকে দেয়া হয়েছে আরেকটি সম্মাননা। যা কিনা এডিনবার্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। আর সেটাও তাকে দেয়া হয় সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য।

বাংলা ভাষার কয়েকজন
বাংলা শিশুসাহিত্য বিশ্ব শিশুসাহিত্যের কাছেও অনেকভাবেই ঋণী। বিদেশী শিশুসাহিত্য থেকে আমাদের শিশু-সাহিত্যিকরা নানাভাবে সাহায্য নিয়েছেন। এতে আমরা আরও সমৃদ্ধ হয়েছি।

উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫)
রাজার ঘরে যে ধন আছে
টুনির ঘরেও সে ধন আছে!
বড় মজা বড় মজা
রাজা খেলেন ব্যাঙ ভাজা!

এক টুনিতে টুনটুনাল
সাত রানির নাক কাটাল!
নাক-কাটা রাজা রে
দেখ তো কেমন সাজা রে!

টুনটুনির গল্প পড়েনি, এমন বেরসিকও আছে বুঝি? এ তো সেই ‘টুনটুনি আর রাজার কথা’ গল্পের টুনটুনির ছড়া, যে রাজার ভাণ্ডার থেকে একটা টাকা নিয়েছিল। আর সেই টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে রাজা যে কী জব্দটাই না হয়েছিল!
উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর জন্ম ১৮৬৩ সালের ১১ মে, ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার মসুয়া গ্রামে। তার আসল নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। কিন্তু পাঁচ বছর বয়েসে তার বাবার এক আত্মীয় হরি কিশোর রায় তাকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। তারপর থেকেই তার নাম হয় উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। উপেন্দ্রকিশোর কিন্তু লেখালেখির শুরুতে শিশুদের জন্য লিখতেন না। লিখেছিলেন অনেক কিছুই, কিন্তু ঠিক যেন নিজের মনের মতো লিখতে পারছিলেন না। জীবজন্তু কীটপতঙ্গ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, ইংরেজী থেকে অনুবাদ করেছেন, এমনকি ‘সখা’ নামের পত্রিকায় একটা উপন্যাসও লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেননি।
এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করেন উপেন্দ্রকিশোর, লিখতে শুরু করেন ছোটদের জন্য। তখন যত শিশু-কিশোর পত্রিকা বের হতো, সবগুলোতেই লিখেছিলেন তিনি; লিখেছিলেন সখা, মুকুল, সন্দেশে। লিখেছেন গল্প, নাটক, রূপকথা, উপকথা, বিজ্ঞান-প্রবন্ধ, ছড়া। শুধু যে লিখেছিলেন, তাই নয়, আঁকতেনও। আগেই তো বলেছি, স্কুলে থাকতেই তিনি আঁকিয়ে হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। তার অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ তো বটেই, ভেতরের ছবিগুলোও তিনি নিজেই এঁকেছিলেন।
তার বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ছেলেদের রামায়ণ আর টুনটুনির বই। এই বই দুটিই বলতে গেলে জীবদ্দশাতেই তাকে ভীষণ জনপ্রিয় করে তোলে। শিশুদের জন্য উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর লেখা বইগুলো হলো- ছেলেদের রামায়ণ (১৮৯৬), সেকালের কথা (১৯০৩), ছেলেদের মহাভারত (১৯০৮), মহাভারতের গল্প (১৯০৯), টুনটুনির বই (১৯১০), ছোট্ট রামায়ণ (১৯১১), আরও গল্প (১৯১৭), পুরাণের গল্প (১৯১৯)। শেষ বই দু’টি প্রকাশিত হয়েছে তার মৃত্যুর পরে। তিনি ছিলেন ছোটদের বিখ্যাত ম্যাগাজিন সন্দেশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সারাজীবন শুধু ছোটদের জন্যই লিখেছেন তিনি। তার জনপ্রিয় সেসব লেখার মধ্যে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ‘জোলা আর সাত ভূত’, ‘টুনটুনির বই’ উল্লেখযোগ্য। তার নাতি সত্যজিৎ রায় ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ নিয়ে মজার একটা ছবি তৈরি করেছেন। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় মারা গেলেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, মারা গেলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের অবিস্মরণীয় লেখক।

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৮৭৭-১৯৫৭)
ঠাকুর মার ঝুলি, ঠাকুরদার ঝুলির মতো মজার বইগুলো ছোটবেলায় যে পড়েনি সে যে কী মিস করেছে সেটা যে পড়েছে সে-ই পারবে বলতে। এসব রূপকথাগুলো অনেকদিন ধরেই মানুষের মুখে মুখে চলে আসছিল। সেসব মজার গল্পগুলো সংগ্রহ করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মুজমদার। তিনিই বাংলা ভাষায় এমন সমৃদ্ধ রূপকথাগুলো আমাদের শুনিয়েছিলেন সহজ ভাষায়। তার রূপকথাগুলো আজও সবার কাছে সমান জনপ্রিয়।

সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)
উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে এবং সত্যজিৎ রায়ের বাবা হচ্ছেন সুকুমার রায়। তবে তাকে এই পরিচয় না দিলেও তিনি স্বনামেই বিখ্যাত। তিনি ১৮৮৭ সালে কলকাতার বিখ্যাত রায় চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে তিনি একাই শিশুসাহিত্যের জন্য যা করে গেছেন তা আজও কেউ করতে পারেনি। তিনি শিশুদের কল্পরাজ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগত সৃষ্টি করেছেন।
সেই আমলে দুটো বিষয়ে বিএসসি ডিগ্রী ছিল সুকুমারের। ফটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার জন্য বিলেতেও গিয়েছিলেন তিনি। অথচ মজার ব্যাপার হলো, তার গড়ে তোলা সংগঠনের নাম ছিল ‘ননসেন্স ক্লাব’। আর এই ক্লাবের মুখপত্র ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। তাঁর লেখা বইগুলোর নামÑ আবোল-তাবোল, হ-য-ব-র-ল, পাগলা দাশু, বহুরূপী, খাইখাই, অবাক জলপান, শব্দকল্পদ্রুম, ঝালাপালা। আবোল-তাবোলে অবশ্য বলেছেন-‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার’। আজগুবি কী? হরিণের শিংটাকে সিংহের মতো বানিয়ে ‘সিংহরিণ’ বলা। কী উদ্ভট! নিম গাছে শিম! অসম্ভব কী, রামগরুড়ের ছানা!
মাত্র আট বছর বয়সে লেখার হাতেখড়ি। প্রথম লিখেছিলেন ‘নদী’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা। ছাপা হয়েছিল শিবরাম শাস্ত্রী সম্পাদিত শিশু পত্রিকায়। তারপর তাঁর সৃষ্টি সাহিত্য নানা দিকে ডালপালা ছড়িয়েছে। তাঁর লেখা গল্প মানেই এক বসায় পড়ে শেষ করা চাই-ই চাই। তা না হলে যে নিজেকেই ঠকানো হয়। আর তাঁর হাতে আঁকা ছবি? পৃথিবীর নামকরা অনেক শিল্পীর ছবি থেকেও সেরা। ‘সন্দেশ’-এ ছাপা হয়েছিল এমন সব ছবি। সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকা। পরে সুকুমারও সম্পাদক হয়েছিলেন সেই সন্দেশের।
সত্যিকার অর্থেই বাংলা ভাষার রূপকথার রূপকার যদি বলা হয় উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীকে; সুকুমার রায় যেন সেই রূপকথারই প্রতিষ্ঠাতা।
সত্যি বলতে কী, শিশুসাহিত্য রচনা করা অত সোজা নয়। কারণ শিশুদের রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ। এই জগৎ বড়দের চেয়ে আলাদাই শুধু নয়, অনেক অনেক রঙিন আর প্রাণবন্ত। শিশুদের জগতকে স্পর্শ করার জন্য সবচেয়ে আগে যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে একটি শিশুসুলভ সুন্দর মন। তাই দেখা যায়, পৃথিবীতে হাজার হাজার লেখক থাকলেও তার মধ্যে অমর শিশুসাহিত্যিক হাতেগোনা কয়েকজন। শিশুদের কল্পনার রসে সিক্ত করতে রূপকথার জুড়ি নেই । রূপকথা শিশুদের ভাবতে শেখায়,স্বপ্ন দেখতে শেখায়। যে জাতির কোন স্বপ্ন নেই সে জাতি কখনো উন্নতির শিখরে আরোহনের চিন্তা করতে পারে না। রূপকথা শিশু মনে স্বপ্নের ডানা মেলে উড়তে হাতছানি দেয়। বিশ্বনন্দিত শিশুসাহিত্যিকেরা একারণে রূপকথার জাল বুনে শিশুদের নিয়ে গেছে এক স্বপ্নরাজ্যে। ভাবতে শিখিয়েছেন জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আর উজ্জ্বল ভবিষ্যত বির্নিমানের অভিযাত্রায় শামিল হতে। তাই রূপকথার সঙ্গে সঙ্গে এর বুনন শিল্পীরাও আজীবন বেঁেচ থাকবেন পাঠকের মনের মনিকোঠায়।
mdibrahimnoman@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.