শেকড়ের ডাক-সরকারের চার বছর ও রাজনীতির মেরুকরণ by ফরহাদ মাহমুদ

মহাজোট সরকারের চার বছর কেটে গেছে, এখন পঞ্চম বা শেষ বছর চলছে। ইতিমধ্যে এ সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব মেলানো শুরু হয়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোর টক শোতেও প্রচুর আলোচনা হচ্ছে।
এই লেখালেখি ও আলোচনাগুলো মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগে আছে কেবল সরকারের গুণকীর্তনকারী অংশ। তাঁরা বরাবরই সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন। প্রায় কোনো ব্যর্থতাই দেখেন না। আর আরেকটি অংশে আছেন সরকারের বিপরীত মেরুর লোকজন। তাঁরা সরকারের ভালো কিছুই দেখতে পান না। সরকারের পিণ্ডি চটকানোতেই তাঁদের সুখ বেশি। তৃতীয় সারিতে আছেন সেই সব মানুষ, যাঁরা মোটামুটি একটা নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বিষয়গুলো আলোচনা করতে চান। সম্ভবত এই তৃতীয় ধারাটিই আমাদের কাম্য। সুখের বিষয়, দেশে এই তৃতীয় ধারার আলোচক যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশে তৃতীয় ধারার মানুষও বাড়ছে। এখানে কিছুটা হতাশার বিষয়ও আছে। আর তা হলো, তৃতীয় ধারার বেশির ভাগ আলোচনায় গভীরতা যেমন কম থাকে, তেমনি তুল্য-মূল্য বিচার বা তথ্য-উপাত্তনির্ভর আলোচনা কমই থাকে। বলাই বাহুল্য, তৃতীয় ধারাও কোনো একক ধারা নয়। এখানেও মত ও পথের অনেক ভিন্নতা আছে। সেসব মত ও পথের প্রভাবে আলোচনায় নানা রকম বাঁক নেওয়ার ঘটনা যেমন থাকে, তেমনি সেই বাঁকে ফেলে ঘটনাপ্রবাহকে বিশেষ উদ্দেশ্যে তাড়িত করার প্রচেষ্টাও থাকে। এর পরও বলা যায়, প্রথম দুটি ধারার চেয়ে তৃতীয় ধারার আলোচনাগুলোই আমাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।
বর্তমান সরকারের পরিচিতি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। যদিও কার্যত তা আওয়ামী লীগেরই সরকার। বর্তমান সরকারের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই যেটি উল্লেখ করা যায়, সেটি হলো সমুদ্রসীমার বিরোধ নিরসনে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া, সফল কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা এবং বঙ্গোপসাগরে বিশেষ সার্ভে পরিচালনাসহ মামলার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া। ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে এবং বঙ্গোপসাগরের একটি বিশাল এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একইভাবে আশা করা হচ্ছে, আগামী বছর ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাবে। সেখানেও বাংলাদেশ একটি বড় এলাকায় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বঙ্গোপসাগরের বিপুল সম্পদ কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। যতটা প্রয়োজন ছিল, সেই তুলনায় অনেক কম হলেও দেশে অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অটুট রয়েছে এবং রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রায় ভেঙে পড়া বিদ্যুৎব্যবস্থাকে মোটামুটি একটা পর্যায়ে আনতে পারা অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। যদিও দীর্ঘমেয়াদে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল-ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপও সৃষ্টি করেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেঙ্কে আধুনিক সরঞ্জামে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করা হয়েছে এবং এর অনেক সুফল ইতিমধ্যে দেশ পেয়েছে। কৃষি গবেষণা জোরদার করা হয়েছে। ফলে আমাদের বিজ্ঞানীরা পাটের জেনম আবিষ্কারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিপদ এর নদীগুলো ক্রমাগত মরে যাওয়া। সেই ব্রিটিশ শাসনামলের পর থেকে নদী খননের কোনো উদ্যোগই নেই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার চারটি ড্রেজার এনেছিল। এরপর আর কোনো ড্রেজার আসেনি। বর্তমান সরকার দেড় ডজন ড্রেজার আনার উদ্যোগ নিয়েছে। চাহিদার তুলনায় খুব সামান্য হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করতে এ সরকারই উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশবান্ধব এবং সুলভ হওয়ায় সারা দুনিয়ায় রেল যোগাযোগ নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু আমাদের রেল যোগাযোগ ক্রমেই দুর্বল হচ্ছিল। মেয়াদোত্তীর্ণ ও প্রায় অচল ইঞ্জিন দিয়ে চলছিল রেলওয়ে। বর্তমান সরকার সেদিকে কিছুটা হলেও নজর দিয়েছে। দুই ডজনের বেশি নতুন ইঞ্জিন আনা, ওয়াগন আনা, রেলপথের সংস্কার, বন্ধ হয়ে যাওয়া রেলপথ পুনরায় চালু করাসহ নানা রকম উদ্যোগ নেওয়ায় রেলওয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কিছু রাষ্ট্রীয় কল-কারখানা নতুন করে চালু করা হয়েছে এবং তার কিছু কিছু লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ যেসব শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজন হয়, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীন অস্তিত্ব কিছুটা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও আগের চেয়ে স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়েছে। তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ আরো কিছু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে যেগুলো দেশে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। দেশে জঙ্গিবাদের যে রকম বিস্তার ঘটেছিল, তা ভাবলে এখনো শিউরে উঠতে হয়। একসঙ্গে সারা দেশে পাঁচ শতাধিক স্থানে বোমা হামলা, আদালতসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এবং সিনেমা হলসহ জনসমাগমের স্থানে বোমা হামলায় শত শত মানুষের মৃত্যু, মানুষ মেরে উল্টো করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা- কত কী-ই না আমাদের দেখতে হয়েছে। সেসব থেকে দেশ আজ অনেকটাই মুক্ত। কিন্তু বিপরীতভাবে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে।
অন্যদিকে সরকারের গুরুতর সব ব্যর্থতাও রয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই শেয়ারবাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এই বিপর্যয়ের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়িয়েছিল, যারা কয়েক লাখ ছোট পুঁজির শেয়ার ব্যবসায়ীকে পথে বসিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এমনকি এ ব্যাপারে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির মতামতকেও উপেক্ষা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট আরেকটি বড় ঘটনা। এ জন্য ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে নির্বিচারে দলীয় লোকজন বসানোকে অনেকে দায়ী করে থাকেন। আগের সরকারগুলোর মতোই এ সরকারও ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার নামে লক্ষাধিক মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং আটক ব্যক্তিদের মুক্ত করে দেয়। অথচ প্রত্যাহারকৃত মামলার মধ্যে খুন, ধর্ষণসহ অনেক মারাত্মক অপরাধের মামলাও ছিল এবং অনেক চিহ্নিত অপরাধীও মুক্তি পেয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশঙ্কাজনক অবনতির জন্য এই মামলা প্রত্যাহার অনেকাংশে দায়ী। পদ্মা সেতুতে সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ দেশে ও বিদেশে বহুল আলোচিত একটি ঘটনা, যা দেশের ভাবমূর্তির জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত অবস্থান এবং পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী স্থানীয় সরকার কাঠামো একটি অপরিহার্য শর্ত। এই সরকার উপজেলা পরিষদের নির্বাচন করলেও সংসদ সদস্যদের প্রবল বিরোধিতার কারণে সেই পরিষদ কখনো গতিশীল হতে পারেনি। স্থানীয় প্রশাসনে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ, দলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের রুচিহীন কথাবার্তাও দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছে।
স্বাধীনতার চার দশক পরে হলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ এ সরকারের একটি বড় সাফল্য। কিন্তু এখানে সরকারের ব্যর্থতাও কম নয়। ব্যাপক জনমানুষের এই দাবি বাস্তবায়নে সরকার শুরুতে যথেষ্ট সময়ক্ষেপণ করেছে। তদন্ত ও অন্যান্য কাজে দক্ষতাসম্পন্ন লোকজন নিয়োগ না করার অভিযোগ রয়েছে। আদালত, বিচারক ও সাক্ষীদের জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণেও ঘাটতির অভিযোগ রয়েছে। একাত্তরের চিহ্নিত কিছু অপরাধী পরবর্তীকালে ঘাপটি মেরে আওয়ামী লীগে ঢুকে রয়েছে, তাদের কারো ব্যাপারে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তদন্ত না হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যেকোনো ছুতানাতায় প্রতিপক্ষকে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর প্রচেষ্টা কিংবা এ-জাতীয় কথা বলে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা বিচারের প্রতি মানুষের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন এবং বিচারের গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য নষ্ট করছেন। বলাই বাহুল্য, কয়েক দিন আগে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের একইভাবে অভিযুক্ত করেছিলেন। এর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটেও আমরা অনুরূপ অপচেষ্টা লক্ষ করেছিলাম। আমরা মনে করি, এ ধরনের উক্তি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত। এর পরও যেটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটুকুর জন্য এই সরকার জনগণের প্রশংসা প্রাপ্য।
সব শেষে বলতে বাধ্য হচ্ছি, কোনো মূল্যায়নই সম্পূর্ণ নির্মোহ নয়। এই মূল্যায়নও নয়। পাঁচ-দশ শতাংশ যোগ-বিয়োগ করে হলেও এগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের নির্মোহ মতামত দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হলে সেটিই হবে সবচেয়ে যৌক্তিক। একইভাবে প্রত্যাশার ভিত্তিও যৌক্তিকভাবে দাঁড় করাতে হবে। তা না হলে আমাদের বারবারই হতাশ হতে হবে। যে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়, সে বাংলাদেশ রাতারাতি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হয়ে যাবে- এমন প্রত্যাশা যৌক্তিক নয়। কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা আছে কি না কিংবা দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলো জোরদার হচ্ছে কি না- সেটি আমাদের বিচার করতেই হবে। শুধু কথায় নয়, সেই বিচারে যাদের কর্মকাণ্ড উত্তীর্ণ মনে হবে, তারাই আমাদের সমর্থন পাবে এবং সেটিই প্রত্যাশিত।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.