সমুদ্র-ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা :সামনে কঠিন সময় by ম. ইনামুল হক

জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত g©vwbi nvgey‡M© Aew÷’Z International Tribunal for the Law of the Seas (ITLOS) গত ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের (১৬ নম্বর মামলা) ওপর রায় দেওয়া হয়।
এ রায় জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন (UNCLOS III)-এর ২৮৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী গঠিত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আসে, যেখানে বলা হয়েছে, সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিম্নবর্ণিত মাধ্যমে নিষ্পত্তি করবে_
ক. আইনের সংযোজনী ৬ মোতাবেক গঠিত সমুদ্র আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল;
খ. ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত;
গ. সংযোজনী ৭ মোতাবেক গঠিত সালিশি ট্রাইব্যুনাল;
ঘ. সংযোজনী ৮ মোতাবেক এক বা একাধিক বিরোধ মীমাংসার জন্য গঠিত বিশেষ সালিশি ট্রাইব্যুনাল।
সমুদ্র আইনের ২৮৭ (ক) ধারা অনুযায়ী গঠিত ITLOS প্রদত্ত রায় উভয় বিরোধী দলের কাছে অবশ্য গ্রহণীয় ছিল। ট্রাইব্যুনালের রায় মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়েছে; কিন্তু ভারতের সঙ্গে বিরোধ এখনও মেটেনি। ভারতের দাবি, সাগরতট থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে ও বাইরে আমাদের অনেক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বল্গক ভেদ করে গেছে। ভারতের দাবির বিপরীতে বাংলাদেশের দাবি ওই ২৮৭ (গ) ধারা অনুযায়ী দি হেগ নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত জাতিসংঘের স্থায়ী সালিশি আদালতের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে। এই সালিশের রায় আগামী ২০১৪ নাগাদ পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু বিরোধের একটি ন্যায্য রায় পেতে বাংলাদেশের অনেক কঠিন সময় পার করতে হবে।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন :আজকের সমুদ্র আইন জাতিসংঘের সমুদ্র আইন বিষয়ক কনফারেন্স ১৯৫৮ (UNCLOS I), ১৯৬০ (UNCLOS II) এবং ১৯৮২ (UNCLOS III)-এর ফল। টঘঈখঙঝ ওওও-এর ৩ ও ১৫ ধারায় প্রতিটি দেশের সমুদ্র তটরেখা (ভাটার রেখা) থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল= ১.৮৫২ কিলোমিটার) ওই দেশের রাষ্ট্রীয় সমুদ্র বলা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দুটি দেশের রাষ্ট্রীয় সমুদ্রসীমা দুই দেশের তটরেখা থেকে টানা সমদূরত্ব রেখার মাধ্যমে নির্ণিত হবে। রাষ্ট্রীয় সীমাভুক্ত সমুদ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা স্ব-স্ব দেশের দায়িত্ব হবে, তবে বিদেশি কোনো জাহাজের নিরপরাধ অতিক্রমণের সুযোগ থাকবে। ধারা ৩৩ মোতাবেক আরও ১২ নটিক্যাল মাইল সনি্নহিত এলাকা হবে, যেখানে একই প্রকার অধিকার ও দায়িত্ব বর্তাবে। UNCLOS III-এর ৫৫, ৫৬, ৫৭ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি দেশের সমুদ্র তটরেখা (ভাটার রেখা) থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল ওই দেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকা হবে। এই অংশের সব সম্পদের মালিকানা, ব্যবহার ও উন্নয়ন ওই তটবর্তী দেশের এখতিয়ারভুক্ত হবে। টঘঈখঙঝ ওওও-এর ৭৬ নম্বর ধারা তটবর্তী দেশকে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকার বাইরে ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় (কন্টিনেন্টাল শেলফ) কিছু অধিকার প্রদান করেছে।
বাংলাদেশের তটরেখা : বাংলাদেশের তটরেখা ভারতের সঙ্গে সীমানায় হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনা থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত কাদায় জেগে ওঠা অনেকগুলো দ্বীপে পরিপূর্ণ। এর কারণ, প্রতিবছর বাংলাদেশের নদীগুলো উজান থেকে প্রায় ১৪শ' মিলিয়ন টন পলি বহন করে আনে, যার একটি বড় অংশ সাগরে গিয়ে পড়ে। যেহেতু কোনো স্পষ্ট তটরেখা নেই, বাংলাদেশ হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর পলি প্রবাহ রেখা ধরে অতল সমুদ্র পর্যন্ত দাগ টেনে ভারতের সঙ্গে তার সাগরসীমা সাব্যস্ত করে এবং সেখান থেকে ১৮০ ডিগ্রি আজিমুথ ধরে আরেকটি রেখায় সোজা দক্ষিণে একটি দাগ টানে। ভারত চায় হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর পলি প্রবাহ ধরে টানা রেখাটিই প্রলম্বিত হোক, যা কি-না বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অনেকগুলো বল্গক ভেদ করে যায়। উল্লেখ্য, সমুদ্র মানচিত্রবিদ ভি এল ফোরবেস বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনা থেকে ১৮০ ডিগ্রি আজিমুথ ধরে সোজা দক্ষিণে একটি রেখায় এঁকেছেন।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল উভয় দেশের তটরেখা এঁকে নির্ধারিত করে দেয় (মামলার রায় অনুচ্ছেদ ২০২, ২০৪)। চিত্র-১-এ ওই অনুযায়ী বাংলাদেশের তটরেখা (হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর পূর্বতীরে মান্দারবাড়ী দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া একটি রেখা এবং কুতুবদিয়া থেকে নাফ নদের মুখ আরেকটি রেখা), মিয়ানমারের তটরেখা এবং বঙ্গোপসাগরে সংশ্লিষ্ট এলাকা দেখানো হয়েছে। এই সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিমাণ হয় ২৮৩,৪৭১ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে বাংলাদেশকে ১১১,৬৩১ বর্গকিলোমিটার ও মিয়ানমারকে ১৭১,৮৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকা দেওয়া হয়েছে। লক্ষণীয়, ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট এলাকার পশ্চিমসীমা মান্দারবাদী দ্বীপ থেকে ১৮০ ডিগ্রি আজিমুথ ধরে সোজা দক্ষিণে একটি রেখা দিয়ে নির্ধারণ করেছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা :ITLOS এর ১৬ নম্বর মামলায় বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালকে বলে, বঙ্গোপসাগরের উত্তরাংশের বিশেষ গঠন এবং বৈশিষ্ট্যের জন্য 'কোনো বিভাজন পদ্ধতি'র মাধ্যমে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সাগরসীমা অঙ্কিত করা হোক (অনুচ্ছেদ ২১৩)। বাংলাদেশ এভাবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ১২ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ থেকে ২১৫ ডিগ্রি আজিমুথ রেখা টেনে তার একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকা ও মহীসোপানের সীমারেখা নির্ধারণের দাবি করে (অনুচ্ছেদ ২১৭)। ট্রাইব্যুনাল সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে বাংলাদেশের এলাকা ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সীমিত রেখে বাংলাদেশের তটরেখা নাফ নদের মুখের কাছে ফিরিয়ে দেয় (অনুচ্ছেদ ৩৪০)। ট্রাইব্যুনাল অতঃপর নাফ নদের মুখকে ভিত্তি ধরে দুই দেশের সমুদ্রসীমার সমদূরত্ব রেখাকে একটু ঘুরিয়ে ২১৫ ডিগ্রি আজিমুথ বরাবর টেনে দেয়। ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত রায় অনুযায়ী (অনুচ্ছেদ ৫০০-৫০৫) ২১৫ ডিগ্রি আজিমুথ বরাবর রেখাটি ওই অবস্থান পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে যে অবস্থানে তৃতীয় কোনো দেশের অধিকারের প্রশ্ন আসে।
ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ :চিত্র ১ ও ২ তুলনা করলে আমরা দেখব, ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের জন্য যে ১১১,৬৩১ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা ঘোষণা করেছে, তার ভেতরে ভারতের দাবি আছে। আমরা এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করব? 'কোনো বিভাজন পদ্ধতি'তে বিভাজন হলে ভারতের দেবী পয়েন্ট থেকে হাড়িয়াভাঙ্গা এবং বাংলাদেশের হাড়িয়াভাঙ্গা থেকে নাফ নদের যে কোণ (ধহমষব) হবে, তাতে ভারতের দাবির মতোই একটা পরিস্থিতি দাঁড়াবে। তাই আমাদের দাবিকৃত সমুদ্রসীমা পেতে হলে সমুদ্র আইনের ৭৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রাকৃতিকভাবে প্রাগ্রসরমান সমুদ্র তলদেশের ভিত্তিতে আমাদের এগোতে হবে।
সাগরসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধের একটি ন্যায্য সমাধানে আসতে এবং খোলা সাগরে বাংলাদেশের প্রবেশপথের জন্য বঙ্গোপসাগরে পলিপাতনের একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরতে হবে। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশকে বলতে হবে, অতল সমুদ্র রেখার পূর্ব পাশে ভারত থেকে কোনো পলি আসে না, তাই এই রেখার পূর্ব পাশে ভারতের সমুদ্র এলাকা দাবি করার কোনো যুক্তি নেই। আমরা এই পথ হারালে অথবা কোনো সমঝোতা বা ওঞখঙঝ কর্তৃক অঙ্কিত সীমারেখায় রাজি হলে আমরা ২০০ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে বা বাইরে ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্রবেষ্টিত দেশ হয়ে যাব। যদিও তাদের সমুদ্রতলের উপরিভাগের জলের ওপর সমুদ্র আইনের (UNCLOS III ) ৫৬, ৫৮, ৭৮, ৭৯ ধারা এবং অন্যত্র অন্য কোনো দেশের জাহাজ ও বিমান চলাচল, সাবমেরিন কেবল এবং পাইপলাইন স্থাপন ইত্যাদি কিছু ব্যাপারে যেসব অধিকার দেওয়া আছে, তা অব্যাহত থাকবে। ITLOS-এর রায়ে (অনুচ্ছেদ ৪৭৫) বাংলাদেশের সাগরসীমার 'ধূসর এলাকা'য় মিয়ানমারকে একই ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সমুদ্র আইনের ধারা ৭৯(৪) অনুযায়ী মিয়ানমারকে ওই 'ধূসর এলাকা'র মাটির গভীরে বা উপরের পানির ভেতরের সম্পদ আহরণের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট; সাবেক মহাপরিচালক পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা
minamul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.