একুশ শতক- ইন্টারনেট ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর by মোস্তাফা জব্বার

॥ এক ॥ যুগ পরিবর্তনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন অনিবার্য। সারা দুনিয়াতেই সেটি হয়ে আসছে। মূলত সংস্কৃতির ধারা নির্ভর করে যুগের ধারার ওপর। মানব সভ্যতার বিবর্তনে তাই সংস্কৃতিরও বিবর্তন হয়। বাংলাদেশ প্রধানত কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল বলে এর সাংস্কৃতিক ধারায় যেমন করে লোকায়ত বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে লোকজীবন বা গ্রামের প্রভাব।
মানুষের আচার-আচরণে রয়েছে গ্রামের জীবনাচার ও সভ্যতার আদিযুগের প্রকাশ। সেই সাথে সামন্ত যুগের প্রভাব ও পুঁজিবাদে রূপান্তরের সংঘাতটিও এই সাংস্কৃতিক ধারায় বহাল রয়েছে। বলা যেতে পারে যে, সামন্ত সংস্কৃতি ভাঙ্গছে এবং পুঁজিবাদী সংস্কৃতি গড়ছে। গ্রামের সংস্কৃতির পতন হচ্ছে আর শহরের সংস্কৃতি গড়ছে। অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজের ভাঙ্গাগড়ার প্রভাব পড়ছে সংস্কৃতিতে। বস্তুত আমরা অনেক আগে বা ব্যাপকভাবে শহুরে বা নগরবাসী হতে পারিনি বলে সংস্কৃতিতে এখনও নাগরিকবোধ প্রবলভাবে আসেনি। এমন সময়ে যখন ডিজিটাল যুগ, বিশ্বায়ন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ইত্যাদির বিকাশ ঘটছে তখন সনাতন ধারার সংস্কৃতির সাথে নতুন ধারার সংস্কৃতির সংঘাতও তৈরি হচ্ছে।
অনেকেই এখন সারা দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোর সাথে আমাদের সংস্কৃতির তুলনা করেন। এই সময়ে তারা ভাবেন না যে, পশ্চিমা বা দুনিয়ার অন্য সকল উন্নত দেশগুলোতে গ্রাম্যতা বিদায় নিতে শুরু করেছে সতেরো শতকে। অন্যদিকে আমরা নগরে আসতে শুরু করেছি দুই যুগের বেশি সময় হয়নি। অর্থনীতির সামন্ত চরিত্র বদল হয়ে পুঁজিবাদী চরিত্রও খুব বেশি সময় ধরে হয়নি। একই সাথে এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা পুঁজিবাদের বিকাশকে চোখে দেখে শেষ করার আগেই ডিজিটাল যুগে পা দিয়ে ফেলেছি।
সার্বিকভাবে আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা যখন কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে যাচ্ছি তখনও সাংস্কৃতিক রূপান্তর একটি বড় বিষয়। বাস্তবতা হলো; বাংলাদেশ এখন এমন একটি সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে যখন আমাদের সাংস্কৃতিক রূপান্তর হবেই। প্রথমত সামন্ত যুগ ও কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে আমরা পুঁজির দিকে যাবো এবং দ্বিতীয়ত সেটি ডিজিটাল যুগের দিকে ধাবিত হবে।
এটি সম্ভবত এখন আর বলার প্রয়োজন নেই যে, আমরা ইন্টারনেট সভ্যতায় পা রেখেছি। কেউ কেউ একে ডিজিটাল যুগ বলেন। অনেকেই বলেন, আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজের দিকে যাচ্ছি। যে যুগ, সভ্যতা বা সমাজেই যাই না কেন, ইন্টারনেট হচ্ছে সেই সভ্যতার বাহন। দুনিয়ার সকল উন্নত দেশ তো বটেই-বাংলাদেশও সেই সভ্যতার অংশ হয়ে যাচ্ছে। এজন্য ঘটে যাচ্ছে রূপান্তর। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য; তথা জীবনধারা হয়ে যাচ্ছে নতুন। এই নতুন সভ্যতার জন্য গড়ে উঠছে নতুন সংস্কৃতি। ইন্টারনেট হয়ে যাচ্ছে আমাদেরও লাইফলাইন। বলা হয়ে থাকে, Internet has lead to the advancement, exploration and the homogenization of cultures around the world. This is the case because of its effects global communication, education, marketing and the ability to access information about other cultures.(http:// scratchpad.wikia.com / wiki / Cultural_Impacts_of_the_Internet) এজন্যই আমাদের সংস্কৃতির যে রূপান্তরটি ইন্টারনেট যুগে হচ্ছে তার বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
ইন্টারনেটের প্রসার : প্রেক্ষিতটা এ রকম। ১৯৬৯ সালের আরপানেট থেকে ১৯৯১ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আবির্ভাব এবং দিনে দিনে এর প্রসার পুরো দুনিয়াকে একটি নতুন সভ্যতা উপহার দিয়েছে। ২০০৫ সালে যেখানে মাত্র ১১৫ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করত সেখানে ২০১২ সালের এপ্রিলে সেই সংখ্যা ২২৭ কোটিতে ওঠেছে। বাংলাদেশে হঠাৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। জুলাই ২০১২ এর হিসাব অনুসারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২.৯৪ কোটি। ২০০৮ সালের ডিসিম্বেরে ইন্টারনেটের ব্যবহারকারী যা ছিল এখন সেটি তার চাইতে প্রায় ৬ গুণ বেশি। এর পেছনে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইদথের দাম কমা, ইন্টারনেটে প্রয়োজনীয় কনটেন্টস পাওয়া এবং ফেসবুকের মতো সামাজিক নেটওয়ার্ক ও ব্লগিংয়ের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। যে কেউ এখন দেশের সব প্রান্তের বিপুল পরিমাণ মানুষকে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হওয়া অবস্থায় দেখতে পাবেন। এক সময়ে যা কেবল কিছুসংখ্যক মানুষের সাময়িক কার্যকলাপ হিসেবে গণ্য হতো এখন সেটি দেশের প্রায় সকল এলাকার মানুষেরই প্রাত্যহিক ক্রিয়া-কর্মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের মাইলফলক অগ্রগতি। সরকার ২০০৬ সালে সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে দেশটিক যুক্ত করে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে ব্যর্থ হলেও সাম্প্রতিকালে সেই অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আমাদের উৎসাহিত করছে। এই খাতে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের যুক্ত হওয়াটাও নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের সফলতা। একই সাথে বিগত তিন বছরে মোবাইলের সংযোগের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ার বিষয়টিও ইতিবাচক। মোবাইলের সংযোগ বৃদ্ধি এবং মোবাইল ও ওয়াইম্যাক্স কোম্পানিগুলো অত্যন্ত আক্রমণাত্মকভাবে ইন্টারনেট কানেকশন বাজারজাত করার ফলেও ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে, এই প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত হবে এবং দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ অনেকের ধারণার বাইরে চলে যাবে। এটি অবশ্যই একটি শুভ লক্ষ্মণ। তবে আমি মনে করি, ইন্টারনেটের প্রসারটি কেবল ব্যবহারকারীর সংখ্যাতে নয়; বস্তুত এর মধ্যে থাকা কনটেন্টই হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় শক্তি।
অতীতে একটি দেশের অগ্রগতির মাপকাঠি হিসেবে টেলিফোন কানেকশনকে বিবেচনা করা হতো। বলা হতো টেলিঘনত্ব কেমন তার ওপরে একটি দেশের অগ্রগতির সূচক নির্ধারণ করা হয়। এখন সেটি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবহার দিয়ে বিবেচনা করা হয়। বিষয়টি এ রকম বিধায় আমরা বুঝতে পারছি যে, আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারে এগিয়ে গেলেও কার্যত যাকে মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেই ব্রডব্যান্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের তেমন বড় অগ্রগতি নেই। মাত্র দুটি ওয়াইম্যাক্স কোম্পানি ও একটি মোবাইল অপারেটর সীমিত পর্যায়ের ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান করে। জুলাই ২০১২-এর হিসাব অনুসারে সেই সংখ্যা শতকরা মাত্র ১ ভাগের কিছুটা ওপরে বা ৪ লাখের একটু বেশি। শুধু তাই নয়, এসব সংযোগ আবার একেবারেই বড় শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের মানুষ কোনভাবেই ব্রডব্যান্ড সেবা পায় না। মনে করা হয়েছিল যে, থ্রিজি মোবাইল সংযোগ পাওয়া গেলে আমরা ব্রডব্যান্ডের যুগে খুব সহজেই পৌঁছাতে পারব। বারবারই থ্রিজির আগমনের ঘোষণা আসছে-কিন্তু থ্রিজি আসছে না। বলা হয়েছিল, গত মার্চে থ্রিজি চালু হবে। এখন বলা হচ্ছে এই সেপ্টেম্বরে থ্রিজি আসবে। থ্রি জির টেস্টিংও সম্পন্ন হয়েছে। টেলিটক নামক সরকারী সংস্থাটি কিভাবে থ্রিজি সংযোগ পাওয়া যাবে তার জন্য গ্রেভিটি ক্লাব নামক একটি বাজারজাতকরণ প্রকল্পও চালু করেছে। কিন্তু আমরা আদৌ জানি না যে টেলিটক থ্রিজি প্রচলনের ক্ষেত্রে কি ভূমিকা পালন করবে বা কবে নাগাদ আমরা এর স্বাদ পাবো। তবে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার যে শুধুমাত্র টেলিটক যদি থ্রিজি প্রচলন করে তবে তা থেকে দেশের সকল সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বরং এর জন্য বেসরকারী অপারেটরদের যদি দ্রুত লাইসেন্স প্রদান করা না হয় তবে আমরা থ্রিজির মজাটা পাবনা। সুতরাং এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হচ্ছে অতি দ্রুত থ্রিজি চালু করা। (চলবে)
অন্য প্রসঙ্গে শেষ টোকা ॥ হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা : গত কয়েক সপ্তাহ যাবত যারা আমার লেখাগুলো পড়ছেন তারা লক্ষ্য করেছেন যে আমার লেখাগুলোর বিষয়বস্তু আইসিটি বা কম্পিউটার হলেও আমি সমসাময়িক প্রসঙ্গগুলো নিয়ে ছোট ছোট মন্তব্য করা শুরু করেছি। শেষ টোকা বা অন্যপ্রসঙ্গ নিয়ে এই মন্তব্যগুলোতে বিষয়গুলোর বিস্তারিত আলোচনা না হলেও অন্তত চুম্বক মন্তব্যটি প্রকাশ পায়। এর প্রধান কারণ যে আমরা কেবল কম্পিউটারের জগতে বাস করি না দেশের অন্য সব বিষয়ও আমাদের আকৃষ্ট, প্রভাবিত বা আন্দোলিত করে। এসব ঘটনার শিকার হই আমরা এবং আমাদের বুকেও জ্বালা ধরে। এমনি করে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে হলমার্ক ও অন্যান্য ঋণ কেলেঙ্কারির প্রতি। এটি পুঁজিবাদের চরম বিকারের অদ্ভুত প্রকাশ ঘটিয়েছে।
মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনে কাজ করা একটি মানুষ মাত্র দশ বছরে কেবল যে ২৬০০ কোটি টাকা একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তাই নয়, তিনি দাবি করেছেন তার কাছে এর ২০ গুণ সম্পদ আছে। আমার নিজের মাথায় ঢোকে না যে মাত্র দশ বছরে ৫২ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ একটি ব্যক্তি কোন উপায়ে অর্জন করতে পারে। আমার তো মনে হয়, এগুলো যদি ১ টাকার নোট হয় তবে ১০ বছরে সব টাকা গুনেও শেষ করা যাবে না। আমি আয়করের হিসাব না জানলেও এটি বলতে পারি যে, যে পরিমাণ আয়কর তাকে রাষ্ট্রকে দিতে হবে সেটির হিসাবও আমি করতে পারি না। অন্যদিকে একটি ভীষণ উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানের বিষয়টি। একটি ব্যাংক কিভাবে কোন ধরনের কোলাটেরাল ছাড়াই এত বড় একটি ঋণ কাউকে দিতে পারে সেটি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। একই সাথে আমরা সোনালী ছাড়াও আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে এতটা গুরুতর না হলেও অনেক অনিয়ম করার খবর শুনে আতঙ্কিত। আমরা চারপাশে শুনতে পাচ্ছি যে, এজন্য কেউ দায় স্বীকার করছেন না এবং কেউ অন্যকে দায়ী করছেন। আমি নিজে মনে করি, যে ব্যাংক থেকে ঋণগুলো দেয়া হয়েছে সেই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপক ও ঋণের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঋণ অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের কেউ এই দায় অস্বীকার করতে পারেন না। যাদের তদারকি করার কথা তারাও দায় এড়াতে পারেন না। আমি এটিও মনে করি যে, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়াই শুধু নয়, এইসব ঋণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে তার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আরও কোন এ ধরনের ঘটনা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে।

ঢাকা, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net

No comments

Powered by Blogger.