দুঃস্বপ্ন শিখাকে বাঁচতে দেয় না by মেহেরুন নেছা রুমা

শিখা তার নাম। নামের মতোই ছিল তার জীবনটা। কিন্তু আলোকিত, হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণোচ্ছল মেয়েটির জীবনের শিখা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে_ যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক। জীবনকে সাজাতে চেয়েছিলেন তিনি একটু অন্যরকম করে।


মেধাবী ছাত্রী শিখা চেয়েছিলেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে স্বপ্নের সোনার হরিণ 'সরকারি চাকরি'র আশায় বসে না থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। চাকরির পর বিয়ে এবং বিয়ের পর অনেকটা বছর পার হলেও যখন সন্তান হচ্ছিল না, তখন থেকে মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন শিখা । মা হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন তিনি। ডাক্তার, কবিরাজ, ঝাড়-ফুঁক কোনোটাই বাদ দেননি। অনেক চেষ্টার পর সৃষ্টিকর্তার দয়া হলো। শিখা নিজের মধ্যে আবিষ্কার করলেন তার অনাগত সন্তানের বেড়ে ওঠা। পৃথিবীটা তার কাছে আনন্দময় হয়ে উঠল। জীবনকে মনে হলো সার্থক। তিন মাসের ভ্রূণ নিয়ে শিখা চাকরি করছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি দায়িত্বশীল একটি পদে কর্মরত থাকায় বলতে গেলে ছুটি পেতেনই না তিনি। কর্মজীবী নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করেছে বর্তমান সরকার। সন্তান হওয়ার খুব কাছাকাছি সময়ে এই ছুটি নিয়ে থাকেন সবাই। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ সুবিধা খুব সহজে পাওয়া যায় না। শিখা খুব সুস্থ ছিলেন না। সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও শিখাকে অসুস্থ অবস্থায় অফিস করতে হয়েছে। খুব শখ করে তিনি চাকরি করতেন না। যদি সেটা শখের হতো মা হওয়ার জন্য, সে শখ জলাঞ্জলি দিতেন প্রথমেই। সংসারের প্রয়োজনেই শিখাকে চাকরি করতে হয়েছিল। সংসারের গুরুদায়িত্বটা ছিল শিখারই ওপর। প্রতিষ্ঠানের কাছে বারবার তার প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে ছুটি চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হলো, কাজ করতে না পারলে চাকরি ছেড়ে দিন। প্রতিদিনই রাত অন্তত ৮টা পর্যন্ত অফিস করতে হতো। এ অবস্থায় একদিন অফিস থেকে বের হতেই বিদ্যুৎ চলে যায়। ভবনের লিফট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৬ তলা থেকে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে শিখা নামছিলেন খুব ধীরে ধীরে।
আশপাশে আরও দু'একজন আছেন, তবে তারা বেশির ভাগই পুরুষ। নিজেকে কিছুটা সুরক্ষিত রেখে পথ চলতে চলতে সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে শিখার চার মাসের সন্তান গর্ভেই প্রাণ হারায়। এত সাধনা করে যে, সন্তানকে দুনিয়ার মুখ দেখাতে চেয়েছিলেন, নিমিষেই তা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। এখন শিখা ঘুমের ঘোরে শুধুই দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠেন। তিনি আর মা হতে পারবেন না, এমনটি জানিয়েছেন ডাক্তার। এক মাস হাসপাতালের বিছানায় থাকার পর যখন বাড়িতে নেওয়া হলো, শিখা কেমন অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠলেন। অনেক কষ্টে দুই মাসের ছুটি নিয়েছিলেন ওই দুর্ঘটনার পর। কিন্তু দুই মাসেও যখন সুস্থ হলেন না তখন অফিস থেকে নোটিশ দেওয়া হলো, এখনই জয়েন না করলে শিখার স্থলে অন্য লোক নেওয়া হবে। প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি রক্ষায় শিখা কর্মস্থলে যোগদান করেন। কারণ সংসারের চাকাও বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমেই। কিন্তু অসুস্থ শিখা কতটা সচল রাখতে পারবেন সংসারের চাকা, জানেন না তিনি। যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
 

No comments

Powered by Blogger.