‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়...’ by সুমনকুমার দাশ

প্রখর রোদ। গরম হাওয়া বইছে। সবার শরীর ঘেমে একাকার। কিন্তু কারও চোখে-মুখে ক্লান্তি-শ্রান্তির রেশটুকু পর্যন্ত নেই। সবাই বিরামহীন নেচে-গেয়ে চলছেন। সেই বেলা একটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। একটু পরপরই সমস্বরে হাজারো মানুষের চিৎকার বাতাসে ভাসছে।


সবার কণ্ঠে প্রয়াত বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় সেই গান: ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়...’।
এভাবেই গতকাল শনিবার সিলেট নগরবাসী আনন্দ-উচ্ছ্বাসে নৌকাবাইচ প্রত্যক্ষ করে। নগরের ঐতিহাসিক কিনব্রিজসংলগ্ন চাঁদনিঘাট এলাকার সুরমা নদীর অংশে এ বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। মুঠোফোন কোম্পানি বাংলালিংকের পৃষ্ঠপোষকতায় সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা পঞ্চমবারের মতো এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। পুরো অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ছিল বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশন। বেলা দুইটায় নৌকাবাইচ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই মানুষজন নদীর তীরে ভিড় করতে থাকে। নদীর দুই পাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজারো মানুষের উৎসুক দৃষ্টি ছিল চমৎকারভাবে সাজানো কয়েকটি নৌকার দিকে। এ নৌকাগুলো থেকে ভেসে আসছিল সিলেট অঞ্চলের প্রখ্যাত বাউলসাধকদের লেখা প্রচলিত-অপ্রচলিত গান। বাউলশিল্পীদের পরিবেশনার সঙ্গে হাজারো মানুষের কণ্ঠ নদীর তীরে অন্য রকম দ্যোতনার সৃষ্টি করে।
বাইচ দেখতে আসা নগরের সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা আশরাফ হোসাইন বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে নিয়ে নৌকাবাইচ দেখতে এসেছি। আমার জন্ম গ্রামে হওয়ায় শৈশবে বহুবার নৌকাবাইচ দেখেছি। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের জন্ম এ শহরে হওয়ায় ওরা কখনো গ্রামীণ বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়নি। তাই ওদের নিয়ে এসেছি।’
ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোছাব্বের আলী বলেন, ‘প্রখর রোদ সত্ত্বেও একটু নির্মল বিনোদন পাওয়ার জন্য বাইচ দেখতে এলাম। এত এত মানুষের ভিড়, কিন্তু একটুও অসহ্য লাগেনি। বহু দিন পর নগরের একঘেয়ে জীবনে একটু সতেজ বিনোদন পেলাম মনে হচ্ছে।’ বেলা আড়াইটার দিকে প্রতিযোগিতার জন্য একের পর এক নৌকাভর্তি মানুষ পানিতে নামে। এসব নৌকায় গায়ক, ঢুলি, পরালি কামলা, কারালি কামলারা কমলা রঙের গেঞ্জি পরে সারিবদ্ধভাবে বসেন। বাইচে অংশগ্রহণকারী নৌকায় আঁকা রয়েছে উড়ন্ত পরি, জোড়া চোখ, পদ্মফুল, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, দোয়েল পাখি, লতাপাতা ও বিভিন্ন রেখাচিত্র। দৃষ্টিনন্দন এসব নৌকার মাঝিরা বৈঠার তালে তালে নৌকাটিকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যান।
বিকেল চারটার দিকে ‘বিজয়ের লক্ষ্যে ছুটে চলি দুরন্ত গতিতে’ শীর্ষক মূল প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এতে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলের মোট ২১টি নৌকা অংশ নেয়। ‘ময়ূরপঙ্খি’ ও ‘কোষা’—দুই ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দুই পর্বের প্রতিযোগিতার উভয় পর্বে তিনটি নৌকাকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘোষণা করে সর্বমোট ছয়টি নৌকাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিজয়ীদের টেলিভিশন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। বিজয়ীরা পরে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন, জেলা পরিষদের প্রশাসক আব্দুজ জহির চৌধুরী, বাংলালিংক সিলেটের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমরান আহমেদ, সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মো. ইমরান চৌধুরী, বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আউয়াল প্রমুখ।
সভায় বক্তারা বলেন, নৌকাবাইচ এ দেশের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই এ ধরনের নৌকাবাইচ আয়োজন বাঙালির আদি সংস্কৃতিকে আরও শাণিত ও সমৃদ্ধ করবে।

No comments

Powered by Blogger.