কলকাতার চিঠি- মমতা এবং মার্কন্ডেয় কাটজু by অমর সাহা

সৎ, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলনা নেই। জুড়ি নেই তাঁর লড়াকু ভাবমূর্তিরও। এই লড়াকু মমতাই কংগ্রেস ভেঙে গড়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস। ভেঙে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের একটানা ৩৪ বছরের বাম শাসন।


সেই মমতা এখন পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গ শাসন করছেন ১৬ মাস ধরে। এনেছেনও রাজ্যে অনেক পরিবর্তন। পাশাপাশি নিজেরও ঘটেছে পরিবর্তন। যে মমতার ক্ষমতায় আসার আগে প্রধান অস্ত্র ছিল আন্দোলন, প্রতিবাদী মিছিল, সভা, সমাবেশ, অবরোধ, হরতাল, ধর্মঘট; এখন সেই মমতা ভয় পান এসবে। তাঁর রুচি নেই ধর্মঘটে, আন্দোলনে। মমতার সোজা কথা, রাজ্যে কোনো ধর্মঘট নয়, বিক্ষোভ নয়। শুধু তুলে রাখতে হবে গোটা রাজ্যের উন্নয়নের ঝান্ডা। আর এ নিয়ে আজ নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছেন মমতা।
বলতে দ্বিধা নেই সত্যিই আজ মমতা মিছিলে ভয় পান, আন্দোলনে ভয় পান। ভয় পান সমালোচনাতেও। ভাবেন এতে কী জানি কী হয়ে যায়? তাই চান না তাঁকে কেউ সমালোচনা করুক। চান না রাজ্যে কোনো আন্দোলন হোক। হোক হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ ইত্যাদি। চান না কোনো খবরের কাগজ তাঁর বিরুদ্ধে লিখুক। আর লিখলেই তো কথা নেই। অভিযোগ উঠে আসবে অর্থের বিনিময়ে খবর লেখার। মমতার কথা, লেখা যাবে না ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে,আত্মহত্যার বিরুদ্ধে। তবেই অপবাদ উঠবে টাকার বিনিময়ে লেখা হচ্ছে এসব ধর্ষণ ও আত্মহত্যার কাহিনি। আর এর পেছনে রয়েছে সিপিএমের মদদ।
অথচ মমতাও একদিন যখন এ রাজ্যের বিরোধী শক্তির আধার ছিলেন, তখন তাঁর অস্ত্র ছিল এই মিটিং- মিছিল-ধর্মঘট-অবরোধ। তিনি আন্দোলন করেছেন দ্রব্যমূল্যের বিরুদ্ধে; পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে; বাস, ট্রাম, ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে; সিঙ্গুরে টাটাকে লিজ দেওয়া জমির বিরুদ্ধে; নন্দীগ্রামে প্রস্তাবিত রসায়ন শিল্পাঞ্চল গড়ার বিরুদ্ধে। এ জন্য তিনি আমরণ অনশন করেছেন। অবরোধ করেছেন সড়ক, রেল। আন্দোলনের নামে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ভাঙচুরও করেছে তাঁর দল। নারী নির্যাতন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, পথে নেমেছেন। আর এ জন্য পেয়েছিলেন অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ও সংবাদপত্রের অকুণ্ঠ সমর্থন। সেই সংবাদমাধ্যম ও সংবাদপত্রের কেউ যখন আজ তাঁর বিরুদ্ধে দু-একটি কথা লিখছে, তখন তিনি আর তা সহ্য করতে পারছেন না। লাগিয়ে দিচ্ছেন অর্থের বিনিময়ে সংবাদ লেখার তকমা।
এই তো সেদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র শিকার হন মমতার। মমতার কার্টুন ই-মেইলে পাঠানোর জন্য তাঁকে যেতে হয় কারাগারে। হেনস্তা হতে হয়। কলকাতার টাউন হলে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর প্রশ্ন শুনে রাগে-ক্ষোভে অনুষ্ঠান ত্যাগ করে বের হয়ে গিয়েছিলেন মমতা। মেদিনীপুরের এক জনসভায় এক কৃষকের সারের মূল্য নিয়ে প্রশ্ন করার খেসারত দিতে হয় ওই কৃষককে। পেতে হয় মাওবাদী তকমা। যেতেও হয় কারাগারে।
একজন শাসকের এহেন ভূমিকায় যারপরনাই অখুশি পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ। এসব ঘটনায় তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে মমতার বিরুদ্ধে। সবারই এক কথা, ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছেন মমতা। যোগ্যতা নেই রাজ্য শাসনের। আর এ নিয়ে এখন সোচ্চার গোটা পশ্চিমবঙ্গবাসী। আনাচকানাচে শুরু হয়েছে মমতাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা, কটাক্ষ। বলা হচ্ছে, সবকিছুই বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে। যে অস্ত্র নিয়ে মমতা আন্দোলন করে ক্ষমতায় এসেছেন, সে অস্ত্রই এখন মমতাকে তাড়া করছে।
আর এসব ঘটনার মধ্যেই প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু বলেই দিয়েছেন, মমতার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা নেই। বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তি হিসেবে এতটাই অপরিণত যে তিনি ভারতের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যই নন। তাঁর উচিত মুখ্যমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে আসীন হওয়ার আগে কিছুটা পরিণত হওয়ার চেষ্টা করা। বলেছেন, সংবিধান ও আইনকে মমতা তোয়াক্কাই করেন না। যা মুখে আসে তা-ই বলেন। যা খুশি তা-ই করেন।
প্রসঙ্গত, কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সম্প্রতি যুবা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সম্মেলনে মমতা টাকার বিনিময়ে সাংবাদিকদের একাংশ খবর তৈরি করে বলে অভিযোগ তোলেন। এ অভিযোগ তোলায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাটজু ওই মন্তব্য করেন। তিনি এ কথাও বলেন, মমতার সেদিনকার বক্তব্য শুধু ভিত্তিহীনই নয়; এটা দায়িত্বহীনতার পরিচয়ও বহন করে। রাজ্যে ধর্ষণ ও নারীর শ্লীলতাহানির খবর করতে গিয়ে যদি মমতা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তোলেন তাহলে তাঁর উচিত এর সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করা। নয়তো তিনি নিজেই মিথ্যা কথা বলার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন।
মমতাকে সারের মূল্য নিয়ে জঙ্গলমহলের এক কৃষক শিলাদিত্য চৌধুরীর প্রশ্নের কারণে তাঁকে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে কারাগারে পুরে দেওয়ার ঘটনাকে সেদিন মেনে নিতে পারেননি রাজনৈতিক নেতারাসহ কলকাতার বুদ্ধিজীবীরাও। ঘটনার পর বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা বলেছিলেন, মমতা এখন নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছেন। কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতেই পারবে না। সিপিএম সাংসদ নীলোৎপল বসু বলেছিলেন, মমতা কখনো সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, যাঁরাই প্রশ্ন করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কাজে লাগাচ্ছেন।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, এটা সুস্থ গণতন্ত্রে হয় না। অভিনেতা, নাট্যকার কৌশিক সেন বলেছিলেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে মুখ্যমন্ত্রীকেই খেসারত দিতে হবে।
সত্যি কথা, মমতা আজ সত্যিই পাল্টে গেছেন। মমতা আর নেই সেই মমতায়। এখন তিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। ধৈর্য হারাচ্ছেন। তাঁর মনে এমন আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেছে যে আন্দোলনের নামে কী যেন হয়ে যায়? তাই তো মমতা এখন কলকাতার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে ভয় পান। সংবাদপত্রকে ভয় পান। কখন কী লিখে ফেলে, কখন কী প্রচার করে তারা?
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.