এখনই সতর্ক হতে হবে by মিলু শামস

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিজের শাসনকালকে বলতেন, ‘একুশ শতকে নতুন ভারত গড়ার স্বপ্নের প্রাক-প্রস্তুতি।’ ওই প্রস্তুতি পর্বে তিনি দুটো স্বপ্নের বাস্তব ভিত দিয়েছিলেন। এক. আধুনিক টেলিযোগাযোগের সূচনা, দুই. কম্পিউটার ব্যবস্থা চালু।


একুশ শতকের এক দশক পেরিয়ে সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারত ও রাজীবের সেদিনের সে স্বপ্ন বীজের প্রবল পরাক্রমশীলতা দেখছে মোবাইল ফোন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকশিত মহীরূপ রূপে। যে দলের পতাকা নিয়ে রাজীব ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই কংগ্রেসের সাংগঠনিক কাঠামো তখন নানা অন্তর্দ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত। তা নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। আগামীর স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়নের পথ কেটে এগোচ্ছিলেন। তরুণ প্রধানমন্ত্রী তারুণ্যের টেম্পারমেন্ট বুঝতে পেরেই সম্ভবত নতুন শতকের জন্য প্রস্তুতির লড়াই শুরু করেছিলেন। কিন্তু ‘বোফোর্স’ কেলেঙ্কারির কাল দাগ গায়ে মেখে শেষমেশ সব খোয়ালেন। আজও রাজীব গান্ধী নামটির সঙ্গে ‘বোফোর্স’ শব্দটি প্রচ্ছন্নে মিশে আছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের একি এক অনিবার্য অভিশাপ? ঢাকঢোল পিটিয়ে ফুলের মালা দিয়ে যাকে বরণ করে নেয়া, সময়ের পরম্পরায় তাকেই আবার গার্বেজে ছুড়ে ফেলা। দুঃখজনক হলো ক্ষমতায় গিয়ে এ ভবিতব্যের কথা অনেকেই ভুলে যান।
ভারতে রাজীব গান্ধী নতুন শতকের প্রস্তুতির স্বপ্ন বুনেছিলেন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সেই শতকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখালেন। তাঁর স্বপ্নের ছোঁয়ায় জেগে ওঠেন দেশের মানুষ। ভোটের জোয়ারে ভাসিয়ে তারা ডিজিটাল বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেন। তাদের এ আস্থার ভিত্তি ছিল চমৎকার এক ম্যানিফেস্টো ‘দিন বদলের সনদ।’ তিন সাড়ে তিন বছর পর তারা হিসাব কষে দেখতে চাইছেন কতটা বদল হলো তাদের দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছেÑ ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে অনেকটাই তুলনামূলক বিশ্লেষণে এ সরকারের সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থায় প্রবৃদ্ধি এসেছে চার শ’ শতাংশ। কোন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম শর্ত তার রিজার্ভ ব্যবস্থা।
বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি রিজার্ভের মালিক চীন। তারপর জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ষোলোতম। আর বাংলাদেশের চৌষট্টিতম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম রিজার্ভ এক হাজার এক শ’ কোটি ডলারের ঘর পেরিয়েছে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পরও গত তিন বছরে চারবার রিজার্ভ এক হাজার এক শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
জিডিপি ও মাথাপিছু আয়েও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। আগের সরকারের প্রথম তিন বছরে জিডিপির হার ছিল যথাক্রমে শতকরা চার দশমিক চার। পাঁচ দশমিক তিন ও ছয় দশমিক তিন ভাগ। এ সরকারের প্রথম তিন বছরে অর্জন শতকরা পাঁচ দশমিক সাত, পাঁচ দশমিক আট ও ছয় দশমিক সাত ভাগ। আগে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা উনিশ ভাগ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা চব্বিশ ভাগ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ভর করে দেশের রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকেই জানা যায়, এক দশক আগে বাংলাদেশে রেমিটেন্স আসে এক শ’ আটাশি কোটি একুশ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিটেন্স এসেছে ছয় শ’ ছয় কোটি পঞ্চান্ন লাখ ডলার। রেমিটেন্স সত্যিই পাল্টে দিচ্ছে গ্রাম-বাংলার অর্থনৈতিক চিত্র। অন্ধকারে নিমজ্জিত গ্রামগুলো এখন আলোর মুখ দেখছে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটছে। রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির মেরুদ- শক্ত করছে।
সাফল্য আরও আছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও কৃষিখাতে প্রকৃত মজুরি বাড়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। আগে একজন দিনমজুর তার একদিনের আয় থেকে পাঁচ থেকে ছয় কেজি চাল কিনতে পারতেন, এখন চালের দাম বাড়ার পরও দশ থেকে বারো কেজি চাল কিনতে পারেন। শ্রমজীবী মানুষের আয় বেড়েছে। কৃষিখাতে নানা ধরনের প্রণোদনা, ভর্তুকি, কৃষকদের কৃষিঋণের আওতায় আনা, সার-ডিজেলের দাম কমানো, বিনামূল্যে সেচ সুবিধা দেয়া, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড, দশ টাকায় এ্যাকাউন্ট খোলা ইত্যাদি অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। এবং এর ফলও মানুষ পেতে শুরু করেছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে সঠিক সময়ে বই বিতরণ করে অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। বিভিন্ন স্তরে জিপিএর বন্যাও তাঁকে প্রশংসিত করেছে। বিদ্যুতে কুইক রেন্টাল নিয়ে তর্কবিতর্ক চললেও মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে। যদিও সেজন্য বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে। তবু অতীতের সেই লাগাতার অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি মিলছে এ-ই অনেক বড় স্বস্তির। কিন্তু এসব অর্জনকে ম্লান করে দিয়ে সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তির পথ রোধ করছে নানা ধরনের দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি। সমস্যা আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গায়ও। কিছু অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে জড়িয়ে অযথাই জনপ্রিয়তার গোড়া কাটছে সরকার নিজেই। আর তা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও। ড. ইউনূস ইস্যু এর মধ্যে অন্যতম। ইউনূসের নানা ধরনের সমালোচনা আছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন তার সম্পর্কে কথা বলেন তখন প্রায়ই ভুলে যান ইউনূস একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। অন্য দশজনের সমালোচনা আর তার সমালোচনা এক নয়। তিনি একটি সরকারের কর্ণধার। একতরফা পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই তাকে চলতে হবে। ইউনূস এই পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক নানান রাজনীতি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সম্পর্কে কথা বলায় অনেক কৌশলী হতে হবে। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, সরকারের অনেক হেভিওয়েট মন্ত্রী-আমলারা কথাবার্তায় মাঝে মাঝেই মারাত্মক বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। তারা ভুলে যান বিশ্বে এখন পুঁজিবাদের পোলারাইজেশন চলছে এবং ওতেই তারা আকণ্ঠ নিমগ্ন। মাঝে মাঝে গলা তুলে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী সাজার চেষ্টা তাদের ব্যর্থতা বা কূপম-ূকতাকেই প্রকট করে। কোন বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে মন্ত্রী-আমলারা নিজের মতো করে মত দিতে থাকেন। যে যা ভাবছেন অবলীলায় তাই বলছেন। এ প্রসঙ্গে যার বলার এখতিয়ার নেই তিনিও ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন দেখে দিশেহারা হয়ে যান। অবস্থা দেখে মনে হয় সরকারের ভেতরে কোন চেইন অব কমান্ড নেই। সব কিছু ভেঙ্গে পড়ছে। যেসব খাতে উন্নয়ন বা অর্জন হয়েছে সেসব নিয়ে প্রচার প্রচারণা নেই। নেই যে তা নিয়ে উচ্চ মহলে মাথা ব্যথাও নেই। পাশাপাশি একের পর এক দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসছে। পদ্মা সেতুর রেশ কাটতে না কাটতে হলমার্ক গ্রুপের বড় ধরনের অনিয়ম এবং তা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর শিশুসুলভ বক্তব্যে দেশের মানুষ থ হয়ে গেছে। চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতিকে তিনি ‘সামান্য’ বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে উল্টো এ সংবাদ প্রকাশ করেছে বলে গণমাধ্যমকে দুষছেন। এ ধরনের বক্তব্য আগেও বহুবার এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকেও খাপছাড়া অনেক বক্তব্য এসেছে। মুশকিল হচ্ছে সমস্যা হতেই পারে। দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু মানুষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যখন ধরা পড়ে এবং দেখা যায় তার সঙ্গে সরকারের হোমরা-চোমড়াদের কেউ কেউ জড়িত তখন দ্রুত তারা সেফ সাইডে চলে যান। মানুষ যখন এসব দুর্নীতির পরিষ্কার তদন্ত চাইছে সরকারের আচরণ তখন ভীষণ রকম দুর্নীতিবান্ধব হয়ে যায়। এতে একদিকে কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা আরও উৎসাহ পায় অন্যদিকে সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব আরও মজবুত হয়।
পাঁচ বছর মেয়াদের সাড়ে তিন বছর পার করেছে সরকার। সময় আর বেশি নেই। নীতি দুর্নীতির আমলনামা ভোটারদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে বার বার ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছে থাকবেÑতাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিকভাবে এ সরকারেরও তা আছে। তাই ভোটারদের খুশি রাখার কাজটি তাদের এ সময়ের মধ্যেই করতে হবে।
ভোটারদের মন বুঝতে না পারলে নিশ্চিত ভরাডুবি থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গে চৌত্রিশ বছরের শক্তিশালী বামফ্রন্টকে উড়িয়ে দিল দু’দিনের তৃণমূলÑসে ওই ভোটারের মন বুঝতে না পারার জন্যই মূলত। শুধু দিন বদলের সনদ দিলেই চলবে না। বদলাতে হবে নিজেদের চরিত্রও। চোরকে চোর বলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সবাই চোর নয়, ভাল যারা তাদের যোগ্য জায়গা দিতে হবে। সততার ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তা শুধু কথায় হবে না, কাজ দিয়ে দেখাতে হবে। আর রাজনীতিতেও অবসর প্রথা চালু করা দরকার। কিছু রাজনীতিবিদের বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া উচিত। নবীন শিক্ষিত আধুনিকমনা সদস্য রিক্রুট করার দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.