নির্বাচনে একা লড়ার প্রস্তুতি জাতীয় পার্টির by মোশতাক আহমদ

একক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। এ লক্ষ্যে প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে দলটি। চলতি মাসে জেলা সফরের কর্মসূচি রয়েছে। এর আগে আজ রবিবার ঢাকায় সারা দেশের তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বসছেন এরশাদ।


সভায় আগামী সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের খসড়া তালিকা প্রণয়ন করবেন তিনি।
রাজধানীর গুলশানের একটি মিলনায়তনে সভা ডাকা হয়েছে। সভায় সারা দেশের দেড় শতাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ সভা থেকে প্রাথমিকভাবে ১১১ জন প্রার্থীর খসড়া তালিকা তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছেন এরশাদের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভ রায়। তিনি গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ১১১ জনের তালিকা করা হবে। পরে আরো দুটি সভা করে মোট ৩০০ আসনের প্রার্থীর তালিকা তৈরি করবে জাতীয় পার্টি। তবে পরবর্তী তৃণমূল সভা কখন কোথায় হবে তা জানাতে পারেননি তিনি।
জাতীয় পার্টির একটি সূত্র জানিয়েছে, একক নির্বাচনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে জাতীয় পার্টি ১০৫ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা মোটামুটি চূড়ান্ত করে রেখেছে। ওই তালিকায় ঢাকা-১৭ আসনে এরশাদের বদলে মহানগর (উত্তর) জাতীয় পার্টির সভাপতি ফয়সল চিশতীর নাম রয়েছে। এরশাদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, আগামী নির্বাচনে ঢাকার কোনো আসন থেকে প্রার্থী হবেন না এরশাদ; রংপুর, সিলেট ও কুড়িগ্রাম সদর থেকে নির্বাচন করবেন তিনি।
জানা গেছে, এইচআরসি গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু সাইদ চৌধুরীকেও ঢাকার একটি আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে জাতীয় পার্টি।
সিলেট সদর আসনে নির্বাচনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে শাহপরান মাজার এলাকায় জমি কেনা হয়েছে এরশাদের জন্য। বাড়ি তৈরির কাজও চলছে সেখানে। এসবের দায়িত্বে রয়েছেন লন্ডনপ্রবাসী এক জাপা নেতা।
সিলেট সদর থেকে নির্বাচন করার পক্ষে যুক্তি হলো- এরশাদ সেখান থেকে নির্বাচন করলে ওই অঞ্চলের সব আসনে এর প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া সিলেট সদর আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য সব প্রার্থীর চেয়ে এরশাদের অবস্থান ভালো বলে দলীয় ও গোয়েন্দা জরিপে দেখা গেছে।
সিলেট সদর থেকে যে দল নির্বাচনে জয়ী হয়, তারাই সরকার গঠন করে- প্রচলিত এ বিশ্বাস থেকে এগোচ্ছেন জাপা চেয়ারম্যান।
বছরের শুরুর দিকে টিপাইমুখ লংমার্চের সময় এরশাদ সিলেটকে তাঁর দ্বিতীয় জন্মভূমি উল্লেখ করে বলেছিলেন, 'আমি জেলে গেলে সিলেটের লোকজন লাঙ্গল মার্কায় ভোট দিয়ে আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। রংপুর আমাকে জন্ম দিলেও সিলেটের লোক আমাকে ভোট দিয়ে ফাঁসির হাত থেকে রক্ষা করে দ্বিতীয়বার জন্ম দিয়েছে।' ওই বক্তৃতায় কখনো সুযোগ পেলে সিলেটবাসীর সেই ঋণ শোধ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন এরশাদ। তিনি বলেছিলেন, 'আমি ক্ষমতায় থাকাকালে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় করিনি, করেছি সিলেটে। রংপুরে বিভাগ না করে সিলেটে বিভাগ করেছি। এ নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আগামীতে সুযোগ পেলে সিলেটের উন্নয়ন নিজ হাতে করতে চাই।'
জাতীয় পার্টি সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকার যে খসড়া তৈরি করেছে, সে অনুযায়ী এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদ দুটি আসনে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে। একটি গাইবান্ধা-৫, অন্যটি ময়মনসিংহ সদর। গত নির্বাচনেও এ দুই আসনে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। দুটি আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে হেরে যান মহাজোটেরই অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থী রওশন। পরে এরশাদের ছেড়ে দেওয়া রংপুর সদর আসন থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হন তিনি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার গত নির্বাচনে বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচিত হন। এবার তিনি বরিশাল-৩ (উজিরপুর-বাবুগঞ্জ) ও পটুয়াখালী-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান।
ঢাকা-৬ (খিলগাঁও-সবুজবাগ-মতিঝিল) আসন থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান এবং ঢাকা-৮ (ধানমণ্ডি-হাজারীবাগ-মোহাম্মদপুরের একাংশ) আসন থেকে সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ নির্বাচন করবেন। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি যেহেতু এ এলাকার বাসিন্দা, তাই এ এলাকা থেকেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়।' এরশাদের আজকের বৈঠকে ডাক পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
এরশাদের রাজনৈতিক সচিব সুনীল শুভ রায় খুলনার দাকোপ-বটিয়াঘাটা আসনে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, 'আমি ওই আসন থেকে নির্বাচন করার বিষয়ে স্যারকে (এরশাদ) জানিয়েছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনি জানাবেন।'
ফেনী-২ (সদর) আসন থেকে যুগ্ম মহাসচিব হাজি আলাউদ্দিন, ফেনী-৩ (দাগনভূঞা-সোনাগাজী) আসনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে এরশাদের প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক উপদেষ্টা রিন্টু আনোয়ারকে। এ বিষয়ে রিন্টু বলেন, 'আমি ৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে ডাক পেয়েছি।'
রিন্টু আনোয়ার জানান, ৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে ডাক পাওয়া 'এ' শ্রেণীর ১০৫ জন সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় প্রার্থী। এসব আসনের কমপক্ষে ৮০টিতে জাপার প্রার্থীরা বিজয় অর্জন করতে সক্ষম। এরপর 'বি' ও 'সি' শ্রেণীর তালিকা রয়েছে। ওই দুই তালিকায় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
বরিশাল-৩ (উজিরপুর-বাবুগঞ্জ) আসনে বতর্মান এমপি প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু ও প্রেসিডিয়াম সদস্য চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁদের দুজনকেই এখন পর্যন্ত ওই আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে।
আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গত নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান হুইপ মজিবুল হকের কাছে হেরে যান। ওই নির্বাচনে আসনটি কাজী জাফর আহমদকে ছেড়ে দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রত্যাহার করেনি।
এবার এ আসনে এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে। এ আসনের আরেক দাবিদার পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান আইসিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দিগন্ত মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক এইচ এন এম শফিকুর রহমান। তিনি কাজী জাফরের হাত ধরেই জাতীয় পার্টিতে এসেছিলেন।
চৌদ্দগ্রাম আসনের বিপরীতে আপাতত দুজনের নামই রাখা হয়েছে। পরে একজনকে অন্য কোনো আসন দেওয়া হতে পারে। কাজী জাফরকেই শেষ পর্যন্ত সরতে হতে পারে বলে সূত্র দাবি করেছে।
জাতীয় ছাত্রসমাজের সদস্যসচিব আবুল কাশেম রিপনকে জয়পুরহাট-২ (কালাই-ক্ষেতলাল-আক্কেলপুর) আসনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। আজকের বৈঠকে ডাক পাওয়া ১০৫ জনের তালিকায় তাঁর নামও রয়েছে বলে জানা গেছে। সব প্রস্তুতিই এককভাবে নির্বাচন করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
সূত্র জানায়, এবার কপাল পুড়ছে কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) আসনের এমপি এ কে এম মাইদুল ইসলাম ও গাইবান্ধা-২ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি কর্নেল (অব.) আবদুল কাদেরের। এলাকায় না যাওয়া এবং জনবিছিন্ন হয়ে পড়ায় তাঁদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না। কর্নেল কাদেরের আসনে সাবেক এমপি ওয়াহিদুজ্জামান বাদশা এবং মাইদুল ইসলামের আসনে সাবেক এমপি মতিউর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
এরশাদের ভাই জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের নির্বাচন করবেন লালমনিরহাট সদর অথবা পাটগ্রাম-আদিতমারী থেকে। নীলফামারীর জলঢাকা-কিশোরগঞ্জ আসনটিও জি এম কাদেরের বিকল্পের তালিকায় রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
একক নির্বাচন ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকার বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতীয় পার্টি একক নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে চলেছে। এ জন্য আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে ধারণা নিতে আজকের তৃণমূল সভা ডাকা হয়েছে। একক নির্বাচনের বিষয়ে চেয়ারম্যান এরশাদ তৃণমূল নেতাদের দিকনির্দেশনা দেবেন বলে তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.