অভিজাত আবাসিকের একি হাল!

ভাঙা সড়ক, জলাবদ্ধতা, আবর্জনার দুর্গন্ধ, চোরের উৎপাতের মধ্যে দুঃস্বপ্নের মতো দিন কাটাচ্ছেন চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ। অথচ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোর অন্যতম এটি। কিন্তু সেখানে এখন আভিজাত্যের ছিটেফোঁটাও নেই।
এই নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন আশরাফ উল্লাহ

ভাঙা সড়কে কষ্টে চলাচল
সড়কের কোথাও পিচ নেই। ইট-সুরকি পর্যন্ত উঠে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এর মধ্যে অসংখ্য বড় বড় গর্ত। শেষ প্রান্তের গর্তটি রীতিমতো জলাশয়ে রূপ নিয়েছে। কমপক্ষে ১৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এ গর্তে সারা বছর জমে থাকে পানি। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বি-ব্লকের ১৪ নম্বর সড়কের বাসিন্দাদের নিত্যদিন এ ভোগান্তি সয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।
শুধু ১৪ নম্বর নয়, আবাসিকের ১৫টি সড়কের মধ্যে ১১টির এমন ক্ষতবিক্ষত চেহারা। ১৪ নম্বর সড়কের জুমাইরা অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সড়কগুলোর অবস্থা এক দিনে এমন হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়াই এর কারণ। প্রতিদিন চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার ভবন নির্মাণের মালামালবোঝাই ট্রাক চলাচল করে ১৪ নম্বর সড়ক দিয়ে। অথচ এটি সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেই। কোনো কোনো সড়ক আছে যেগুলোতে গত ১০ বছরের মধ্যে হাত দেয়নি সিটি করপোরেশন।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ঢুকতে-বেরোতেও যন্ত্রণা। বহদ্দারহাট উড়ালসড়কের কাজ চলায় যানজট নিত্যসঙ্গী। তার ওপর আবাসিক এলাকায় ঢোকার মুখ পর্যন্ত ভাঙাচোরা সড়কে চলে ধুলাবালুর অত্যাচার। অবস্থা এমন যে, একবার চলাচল করলে গায়ে ধুলার আস্তরণ পড়ে। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা যায়, গত বছর সিটি করপোরেশন দুই কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি সড়ক পুরোপুরি ও দুটি সড়ক আংশিক সংস্কার করে। সড়কগুলো হলো ৩, ৪, ৭, ৮/এ, ৮ এবং ১১ নম্বর। এগুলো ছাড়া অন্য সব সড়ক খানাখন্দে ভরা।
সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, ‘বারবার সিটি করপোরেশনে চিঠি দিয়েছি সড়ক সংস্কারের জন্য। কিন্তু কাজ হয়নি। করছি, করব বলে সময় পার করছে। আরাকান সড়ক থেকে আবাসিক এলাকার সংযোগ সড়কটির অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, তার পরও এখনো কাজ শুরু হয়নি।’ এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প না থাকলেও জরুরি ভিত্তিতে সড়কগুলো চলাচলের উপযোগী করতে দ্রুত মেরামত করা হবে। এত দিন বৃষ্টির কারণে কাজ করা সম্ভব হয়নি। সংযোগ সড়কের কাজও শিগগির শুরু হবে।

নতুন আতঙ্ক জলাবদ্ধতা
সরেজমিনে দেখা গেছে, আবাসিক এলাকার পানি নিষ্কাশনের ১৩ নম্বর সড়কের প্রধান নর্দমাটি আবর্জনায় ভর্তি। নর্দমার গভীরতাও নেই। শেষ প্রান্তে এসে সব আবর্জনা জমে আছে। পাশের দোকানের অবকাঠামোও গড়া হয়েছে নর্দমার পাশ ঘেঁষে। এদিকে, আবাসিকের পাশে খতিববাড়ি এলাকার কিছু স্থাপনাও গড়ে উঠেছে নর্দমা দখল করে। বাসিন্দারা জানান, সামান্য বৃষ্টিতে সড়কে জমে যায় হাঁটু সমান পানি। এমনকি মুষলধারে তিন-চার ঘণ্টা বৃষ্টি হলে বেশির ভাগ বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ে। যা আগে কখনো হয়নি। গত বর্ষা থেকে জলাবদ্ধতা বেড়েছে।
চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম বলেন, ‘পানি নিষ্কাশনের মূল নর্দমাটি ঠিকভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। কারণ, নর্দমা ঘেঁষে এমনভাবে ভবন তৈরি করা হয়েছে, যেখানে এক ফুট জায়গাও রাখা হয়নি। এ ছাড়া ছোট নালাগুলো অনেক ভবনমালিক দখল করে বাগান কিংবা অন্য অবকাঠামো করেছেন। ফলে বৃষ্টি হলেই পানি জমে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে অনেক ভবনমালিককে এগুলো সরানোর জন্য নোটিশ দিয়েছি।’

চোরের উৎপাত
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা জানান, চোরের উৎপাত লেগেই আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঝামেলা এড়াতে থানায় অভিযোগ করেন না বাসিন্দারা। আর এসব চুরি হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের বাসায়। ফলে তাঁরা থানায় অভিযোগে আগ্রহ দেখান না।
সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী জানান, দুই মাস ধরে চোরের উৎপাত কমে এসেছে। এ ব্যাপারে চান্দগাঁও থানা সহযোগিতা করছে। তারা টহল জোরদার করেছে।
এ প্রসঙ্গে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাবুলচন্দ্র বণিক বলেন, চোরের উৎপাত আগে ছিল, এখন আর নেই। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রতিদিন থানার একটি টিম টহলে থাকে।

খেলার মাঠ ভাড়া!
কল্যাণ সমিতির কার্যালয়ের সামনেই দেখা গেল একটি ব্যানার টানানো, তাতে লেখা ‘খেলার মাঠ নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করুন’। চান্দগাঁও সোসাইটি ক্লাবের পক্ষে টাঙানো হয় এই ব্যানার।
ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম বলেন, খেলার একমাত্র মাঠটি এখন দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। মাসের কমপক্ষে ১০ দিন মাঠে খেলতে পারে না ছেলেরা। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের জন্য প্যান্ডেলের বাঁশের খুঁটি গাড়ার জন্য যেসব গর্ত করে সেগুলো ভরাট করে দেয় না। ফলে খেলতে গিয়ে প্রায় সময় ছেলেরা আহত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, সমিতি ভাড়া দেওয়ার বিধান চালু করেছে মূলত মাঠটি রক্ষার জন্য। কারণ, সবাই মাঠটি ব্যবহার করতে চায়। তাই সবাই যাতে গণহারে মাঠ ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য এ ব্যবস্থা। তবে খেলাধুলার জন্য মাঠ সব সময় উন্মুক্ত। কোনো গর্ত হলে সমিতি তা ভরাট করে দেয়।

বিড়ম্বনার ডাস্টবিন
বাসিন্দারা জানান, ঢোকার মুখে ডাস্টবিনটার বিড়ম্বনা সব সময়। প্রায় সময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ১৪ নম্বর সড়কের মুখ পর্যন্ত। সরেজমিনে দেখা গেছে, বড় ডাস্টবিনটার ভেতরে ময়লা-আবর্জনা উপচে আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে তিনজন টোকাই আবর্জনা ঘেঁটে জিনিসপত্র খুঁজছে। লোকজন চলাফেরা করছে নাকে রুমাল চেপে।
অভিযোগ রয়েছে, ডাস্টবিনটি মাসিক ছয় হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়েছে ভাঙারির দোকানিদের কাছে। তাঁরা টোকাইদের দিয়ে আবর্জনা ঘেঁটে সেখান থেকে ফেলে দেওয়া বোতল, টিনের কৌটাসহ নানা জিনিসপত্র খুঁজে বের করেন। তাঁদের ঘাঁটাঘাঁটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে আবর্জনা।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম জানান, টোকাইরা ময়লা-আবর্জনা ঘাঁটাঘাঁটি করায় ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে পরিচ্ছন্নকর্মীদেরও বেগ পেতে হয়।
ডাস্টবিন ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ডাস্টবিন ভাড়া দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

No comments

Powered by Blogger.