স্মরণ- বড় ভালো মানুষ ছিলেন তিনি by আখতার হুসেন

প্রথম আলোর সাবেক সহকারী সম্পাদক এ টি এম হাই-এর একাদশতম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। চিত্রালীর উত্তরদা হিসেবেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। ২০০১ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
হাই ভাই।

এ টি এম আবদুল হাই নামেই যিনি তাঁর বন্ধুমহলে পরিচিত ছিলেন, তাঁকে আমরা একেবারে ঘরের মানুুষ হিসেবে পেয়েছিলাম ১৯৭০ সালের শেষের দিকে।
চাকরিসূত্রেই আমরা আগে-পরে করে জুটেছিলাম সেকালের সোভিয়েত দূতাবাসের প্রেস ইনফরমেশন বিভাগে। তাঁর অবস্থান ছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বিপরীত দিকে লেকের পাড় ঘেঁষে। বিভাগটির একই কামরায় আমরা বসতাম। এর প্রধান ছিলেন কবি শহীদ কাদরি, তাঁর পরবর্তী পদাধিকারী ছিলেন হাই ভাই। আর সাধারণ প্রজার মতো তথাকথিত অনুবাদ-সম্পাদক ছিলাম আমি, নুরুল ইসলাম এবং স্বাধীনতার পরে এসে জোটেন এখনকার দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর। জমজমাট ছিল আমাদের ছোট্ট সেই বিভাগটি। শহীদ ভাইয়ের জলদগম্ভীর গমগমে গলার গল্প শুনে আমরা হেসে কুটিকুটি হতাম। হাই ভাইকে যে আগে থেকে জানতাম না, তা নয়। সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালীর সূত্রেই জানতাম। মানুষটি যে তলে তলে দেশব্যাপী জনপ্রিয় ছিলেন, তার প্রমাণ পেতে শুরু করি ধীরে ধীরে। আর সেটা হয় শহীদ ভাই কী এক অভিমানবশত আমাদের বিভাগ থেকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর যখন তাঁর জায়গায় প্রধান হয়ে বসলেন হাই ভাই, ঠিক তখন থেকে। সোভিয়েত তথ্য বিভাগে চাকরি করলেও হাই ভাই সপ্তাহে দুই দিন চিত্রালীতে যেতেন। ‘আপনাদের চিঠি পেলাম’ নামের যে বিভাগ ছিল, তাতে, তার পরিচালনার কাজে। বড় রসাল করে পাঠকদের চিঠির জবাব দিতেন তিনি। তথ্য বিভাগের কাজ শেষে এ রকমই একদিন চিত্রালীতে আমাকে রিকশায় চাপিয়ে নিয়ে যান। সালটা একাত্তরের প্রথম ভাগ। চারদিক উত্তাল। অবজারভার ভবনের দোতলা কি তিনতলার ঘরে গিয়ে তাঁর আসনের পাশে আমাকে বসিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। চা-শিঙাড়া আসে। চিঠির জবাব একমনে লিখতে লিখতে একটা চিঠির প্রশ্নে তিনি ঠেকে যান এবং আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আখতার, বড্ড ঠেকে গেলাম যে! এ রকম ঠেকা এর আগে ঠেকিনি।’ আমি বলি প্রশ্নটা কী? হাই ভাই বলেন, ‘প্রশ্নকর্তা বলেছেন, কিশমিশ কখন টক হয়?’ আশ্চর্য প্রকৃতির প্রশ্ন! কিন্তু হাই ভাইয়ের মাথা ছিল রসে টইটম্বুর। দু-চার মিনিট ভেবে হঠাৎই ‘ইউরেকা’ বলে প্রায় চাপা চিৎকার করে ওঠেন, ‘পেয়ে গেছি।’ তারপরই লিখলেন, ‘কিস যখন মিস হয়।’ আমিও তাঁর জবাবের প্রভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠি। হাই ভাই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের আমাদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বহু ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী ছিলেন। প্রায়ই বলতেন সৈয়দ শামসুল হকের ঢাকায় সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বের সংগ্রামের কথা, বলতেন রশীদ হায়দার ও খালেদ চৌধুরীর কথা। আমি একবার তাঁকে বলেছিলাম, হাই ভাই আপনার স্মৃতিকথা লিখুন। প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন তিনি লিখবেন বলে। কিন্তু অকালমৃত্যু তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি।
ভৈরবের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান তিনি। বিয়ে করেছিলেন আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ভালোবাসার বিয়ে। তিনি দুই ছেলে, দুই মেয়ের জনক। প্রত্যেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাই ভাই আর আমি ভয়ানক বিপদে পড়েছিলাম। আগস্ট মাস। সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্য বিভাগের ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে তখন কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত অনেক কিছু আসত। এ রকমই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাগজ কোথাও কোনো ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য সোভিয়েত তথ্য বিভাগের তখনকার বাঙালিপ্রধান এ টি এম শামসুদ্দিন হাই ভাইয়ের হাতে তুলে দেন। গোপনীয় বলে সাবধানে বহন করতে হবে। তখন পথের মোড়ে মোড়ে পাকিস্তান বাহিনীর কড়া চেকপোস্ট। এই অবস্থার একটা সুরাহা করার জন্য চলে যাই নারিন্দায়। আমার পরিচিত এক বাসায়। যে বাসায় ছিল কলের গান এবং ভালো বাংলা ও উর্দু রেকর্ডের সংগ্রহ। সে বাসার কর্তাকে বলেকয়ে পাকিস্তানি গায়িকা নুরজাহানের একটা লংপ্লের রেকর্ড নিয়ে আসি। সেই রেকর্ডের কভারে ভরে ফেলি গোপনীয় কাগজটা। তারপর দুজন রিকশায় চেপে ধানমন্ডি থেকে রওনা দিই। ওমা, পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে! ঢাকা ক্লাবের লাগোয়া চেকপোস্টের কাছে আসতেই আমাদের রিকশার গতিরোধ করে পাকিস্তানি সেনারা। আমার কোলের ওপর তখন নুরজাহানের ছবিসংবলিত লংপ্লের কভার। ভেতরে ডিস্ক আর সেই গোপন কাগজ। গতিরোধ করতেই শুরু হয়ে যায় বুকের ঢিপঢিপানি। কিন্তু না, বিপদ কেটে যায় মুহূর্তেই। যে দুজন মিলিটারি আমাদের রিকশার কাছে এগিয়ে আসে, তাদের চোখ রেকর্ডের কভারের ওপরে পড়তেই বলে ওঠে, ‘ও, মালেকায়ে তারান্নুম! বহুৎ আচ্ছা। যাও যাও।’
আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। হাই ভাইকে তাঁর বাসার কাছাকাছি এসে ছেড়ে দিই। নুরজাহানের লংপ্লে নিয়ে ফিরে আসি বাসায়।
হাই ভাইকে কাঁদতে দেখেছিলাম সেদিন অঝোরে, যেদিন তিনি খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছিলেন।
জার্মানির হ্যানোভারে ১৯৮০ সালের দিকে দেখা হয় সূর্যস্নান ও রূপবান ছবির পরিচালক সালাহউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। প্রথম জীবনে তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। হ্যানোভারে গিয়েছিলেন তাঁর ‘ঢাকা রেকর্ডস’-এর কাঁচামাল কেনার জন্য। তিনি আমাকে এই প্রথম দেখছেন। হাই ভাইয়ের তিনি শিক্ষক ছিলেন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে। আমি সালাহউদ্দিন সাহেবের কাছে এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময়ের পর হাই ভাইয়ের কথা বলতেই তিনি বলতে লাগলেন, ‘হাই আমার প্রিয় ছেলেদের একজন ছিল। ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যমণি। আমি যখন সূর্যস্নান বানাই, সে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। চিত্রালীতে প্রচার দিয়ে। স্টিল ছবি ছেপে। ও সত্যিই ভালো ছেলে।’
শিক্ষকের কাছ থেকে ছাত্রের এ ধরনের প্রশংসার পর আমার আর কী লেখার থাকতে পারে! হাই ভাইয়ের আত্মা চিরশান্তি পাক।
আখতার হুসেন

No comments

Powered by Blogger.