জোসনার জীবনে অন্ধকার by তানজিম আল ইসলাম

মেয়েটির নাম জোসনা। খুব নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা বেঁচে নেই। দুই বোনের মধ্যে বড় তিনি। ১৯৯৭ সালে শরীফ খানের সঙ্গে বিয়ে হয়। অবশ্য এটি তাঁদের প্রেমের বিয়ে। তাঁদের ঘরে রয়েছে এক মেয়ে ও এক ছেলে। বিয়ের কয়েক বছর যেতে না যেতে জোসনার আলোকিত জীবনে ভর করে অন্ধকার।


স্বামীর কাছ থেকে অনেক দিন ধরে কোনো ভরণপোষণ পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়েরও কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না স্বামী। তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে থাকছেন পুরান ঢাকার একটি এলাকায়। মা গ্রামের বাড়ির গাছ বিক্রি করে জোসনা ও দুই সন্তানের খরচ মেটাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে আর কত দিন চলবে? বড় মেয়েটির বয়স ১২ বছর। টাকার অভাবে স্কুলেও যেতে পারছে না। বারবার স্বামীকে অনুরোধ করছেন। কিন্তু স্বামী তাঁর কোনো অনুরোধেই কান দিচ্ছেন না। জোসনার প্রশ্ন, কেন এই পরিণতি তাঁর? তাঁর এখন কোথাও আশ্রয় নেই। কিছুদিন আগে প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে তাঁর অসহায়ের কথা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন জোসনা। তাঁর হাতে ও মুখমণ্ডলে জখমের চিহ্ন। তিনি জখমগুলো দেখিয়ে বর্ণনা করেন তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতনের কাহিনী। জোসনার ভাষায়—‘আমার স্বামীকে তার পছন্দমতো কাজ করতে বাধা দিলে শুরু হয় নির্যাতন।’ কী কাজে বাধা দিতেন? ‘আমার স্বামী বিয়ের কয়েক বছর না যেতেই বদলে যেতে থাকে। আমার জন্মবৈধতা নিয়ে অপবাদ দিতে থাকে। বলে আমার নাকি জন্মপরিচয় ঠিক নাই। শুরু থেকে অনেক মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকে আমার স্বামী। আমি এসব করতে বাধা দিতাম। আমি সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেও যেতাম। বছরখানেক ধরে সে সম্পূর্ণই বদলে যায়।’
গত জুন মাসে তাঁর স্বামী তাঁকে পাশবিকভাবে নির্যাতন করে। পরে এ বিষয়ে তিনি সাধারণ ডায়েরি করেন থানায়। জোসনার অভিযোগ, বিয়ের পরই তাঁর জমানো কিছু টাকা ও গয়নাগাটি তাঁর স্বামীর হাতে তুলে দেন ব্যবসার জন্য, স্বামীর ভালোর জন্য। এর পরও মাঝেমধ্যে আরও টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। গ্রামের বাড়ির বাবার লাগানো গাছ বিক্রি করে দুই লাখ টাকা এনে দিতে বলে। জোসনা পারেন না স্বামীর এ আবদার মানতে। গত জুলাই মাসে এসে জোসনার ওপর আবার অত্যাচার করে এবং তাঁর মায়ের হাত ভেঙে দেয়। জোসনার বিলাপ শুনেও ক্ষান্ত হয়নি তাঁর স্বামী। কোনো ভরণপোষণ না দিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের একা ফেলে রেখেছে। জোসনা ও তাঁর সন্তানেরা মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। জোসনার অভিযোগ নিয়ে ফোনে কথা হয় স্বামী শরীফ খানের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর ভাড়া বাসাতেই জোসনা থাকছেন। কেন তিনি স্ত্রীকে নির্যাতন করছেন—এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটি জোসনাকেই জিজ্ঞেস করেন। পরকীয়া সম্পর্কের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এ নিয়ে পারিবারিকভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রী আমার নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে।’ আপনি এখন কী চান? স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে চান না? ‘সেটা নিয়ে ভাবিনি। আমি যখন তার সঙ্গে সম্পর্ক করি এবং বিয়ে করি, তখন সে রাস্তার মেয়ে ছিল। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি।’ আপনার ছেলেমেয়েরা তো ভালো থাকতে পারছে না। ‘আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘এর আগেও অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন দিয়েছেন। আপনি যদি লিখে কিছু করে দিতে চান জোসনাকে, তা করে দিতে পারেন।’ আপনি তো আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিতে পারছেন না। সাফ জবাব ‘কী আছে না আছে এটা তাকেই জেরা করেন।’ আপনি তো তাঁকে এবং সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে আইনত বাধ্য। ‘তা আমি দিচ্ছি। কিছুদিন আগেও পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি। আমার ঘরে সে থাকবে কি থাকবে না, এটি তার ব্যাপার।’ আপনি এখন কোথায় আছেন? ‘বলা যাবে না।’ কেন? ‘কারণ, আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে আমার স্ত্রী। বললে পুলিশ জেনে যাবে।’
জোসনাকে জিজ্ঞেস করি কী মামলা করেছেন? ‘ছেলেকে অনেক দিন আটকে রেখেছিল তার কাছে, ছেলেকে উদ্ধারের জন্য থানায় গেছি। আমাকে মারধর করেছে এবং কিছু গয়নাগাটি নিয়ে গেছে এ অভিযোগও করেছি।’
জোসনার মায়ের বয়স হয়ে গেছে। জোসনা চেষ্টা চালাচ্ছেন কিছু একটা করে খাওয়ার জন্য। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে চান তিনি। দুবেলা কোনোভাবে খেয়েদেয়ে বাঁচতে চান তাঁরা। কিন্তু জোসনার যে পড়াশোনা অল্প। এ দিয়ে কী কাজ জুটবে? পোশাক কারখানায় কাজ মিলবে? নাকি বাসায় বাসায় বুয়ার কাজ করবে?নাকি তরকারি বিক্রি করবে? জোসনা বুঝতে পারছেন না। তবে স্বামীর কাছ থেকে তাঁর এবং সন্তানদের অধিকার আদায়ে তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। জোসনার আকুতি ‘আমি অসহায়, আমি এ দেশের সরকারের কাছে বিচার চাই। আমি ও আমার সন্তানদের বেঁচে থাকার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দেন।’
জোসনাদের জীবন সত্যিই অনেক অন্ধকারে ভরা...।
tanzimlaw@yahoo.com

কী করণীয়
জোসনার কাহিনি শুনে আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান বলেন, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ না পান এবং নাবালক সন্তানদের ভরণপোষণ না পান, তা হলে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন একজন স্ত্রী। সহকারী জজ আদালত পারিবারিক আদালত হিসেবে বিচার করে থাকেন। স্বামী স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রতিকার চাইতে পারেন অথবা যৌতুক নিরোধ আইনেও প্রতিকার চাইতে পারেন। থানায় অভিযোগ এজাহার হিসেবে দায়ের করতে হবে। যদি এজাহার হিসেবে থানায় মামলা না নেয়, তা হলে নালিশি মামলা হিসেবে আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। সহায়সম্বলহীন নারীরা সরকারি আইনি সহায়তা পেতে পারেন অথবা বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলোতে যোগাযোগ করলে বিনা খরচে এখান থেকে আইনি সহায়তা পেতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.