বৈদেশিক বাণিজ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ডেনমার্ক

ইউরোপের অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে ডেনমার্কের জন্য আশার বাণী হলো দিন দিন এই দেশটিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার এই দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এক সময় অনেক ভালো থাকলেও সমগ্র ইউরোপজুড়ে যে ঋণ সঙ্কট ও ইউরো সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রভাব ডেনমার্কের ওপর ভালভাবেই


পড়েছিল। এমনিতেই ডেনমার্কের শ্রমিকদের অত্যধিক মজুরি ও তুলনামূলক নিম্ন উৎপাদনশীলতার কারণে বিশ্ব বাণিজ্যে অনেক বছর ধরে ‘প্রতিযোগিতা সক্ষমতায়’ পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এই অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে ডেনমার্ক। ডেনমার্কের বৈদেশিক বাণিজ্য অনুকূলভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে খবরটি তাই আশাব্যঞ্জক। সমসাময়িক তথ্য-উপাত্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে ডেনমার্ক তা কাটিয়ে উঠছে। বিশেষ করে সম ক্যাটাগরির প্রতিযোগী দেশসমূহের মধ্যে ডেনমার্কের অবস্থান ভাল হচ্ছে।
পলিটিকেন পত্রিকার সঙ্গে সোশ্যালিস্টিস্ক ফোলকেপারটি হতে নির্বাচিত ব্যবসা এবং উন্নয়নমন্ত্রী ওলে সোহান এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যধিক আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই না, যদিও বেশ কিছু পজিটিভ চিত্র আমাদের কাছে আছে, যা আমরা চাইলে সেলিব্রেট করতে পারি। বিশ্ব বাণিজ্য ডেনমার্কের অবস্থান ভাল হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই দেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। এই দেশটির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুইডেন এবং জার্মানিতে শ্রমিকের মজুরি এই দেশটির তুলনায় তাড়াতাড়ি বাড়ছে যা ডেনমার্ককে এই দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ এনে দিয়েছে। তাছাড়া ডেনমার্কের শ্রমিক উৎপাদনশীলতা বাড়ছে যার কারণে বিশ্ব বাণিজ্যে এ দেশের বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় শক্তি ও সামর্থ্য বেড়েছে আর যার পরিণতিতে রফতানি বাণিজ্যে ক্রমাগত বাড়ছে।
মন্ত্রী সোহান বলেন, ’৯০-এর দশকের শেষ দিক হতে ডেনিশ প্রতিযোগিতাসূচকের নিম্নগামিতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়, কিন্তু সার্বিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে আমরা এ দিকটিকে বিবেচনায় নেইনি। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কমে এসেছে তাই শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার ওপর জোর দিচ্ছে ডেনমার্ক সরকার। শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাটো করতে শুরু করে আর সে সঙ্গে এরা শ্রমিকদের সঙ্গে মজুরি চুক্তি করতে শুরু করে যা তুলনামূলক প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম মজুরিতে। এর ফল হিসেবে গত ২০০৯ সালের পর হতে আমাদের ‘প্রতিযোগিতা সক্ষমতায়’ পজিটিভ টার্নিং প্রথম পরিলক্ষিত হতে শুরু হয়।’ ডেনমার্কের বৈদেশিক বাণিজ্যকে আরও ভাল অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উচিত সরকারকে সহায়তা করা যাতে সরকার যথাযথ অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করতে পারে যা ডেনমার্কের ব্যবসা ও পণ্যে আন্তর্জাতিক আস্থা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। বর্তমানে ডেনমার্কের প্রতিযোগিতা সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন আসলেও এই দেশটিতে এখনও বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। ডেনমার্কে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখের ওপর লোক বেকার জীবনযাপন করছে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, ‘ইউরোপের দক্ষিণের দেশসমূহে অর্থনীতির সঙ্কটের কারণে আমাদের রপতানি সে সব দেশসমূহে কমেছে, তারপর ও আমরা তুলনামূলকভাবে বেকারত্বের অবস্থান স্থির রাখতে সমর্থ হয়েছি। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আমদের দেশটা ছোট, যেখানের অর্থনীতি উন্মুক্ত এবং আমাদের অন্যদেশে কি হলো না হলো তার ওপর নির্ভর করতে হয়, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আর এ সময়ে আমরা যদি আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা না বাড়াতে পারতাম, এবং সরকারী অর্থনীতির এজেন্ডাগুলোকে না শুরু করতাম তাহলে বেকারত্ব আরও খারাপ অবস্থায় নিপতিত হতো।’ ডেনমার্কের বিশ্ববাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি সর্বমহলে সাধুবাদ পেয়েছে, সে সঙ্গে সবাই বলেছে এ ক্ষেত্রে এখনো আরও অনেক কিছু করার আছে। নরডিয়া ব্যাংকের চীফ ইকোনমিস্ট হেলগে পেডারসেন বলেন, ‘প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি শুভ লক্ষণ, কিন্তু আমাদের আরও ভাল করতে হবে যদি আমরা জিডিপি পার ক্যাপিটায় বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে একটি থাকতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের উচিত ডেনিস কোম্পানিসমূহকে এজন্য সাধুবাদ জানানো যে, তারা নতুন নিয়োগ না দিয়ে, মজুরি বৃদ্ধি না করেই নিজস্ব উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে।’ বামমুখী সুশীল সংগঠনের লারস এন্ডারসেন বলেন, তিনি নিজেও পেডারসেনের আশা ও সাবধান বাণীর সঙ্গে একমত। সে সঙ্গে যোগ করেন, ‘অর্থনৈতিক সংখ্যা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আমাদের সতর্ক হতে হবে এবং আমাদের এর কারণ ও এর ভবিষ্যত নিয়ে গঠনমূলক হতে হবে। আমরা দেখলাম আমাদের কোম্পানিসমূহের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে স্বভাবতই দক্ষ ব্যবসা ও শিল্পকারখানা টিকে থাকবে এবং তাদের ক্ষেত্র বিস্তৃৃত হবে। কিন্তু সে সঙ্গে আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলব, আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি প্রয়োজন, যাতে করে আমরা স্থানীয়ভাবে আরও পণ্যাদি কেনার সামর্থ্য সম্পন্ন হই যা পুনরায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করবে।
লিবারেল সুশীল সংগঠন সিপোসের পরামর্শক অর্থনীতির এ সাফল্যকে ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র কোম্পানিসমূহের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে ২০০৮-২০০৯ সালে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপর আর আমরা এ লক্ষণের ব্যাপ্তি দেখিনি। ২০০৯-২০১০ এ এসে বিনিময় হারে ধস এবং ইউরো জোনের ক্রাইসিস ডেনিশ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মূল কারণ বলে আমরা মনে করি। এ জন্য সরকার কিছু করছে কিংবা ভূমিকা রেখেছে বলে আমরা মনে করি না।’
মন্ত্রী সোহান অবশ্য তার মতামতে বলেছেন, ‘এ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মূলত নড়বড়ে। আর তাই তার সরকার প্রস্তাব করেছে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়সমূহের সামর্থ্য বৃদ্ধি করার।’ ছোট ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানই মূলত জব তৈরি করতে সক্ষম। বড় প্রতিষ্ঠানসমূহ মূলত আউটসোর্স করে দেশের বাইরে থেকে, তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রকৌশল ও কামার শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সরকারের সাহায্যের হাত বাড়ানো উচিত। যদি এটি করা যায় তবে ডেনমার্কের অবস্থা আরও ভাল হবে।
ডেনমার্কের বিশ্ব বাণিজ্যের প্রতিযোগিতার সূচকে এগিয়ে আসাটা সেই দেশের জন্য আশাব্যঞ্জক। যদি ডেনমার্ক সরকার ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয় এবং শ্রমিকদের মজুরি সীমা নির্ধারণের পরেও শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি করতে পারে তবে ডেনমার্ক বিশ্ববাণিজ্য নিজের অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
এম এ রহমান

No comments

Powered by Blogger.