সদরে অন্দরে-অশান্তির বীজ রোপিত হলো বুয়েটে by মোস্তফা হোসেইন

বুয়েটের আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি এখনো। এই লেখা প্রকাশের আগে যদি শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যান কিংবা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাহলেও কি নিভে যাবে? জবাবের জায়গায় বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নকেই দেখা যায়। এই প্রশ্নবোধক চিহ্নের কারণ, সেখানে রোপিত হওয়া অশান্তির বীজ। অশান্তির বীজ থেকে নিশ্চিত গাছ জন্মাবে।


সেই গাছ কখনো বুয়েটের সুশীতল সবুজ গাছের সঙ্গে মানানসই হবে না। কাঁটা বিছিয়ে সেরা শিক্ষার্থীদের বিচরণক্ষেত্রটিকে কলুষিত করবে। সেই ক্ষেত্র রচনার কাজটি করেছেন একজন সম্মানীয় শিক্ষক। যিনি আবার এই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী ছিলেন একসময়। এখানকার নিয়মকানুন মেনে ও দেখে শিক্ষক হয়েছেন। আবার শিক্ষক হিসেবেও এই প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন। এমন একজন বিজ্ঞ মানুষকে নিয়ে আজকে বুয়েটে এই উত্তাল অবস্থা তৈরি হলো কেন? বিশদ আলোচনা হয়েছে ইতিমধ্যে। যৌক্তিক দিক বিচার্য অবশ্যই। প্রশ্ন হচ্ছে দাউ দাউ করে যে আগুন জ্বলছে তা নেভানোর জন্য সরকারি উদ্যোগ নিয়ে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বেশ কিছু সাফল্যের প্রমাণ রেখেছেন। সংগত কারণেই বুয়েট সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে সাফল্যজনক কিছু প্রত্যাশিত। আশা করা গিয়েছিল চার মাস আগে যখন বুয়েটের শান্তির কুঠুরিতে আগুন লাগে তখনই দ্রুত বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করা হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলতে পারেন। বলতে পারেন, স্বায়ত্তশাসনের কথা বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী একপর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার কথাও বলেছিলেন। সবই সত্য, এর পরও কথা হচ্ছে- সরকারি দলের সমর্থক বর্তমান উপাচার্য যেভাবে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছেন এবং পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন তাতে কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী একসময় শিক্ষক সমিতিকে দোষারোপ করেছেন- প্রচারমাধ্যমে জানতে পেরেছি। কালক্ষেপণ না করেই শিক্ষক সমিতি তাঁকে সম্মান জানিয়ে তাদের কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করেছে। কিন্তু এরপর কি তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন? দেখা গেল, কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে তিনি বিরত রইলেন।
সর্বশেষ তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। অথচ এটা অনেক আগেই করতে পারতেন। এর পরও আশার কথা, মন্ত্রী উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিষয়টিকে মীমাংসা করার জন্য তিনি রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। শিক্ষার্থীদের তিনি বলেছেন, বুয়েটে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য যা প্রয়োজন এর সবই তিনি নিশ্চিত করবেন। অত্যন্ত সুন্দর কথা। তিনি আরো বলেছেন, সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারো ওপর যাতে শারীরিক, একাডেমিক কিংবা মানসিক হয়রানি না হয় সেদিকেও নজর দেওয়া হবে। তাঁর দুটো বক্তব্যই বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি। কিন্তু সম্পূর্ণ উহ্য রয়ে গেছে, ভিসির পদত্যাগের বিষয়টি। তিনি বলে দিতে পারতেন, ভিসি সাহেবের সম্মানজনক বিদায়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও। এতে দুই পক্ষই বেঁচে যেত। অথবা ভিসি সাহেবকে আলাদাভাবে বলতে পারতেন, আপনি সরে গিয়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করুন। এ দায়িত্ব এখন সরকারের ওপর। কারণ ইতিপূর্বে ভিসি নিজেই বলেছেন, সরকার বললেই তিনি পদত্যাগ করতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে- তাঁরা শিক্ষকদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। তাঁরা শিক্ষামন্ত্রীকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছেন। সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য। এতে প্রতীয়মান হয়, মন্ত্রী মহোদয় যখনই ডাক দিয়েছেন কিংবা উদ্যোগ নিয়েছেন তখনই বুয়েটের শিক্ষক সমিতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই তাঁকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষক, শিক্ষক নেতা ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের মুখ থেকেই যে ভাষা উচ্চারিত হয়েছে তাতে সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি যে উপাচার্যের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ, সেই উপাচার্যকেও সম্বোধন করাকালে তাঁরা স্যার শব্দটি প্রয়োগ করতে কার্পণ্য করেননি। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তাঁরা নিজের গা থেকে রক্ত বের করে ভিসি অফিসের সামনে ঢেলে দিয়েছেন কিন্তু কোনো রক্তপাত করেননি। আন্দোলনরত শিক্ষকদের মারমুখী কিংবা জঙ্গি হতে দেখা যায়নি। নিকট অতীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আন্দোলনকালে যেভাবে ধর-মার পরিস্থিতি দেখা গেছে বুয়েটের উত্তাল আন্দোলনেও তা দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের তারুণ্য কিছু উচ্ছৃঙ্খলতার জন্ম দেওয়াটা স্বাভাবিক মনে হলেও তাঁদের মধ্যেও সম্মানবোধের কোনো ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি। দরজায় লাথি দেওয়ার মতো কাজটি চোখে পড়েছে সবার। সেখানেও বহিরাগতদের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওই জঙ্গিরূপী তরুণরা ছিল ছাত্রলীগ নামধারী কিছু তরুণ। যাদের একজন বুয়েটের শিক্ষার্থী দাবি করে বলেছে, সে 'কমার্স'-এর ছাত্র।
আজকে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে বুয়েটের গা থেকে ক্যান্সার দূর করার গুরুদায়িত্বই শিক্ষার্থীদের ওপর পড়েছে। কারণ শিক্ষক সমিতি অনিবার্য কারণে আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে বিষফোড়া সরানোর ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কী হবে, বুয়েটের ভবিষ্যৎ কী হবে এর অনেকাংশই এখন এই শিক্ষার্থীদের ওপর নির্ভর করে।
এ ক্ষেত্রে কেউ প্রশ্নই করতে পারেন, ভিসির প্রশাসনিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কেন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এর জবাবও শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে পাওয়া গেছে। সর্বোপরি বাস্তবতা হচ্ছে, উপাচার্য শুধু প্রশাসনিক কার্যক্রমই পরিচালনা করেন না, তাঁকে একাডেমিক কার্যক্রমও পরিচালনা করতে হয়। সুতরাং সেই অজুহাত দিয়ে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। উপাচার্যকে তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সমূলে আগাছা ধ্বংসের পথ তিনি করে যাবেন কি না।
তিনি যদি চলেও যান, এর পরও তাঁকে কিছু বিষয়ের কলঙ্ক অবশ্যই বয়ে বেড়াতে হবে। কারণ তিনি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে বুয়েটের সবুজ গাছগুলো হয়তো অধিক ছায়া ছড়াবে। কিন্তু আগাছা জন্মানোর জায়গাটিতে বড় অক্ষরে লেখা হবে কিছু ইতিহাস। যেখানে লেখা থাকবে, তিনি ১৯৯৭ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ৭০ জন কর্মী নিয়োগদানকালে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন, তেমনি বুয়েটেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে উপ-উপাচার্য থেকে শুরু করে কিছু নিয়োগ দিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি দ্বারা প্রমাণিত, তিনি বেশ কিছু ছাত্রের ফল সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে আটকে রেখে তাঁদের শিক্ষাজীবনের বিরাট ক্ষতি সাধন করেন। তাঁদের অপরাধ ছিল মেধাবী শিক্ষার্থী ঈশানকে (২০০৬ ব্যাচ) পঙ্গু করে দিয়েছিল মেরে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর সন্ত্রাসীদের বহিষ্কার করা হয়েছিল বুয়েট থেকে। কিন্তু তিনি পক্ষ নিয়েছিলেন সন্ত্রাসীদের। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করেছিল সেসব শিক্ষার্থীর ফল আটকে দিয়েছিলেন প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছায়। সম্পূর্ণ দলীয় স্বার্থ বিবেচনা করে তিনি ফল জালিয়াতি করেছেন, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা কামাল আহমদকে নিয়মবহির্ভূত ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দিয়েছেন। বুয়েট পরিবারের সদস্যদের নামে যে মামলা হয়েছে সেখানেও যে তাঁর হাত আছে এটাও স্পষ্ট।
বুয়েটের উপাচার্য হিসেবে যেমন এম এ রশিদ কিংবদন্তি হয়ে আছেন, একজন উপাচার্য যেমন যোগ্য না হওয়ায় নিজের ছেলেকে ভর্তি না করিয়ে নমস্য হয়ে আছেন, বুয়েটের শিক্ষকরা যেমন পোষ্য কোটার মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি করানোর পথ পরিত্যাগ করেছেন, শৃঙ্খলাবোধ সম্মানবোধ প্রদর্শন করে যেমন সবার প্রশংসা কুড়িয়েছেন তেমনি সুযোগ বর্তমান ভিসির ভাগ্যে জুটবে কি?
বরং তিনি যে বীজ বপন করে গেছেন সেই বীজ থেকে জন্ম নেওয়া গাছ থেকে ফল হবে- প্রথমত, এখানে পরবর্তীকালে যিনিই উপাচার্যের আসনে বসবেন তাঁকে সব সময় ভীত থাকতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা না জানি কখন আবার আন্দোলনে নেমে যান। কখন না জানি ছাত্রলীগ নামধারী তরুণদের মতো অন্য কোনো লাঠিয়াল বাহিনী এসে ভিসির দরজায় পদাঘাত করতে থাকে। না জানি শিক্ষকদের মধ্যে কেউ জিয়া পরিষদ নেতা কিংবা বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতা হওয়ার সুবাদে উপ-উপাচার্যের পদটি দাবি করে বসেন?
সুতরাং ভয় একটা তৈরি হলো তাঁর অনিয়মের কারণে। সেই ভয় বুয়েটের দুর্নামের। বুয়েটের ঐতিহ্য ভঙ্গের, শ্রেষ্ঠত্ব ধ্বংসের, শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্তির পথ প্রশস্ত হওয়ার। সুতরাং শঙ্কা জাগে, শিক্ষার্থীদের রক্তের দাগ মাড়িয়ে তিনি পশ্চাৎগমন করলেও তিনি কিন্তু অশান্তির বীজটি বুয়েটে ঠিকই রোপণ করে গেছেন। সেই গাছটি কি নির্মূল হবে?

mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.