চুনতি অভয়ারণ্যে অবৈধভাবে অর্ধলাখ মানুষের বাস by পুষ্পেন চৌধুরী

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর অবৈধভাবে প্রতিনিয়ত গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। বর্তমানে বনের মধ্যে অবৈধভাবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস করছে। বন উজাড় করে বাড়ানো হচ্ছে কৃষিজমি। হুমকির মুখে রয়েছে বন্য প্রাণী।


বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লোহাগাড়া, চকরিয়া, বাঁশখালী উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের সাত হাজার ৭৬৪ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি নিয়ে ১৯৮৬ সালে চুনতি অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।
চুনতি অভয়ারণ্য রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল হোসেন খান জানান, অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন সংরক্ষিত বনে অবৈধভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠার পরও মানুষের অনুপ্রবেশ চলছেই। জনবলের অভাবে বিশাল এ অভয়ারণ্য পাহারা দেওয়া কঠিন।
চুনতি অভয়ারণ্যের সহকারী বন সংরক্ষক আনোয়ার হোসেন জানান, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত অভয়ারণ্যের প্রায় ৮০০ একর খাসজমি জেলা প্রশাসন বন্দোবস্ত দেয়। পরে জমি বন্দোবস্ত পাওয়া লোকজনের পরিচিত ব্যক্তিরা অভয়ারণ্যে এসে বসতি বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে অভয়ারণ্যের ভেতর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস করছে। তারা প্রতিনিয়ত বন উজাড় করে বাড়াচ্ছে কৃষিজমি। বনজ সম্পদ উজাড়ের ফলে অভয়ারণ্যের হাতি, বানর, হনুমান, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, দুর্লভ পাখি, শজারু, খেঁকশিয়ালসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী বিলুপ্তির পথে।
চুনতি অভয়ারণ্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আমিন আহমদ খান জানান, হাজার হাজার অবৈধ বসতি গড়ে ওঠায় অভয়ারণ্যের প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এখানকার বাসিন্দারা বনাঞ্চল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। হাতির প্রধান খাদ্য বাঁশ বিক্রি করছে অন্যত্র এবং পাহাড় কেটে তৈরি করছে কৃষিজমি। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে বন্য প্রাণী।
বাঁশখালীর জলদি রেঞ্জ কর্মকর্তা কামরুল মোজাহিদ এবং চকরিয়া হারবাং বিট কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন, অবৈধ বসতি উচ্ছেদে সরকারের কঠোর নীতিমালা না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
চুনতি অভয়ারণ্যের মিরখিলের বাসিন্দা সালেহা বেগম, মর্জিনা আক্তার, নুরুন্নাহার জানান, তাঁরা ২৫ বছর ধরে এখানে বাস করছেন। তাঁদের সঙ্গে এখানে মিয়ানমারের কয়েক শ নাগরিক বাস করছে। স্থানীয় দোকানদার মো. হাসান বলেন, এখানে একটি সংঘবদ্ধ চক্র হাতির হাড় পাচারের সঙ্গে জড়িত। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি হাতি এ চক্রের হাতে মারা পড়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জগলুল হোসেন বলেন, ‘খাস বন্দোবস্ত পাওয়া এবং হাজার হাজার অবৈধ বসতি উচ্ছেদে যেটুকু জনবল এবং আর্থিক সংগতি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই।’ তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে চুনতি অভয়ারণ্যে জার্মান সংস্থা জিআইজেড ও আরণ্যক ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও বন বিভাগের সহযোগিতায় কার্বন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় অভয়ারণ্যের ভেতর অবৈধভাবে বসবাসকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা বনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্য উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। এ কাজে চুনতি অভয়ারণ্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি তাঁদের সহায়তা করছে। এ ছাড়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি বনে নিয়মিত টহল জোরদার করেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২০ জুন ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে বিশ্বের ৬৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি প্রকৃতি সংরক্ষকবিষয়ক সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জাতিসংঘ ইকুয়েটর পুরস্কার দেওয়া হয়। চুনতি অভয়ারণ্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি ওই পুরস্কার লাভ করে। এরপর থেকেই বন ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নজরে আসেন এ অভয়ারণ্যের ভেতরের অবৈধ বাসিন্দারা।

No comments

Powered by Blogger.