পুষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামুদ্রিক লবণ by মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম

বাংলাদেশে সমুদ্রের পানি হতে লবণ উৎপাদন এলাকা হলো কক্সবাজার জেলার সাতটি ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ আটটি উপজেলা। প্রায় ৩০-৪০ হাজার লবণ চাষী এ কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত। ৬৫ হাজার একর জমিতে সাগরের লবণাক্ত পানি দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে নিজস্ব প্রযুক্তিতে সৌরশক্তির ব্যবহারে এ লবণ উৎপন্ন হয়ে থাকে।


অনুকূল আবহাওয়া বজায় থাকলে এ জমি হতে বার্ষিক ২০-২৫ লাখ টন প্রাকৃতিক সামুদ্রিক লবণ উৎপন্ন হয়ে থাকে। পূর্বের সনাতন পদ্ধতির একটু আধুনিক ছোঁয়ায় লবণ মাঠে কালো পলিথিন পদ্ধতিতে চাষীরা লবণ উৎপাদন করে থাকেন। যার ফলে লবণের মান অনেক উন্নত হয়েছে। এ পদ্ধতিতে বর্তমানে সমুদ্র উপকূলীয় অনেক জেলায় লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে খাবার লবণের চাহিদা বার্ষিক প্রায় ১৩-১৪ লাখ টন। যা সামান্য পরিশোধন করে বাজারজাত করা হয়। সামুদ্রিক লবণ আমরা খাদ্য হিসেবে ভাতের মতোই নিয়মিত খাচ্ছি। লবণ শুধু একটি খাদ্যই নয়, প্রাকৃতিক সামুদ্রিক লবণ যে একটি বহুবিধ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার তা অনেকে জানে না। দেশের ১৬ কোটি মানুষসহ পশু-পাখির একটি অতি মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় খাবার হিসেবে লবণ স্বল্পমাত্রার হলেও এর নিবিড় ব্যবহার ব্যাপক। কোটি কোটি মানুষের অনুপুষ্টি যোগানোর খাদ্য এ লবণ। অপরিশোধিত লবণ সরাসরি বিঘাপ্রতি ২০-২৫ কেজি সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যা জমিতে প্রচুর অনুপুষ্টি যোগাতে সহায়তা করে। জমিতে সামুদ্রিক অপরিশোধিত লবণ প্রয়োগ করলে বন্ধ্যা জমি উর্বর ও সরল জমিতে পরিণত হয়। তাই এটা জমির সংশোধনের উৎকৃষ্ট কম দামী সার।
বাংলাদেশ স্থলভাগের সম্পদে দরিদ্রতম হলেও সমুদ্র সম্পদে বেশ ধনী। আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধের রায় আমাদের জন্য সমুদ্র জয়ের মতো। এ জয়ে প্রাপ্ত ১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারে সমুদ্র সম্পদ এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রতীর প্রায় এক হাজার মাইলের মতো। সাগরের পানি ও সাগরতলের অফুরন্ত খনিজ সম্পদের একটা বিরাট ভা-ার বাংলাদেশের সমুদ্র। সাধারণভাবে সাগরের জলে দ্রবীভূত মৌলিক ঘন পদার্থের মধ্যে ক্লোরিন, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফ্রেমিন, কার্বন, স্ট্রনশিয়াম, বোরন, সিলিকন, ফ্লোরিন, নাইট্রোজেন, এ্যালুমিনিয়াম, লিথিয়াম, ফসফরাস, বেরিয়াম, আয়োডিন, আর্সেনিক, লৌহ, মেঙ্গানিজ, তাম্র, ইউরিয়াম, নিকেল, স্ক্যানডিয়াম, পারদ, স্বর্ণ, রেডিয়াম, ক্যাড়মিয়াম, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদি মৌলগুলো দ্রবীভূত অবস্থায় সাগরের পানিতে থাকে। সামুদ্রিক উদ্ভিদজাত খাদ্যে আয়োডিনের পরিমাণ একটু বেশি থাকে। সামুদ্রিক লবণ একটি সামুদ্রিক খাদ্য। তাতে আয়োডিন নিশ্চয় থাকবে। মানুষসহ ভূ-চর জীবদের শরীরবৃত্তে আয়োডিনের প্রাধান্য থাকা প্রয়োজন। সমুদ্রের পানিতে যে পরিমাণ আয়োডিন থাকে তার অংশবিশেষ আয়োডাইট ও আয়োডেট হিসেবে থাকে। বহুকাল ধরে সাগরের আগাছা হতে আয়োডিন আহৃত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রচুর পরিমাণ সমুদ্র শৈবাল চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। সাগরের পানিতে আয়োডিনের বিস্তৃতি ও নিরূপণ সম্বন্ধে ক্লাস ও রিথ আলোচনা করেছেন তা কাজে লাগাতে হবে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রচুর শৈবাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। তা পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার, চীন ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশে কমমূল্যে মাত্র প্রতিমণ ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রয় ও রফতানি হয়ে থাকে। এ সামুদ্রিক খাদ্য শৈবাল রফতানি না করে এ শৈবাল দিয়ে খাদ্য উৎপাদন শিল্প কারখানায় বিভিন্ন খাদ্যে সামান্য সংমিশ্রণ করে প্যাকেটজাত খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে পরিবেশন করতে পারি। এতে আমাদের অনেক খাদ্যদ্রব্যর ওপর আমদানি নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে এবং আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। লবণের মতো শৈবাল নির্যাস কোমল পানীয় খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারজাত করা যায়। বাংলাদেশে এখন শিল্প কারখানার প্যাকেটজাত খাবারের যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছে। তাই শৈবাল মিশ্রিত আয়োডিনযুক্ত খাবার, আয়োডিন সমস্যা দূর করতে পারে। সরকারের উচিত হবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের শৈবাল রফতানি বন্ধ করে দেয়া। যথোপযুক্ত দরে সেন্টমার্টিন দ্বীপ হতে সংগৃহীত শৈবাল দেশীয় প্যাকেটজাত ও কোমল পানীয়, জেম, জেলি, সংরক্ষিত খাদ্যে ব্যবহার করা। সঙ্গে সঙ্গে সামুদ্রিক প্রাকৃতিক লবণের ব্যাপক ব্যবহার করা। এটি একটি বাস্তব নিবিড় আয়োডিন প্রাপ্তির সম্ভাবনাময় পদক্ষেপ হবে বলে মনে করা যায়।
শুষ্ক মৌসুমে আমাদের সাগরের লবণাক্ততা প্রায় ৩৪ দশমিক ৫%-৩৫% থাকে। প্রতি কিলোগ্রাম পানিতে গ্রাম পরিমাণ এ্যানায়ন সোডিয়াম ১০ দশমিক ৪৭, ম্যাগনেশিয়াম ১ দশমিক ২৮, ক্যালসিয়াম শূন্য দশমিক ৪১, পটাশিয়াম শূন্য দশমিক ৩৮, স্ট্রানশিয়াম শূন্য দশমিক ০১৩, ক্লোরাইড ১৯ দশমিক ৯৭, সালফেট ২ দশমিক ৬৪, বাইকার্বনেট শূন্য দশমিক ১৪, ব্রোমাইড শূন্য দশমিক ০৬৪, বোরেট শূন্য দশমিক ০২৭ সমুদ্রের পানিতে ৪৪ রকমের মৌলিক ঘন পদার্থ থাকে। এর সাথে অন্যান্য মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ৪৯টি। পর্যাপ্ত পরিমাণে ৬টি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়। যা সহজে সমুদ্রের পানি হতে উৎপাদিত প্রাকৃতির লবণের কণার মধ্যে ঢুকে পড়ে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সৌরতাপ দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি সামুদ্রিক লবণ বহু মেঘা ও মাইক্রোট্রেস পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি আদর্শ রাসায়নিক খাদ্য। প্রাকৃতিক লবণ কখনও আয়োডিনহীন হয় না। বর্তমানে দেশে ভেকুয়াম পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধনকারী শিল্পপতিরা দেশী লবণকে তকতকে ঝরঝরে করার জন্য আয়োডিনের ব্যানার সামনে রেখে প্রাকৃতিক এ লবণ হতে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রো ও মেঘা অনুপুষ্টি কণা বের করে ফেলে এবং তাকে জলবিহীন এনহাইড্রাইড করার জন্য কস্টিক সোডা সংমিশ্রণ করে। যা ফল পাকানো ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এভাবে প্রাকৃতিক লবণকে ভেজাল লবণে পরিণত করা হয়।
সারাবিশ্বে মানুষ যেখানে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় প্রাকৃতিক খাবার, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান বিপরীতে। ভেকুয়াম পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধন করতে প্রাকৃতিক লবণ হতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম আয়ন বের করে ফেলা হয়। কেননা, দুই মৌলিক পদার্থের আয়ন বাতাস হতে জলীয়বাষ্প আহরণ করে লবণকে ভেজা করে ফেলে। আর ভেকুয়াম পদ্ধতিতে উৎপাদিত মনোসোডিয়াম ক্লোরাইড জলবিহীন। যা হতে অন্যান্য মৌলিক পুষ্টিকণা বের করে ফেলা হয়। এ লবণকে বিজ্ঞানের ভাষায় শিল্পজাত লবণ বলা হয় যা কোমল পানীয়, খাদ্য সংরক্ষণ, জেম, জেলি প্রস্তুতকারী কারখানায়। এ রকম লবণ ব্যাপক হারে দৈনিক খাবারে ব্যবহার করা হলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী গরিব দেশের জনসাধারণ নানা দুরারোগ্য রোগের কবলে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে সামুদ্রিক প্রাকৃতিক লবনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরী। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ সকাল বেলা দেশী প্রাকৃতিক লবণ দিয়ে আহার করে। পান্তার সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ দেশীয় প্রাকৃতিক লবণ একজন মানুষের দেহের পুষ্টি যোগানোর বড় উৎস। একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় মিনারেলসমূহ : ম্যাগনেশিয়াম ১.১২ মিলিগ্রাম, মেলাবড়িনাম ২.৫ মি.গ্রা., সেলেনিয়াম ৩৩ মি.গ্রা., ক্যালসিয়াম ৯০ মি.গ্রা., লৌহ ৫ মি.গ্রা., পটাশিয়াম ৫ মি.গ্রা. ফসফরাস ৩২ মি.গ্রা., আয়োডিন ১০০ মাইক্রো গ্রাম। বর্ণিত এ সব মিনারেল ট্রেস মাত্রায় আমাদের দেশের উৎপাদিত প্রাকৃতিক সামুদ্রিক লবণে থাকে। আর এটি অনেক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় একদিকে দেশের মানুষকে আয়োডিনের অভাবজনিত রোগ থেকে মুক্তি দেবে তেমনি আমাদের সুস্বাস্থ্যর অধিকারী করে কর্মঠ জনশক্তিতে পরিণত করতে ভূমিকা রাখবে। আর অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়, সামুদ্রিক লবণ ব্যাপকভিত্তিক চাষ কর্মসংস্থান যেমন বৃদ্ধি করবে তেমনি আমদানি নির্ভরশীলতাও হ্রাস করবে। আবার এগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাদ্য তৈরি করা হলে আমাদের খাদ্যদ্রব্য আমদানিও হ্রাস পাবে।
বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ-খুদা বলেছেন, বিশ্বের কোন দেশ অন্য দেশের অনুকরণ করে সমৃদ্ধ হয়নি। থিঙ্ক গ্লোবালি এ্যাক্ট লোকালি এখানে আনা দরকার। আমরা দেশ সম্বন্ধে ততটুকু জানি যতটুকু আমাদের বিদেশী কর্তারা জানিয়ে গিয়েছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের প্রতিভার ক্ষেত্রে বিদেশী প্রভাব এত প্রবল যে, আমরা দেশকে স্বনির্ভর করার সর্বরকম স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে বসেছি। এখনই সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশকে ও দশকে সমৃদ্ধ করতে পারব না। তাই ব্যাপক শিক্ষার প্রভাব ও বিজ্ঞানী প্রভাবের দ্বারা নতুন প্রেরণা লাভ করে স্বপ্ন বিভোর রাজনৈতিক স্বাধীনতা হতে বের হয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের সমুদ্রসীমায় ও উপকূলে যে সম্পদের আধার রয়েছে এগুলোকে যথাযথ কাজে লাগাতে হবে। সামুদ্রিক লবণ উৎপাদনের প্রতি যেমন জোর দিতে হবে তেমনি লবণে যাতে ব্যবসায়ীরা ভেজাল দিতে না পারে তারও ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সামুদ্রিক শৈবাল রফতানি না করে আমাদের দেশেই যদি এর উপযুক্ত ব্যবহার করা যায় তবে আমরাই আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হব। তাছাড়া সমুদ্রসীমায় যে সম্পদগুলো রয়েছে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আমাদের দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
লেখক : বায়োলজিস্ট

No comments

Powered by Blogger.