আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর) এ সাধারণ ক্ষমা মাজে এমন অভিঘাত হানবে যা বাংলাদেশকে বিভক্ত করে দেবে, তা যদি ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতেন তাহলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার আগে তাদের চিন্তা করতে হতো। এখন বাঙালী জাতিকে এই সাধারণ ক্ষমা নিয়ে তর্ক করতে হচ্ছে।


শেখ মুজিব ও তাঁর সরকার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি বা তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি এবং মানুষকে কি যাতনার মধ্যে থাকতে হয়েছে তাও তাঁরা অনুধাবন করেননি। করলে তাঁদের পক্ষে ক্ষমা করা সম্ভব হতো না। যেমনটি বলেছেন শহীদ সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার “আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোনো নেতা যুদ্ধে আপনজন হারাননি। ফলে স্বজন হারানোর ব্যথা তাদের জানা ছিল না। ঘাতকদের তারা সহজেই ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন।” অন্যদিকে এ পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের বক্তব্য, যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন জাতীয় সংসদে, “সেই সময় প্রায় চার লক্ষ বাঙালী পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় ছিল। তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন বাঙালীদের ফিরিয়ে আনার জন্য রাস্তায় নেমেছিল, বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিল, আমাদের কাছে এসেও তাদের আত্মীয়স্বজন অনেক কান্নাকাটি করেছেন। এই রকম একটা অবস্থায় সেই সব বাঙালীদের ফিরিয়ে আনার জন্যই এই ঈষবসবসপু (ক্ষমা) দেয়া হয়েছিল। ... (মুক্তিযুদ্ধে) অনেক ক্ষেত্রে দেখা দেখে যে, বাড়ির একজনকে কোনো একটা পদে রেখে সেই বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এই ধরনের যে সমস্ত কেস ছিল, যারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন তাদেরকেই বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু যারা সত্যিকার যুদ্ধ অপরাধী, বিশেষ করে যারা গণহত্যা চলিয়েছে, যারা লুটতরাজ করেছে, যারা নারী ধর্ষণ করেছে, যারা অগ্নিসংযোগ করেছে তাদেরকে কিন্তু ক্ষমা করা হয়নি।”
এই বিষয়গুলোই বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালের পত্রিকা উল্টালে প্রায় প্রতিদিন চোখে পড়বে দালাল আলবদরদের গ্রেফতারের এবং তাদের বিচারের খবর। দেখা যাবে বিচারে অনেককে কারাদ-, এমনকি মৃত্যুদ- দেয়া হচ্ছে।
সরকারীভাবে ২৫.১২.১৯৭১ সালে জানানো হয়, [প্রতিবেদন অনুযায়ী], ২৫ মার্চের পর নির্দোষ মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচারের জন্য দায়ীদের বিচার করা হবে। ১৯৭২ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ৪১ হাজার দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে, চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে ১৬ হাজারের বিরুদ্ধে, মুক্তি পেয়েছে ৫০০০ এবং মামলা করা হয়েছে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে। এখানে মনে রাখা দরকার, সে বিপর্যস্ত সময়ে, যেখানে ছিল বিচারক ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থার অভাব, সেখানে কয়েক মাসের মধ্যে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা ও ১৬ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা সামান্য বিষয় নয়।
অপরাধীদের যাতে সুষ্ঠু বিচার হয়, সে জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও সে সময়ের নামকরা তরুণ ও প্রবীণ আইনজীবীদের বিচারের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন যা বর্তমান সরকার পারেনি। চীফ প্রসিকিউটর নিযুক্ত হয়েছিলেন সবিতারঞ্জন পাল [এসআর পাল নামে খ্যাত] ও সিরাজুল হক। তাদের সহায়তা করার জন্য ছিলেন আমিনুল হক, মাহমুদুল ইসলাম, ইসমাইল উদ্দিন সরকার ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। এরা পরবর্তীকালে এ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারক হয়েছিলেন। পুলিশের ডিআইজি নুরুল ইসলাম ছিলেন চীফ ইনভেস্টিগেটর।
বর্তমান যুদ্ধাপরাধ বিচারের আদি কাঠামো এটিকেই বলা যেতে পারে।
একদিকে যখন আলবদর ও রাজাকারদের বিচার চলছে তখন অনেকে এই বিচার বন্ধ করার দাবি তোলেন, বিশেষ করে বামপন্থী রাজনীতিবিদরা এখন অনেকেই মনে করতে চান না। মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন, “দালাল আইন বাতিল না করিলে আন্দোলন করিব।” [দৈনিক বাংলা ৫.১২.১৯৭২] অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জানান, দালাল আইনের “অপ্রয়োগ” বন্ধ করতে হবে। [ঐ ২.১.১৯৭৩] অলি আহাদ “দালাল আইনে অভিযুক্তদের ক্ষমা করার জন্য আহ্বান জানান।” [৫.২.১৯৭৩] শুধু তাই নয়, পাকিস্তানে যারা আটক আছেন তাদের ফেরত আনার জন্য তাদের আত্মীয়স্বজন ও অন্যরা ধরনা দিতে থাকেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ক্ষমার বিষয়টি অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ক্ষমা ঘোষণার আগে দ্বিতীয়বার ১৯৭৩ সালের ১৬ মে দালাল আইন সংশোধন করা হয়। যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু আলবদর ও খুনীদের ক্ষমা করেছেন তারা যে কত বড় নির্জলা মিথ্যা বলেন, তার প্রমাণ দ্বিতীয় সংশোধনী। ১৯৭৩ সালে ১৬ মে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, “অত্র আদেশে বর্ণিত অনুকম্পা ব্যক্তিদের প্রতি এবং অপরাধসমূহের প্রতি প্রযোজ্য হবে না” যা এই অনুচ্ছেদের ৯টি দফায় উল্লেখ করা হয়। সেগুলোর কয়েকটিÑ
ঙ. আলবদর বা আলশামস সংগঠনের সদস্য হইয়া যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া যাহারা সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বলিয়া কথিত;
চ. রাজাকার কমান্ডার হইয়া দখলদার বাহিনীর সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া যাহারা সাজাপ্রাপ্ত বা কথিত;
জ. দালাল আমলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কর্মকর্তা হইয়া যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুুক্ত বা কথিত;
ঝ. মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও সংগঠন দমনে বা পার্থিব সুবিধা আদায়ের মানসে দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া যাহারা সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বা কথিত।”
এ ছাড়াও বলা হয়েছিল, “অবশ্য মুক্তির শর্ত হইতে যে, তাহারা উপরোক্ত আদেশের বাহিরে বিচারযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য অন্য কোন অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট নহে।”
[দেখুন, বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : কুযুক্তি বনাম সুযুক্তি; ’৭৩-এর আইনের সহজ পাঠ এবং ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার : দেশে-বিদেশে প্রশ্ন, নিমূর্ল কমিটি, ২০১০]
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ও ভবিষ্যতে তাদের উত্থান রোধে বঙ্গবন্ধু সরকার যে সব আইন করেছিল তার একটি সংক্ষিপ্তসার দেয়া যেতে পারেÑ
১. ১৯৭২ সালের ২৪ শে জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন জারি করা হয় যা পরিচিত চ.ঙ. ঘড়. ঠওওও ড়ভ ১৯৭২.
২. ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্ব স্ব জেলা কোর্টে অধ্যাপক গোলাম আযম গংদের হাজির হওয়ার নির্দেশ।
৩. ১৯৭২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন জারি যা পরিচিত চ.ঙ. ঘড়. ১৪৯ ড়ভ ১৯৭২.
৪. ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আযম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল।
৫. ১৯৭২ সালের ৪ঠা নবেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রহিত।
৬. ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল
[জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার ভাষণ, ১৬.৪.১৯৯২]
একটি বিষয় লক্ষণীয়। মওলানা ভাসানী, মোজাফফর আহমদ বা অলি আহাদ মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিলেন, আলবদর ও অন্য স্বাধীনতা-বিরোধীদের নৃশংসতা দেখেছেন বা তার কথা শুনেছেন। প্রথমোক্ত দু’জন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন। অথচ তারা আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের বিচারের বিরোধিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সাল দেখেননি, মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত এর বিভৎসতা-নির্দয়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিতও ছিলেন না। কিন্তু, অপরাধীদের বিচারে সর্বতোভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। দালাল আইন শুধু নয়, তিনি আরেকটি আইনও করেছিলেন।
ওয়ালিউর রহমান লিখেছেন, “১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরকার-প্রধান পর্যায়ে সিমলা চুক্তি হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন যে, যুদ্ধাপরাধীরা হয়তো আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া দালাল আইনে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের কতগুলো বাস্তব সমস্যা ছিল।” এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ও আইনমন্ত্রী কামাল হোসেনকে নির্দেশ দেন যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য সময়োপযোগী একটি আইনের খসড়া করতে। তাঁদের তিনি বলেছিলেনÑ “পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহায়ক শক্তি, যারা পাকিস্তানী আর্মিকে সহযোগিতা করেছিল, তাদের প্রত্যেককেই বিচারের আওতায় আনতে হবে।” (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.