মোবাইল বদলে দিচ্ছে জীবন ও জগত- অনুবাদ : এনামুল হক

মোবাইল ফোন আমাদের নিত্যসঙ্গী। আমাদের প্রাণ। মোবাইল ছাড়া আমাদের এক মুহূর্ত চলে না। এমনকি ঘুমুতে যাওয়ার সময়ও আমরা মোবাইলকে পাশে রাখি। সবখানেই, সব জায়গায় রয়েছে মোবাইলের সদম্ভ উপস্থিতি। শুধু কথা বলা নয়, হাজারো কাজে আজ ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল।


এভাবে মুঠোফোন আমাদের চারপাশের জগৎকে বদলে দিচ্ছে এবং সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে আমাদেরকেও এমনকি আমাদের রোমান্সের ধারাও। টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ কাহিনী অবলম্বনে এই লেখাটি পরিবেশিত।

মোবাইল ফোন আমাদের চারপাশের জগতকে বদলে দিচ্ছে। বদলে দিচ্ছে আমাদের নিজেদেরকেও। শিক্ষা থেকে শুরু করে রাজনীতি, চিকিৎসা থেকে শুরু করে প্রেম-ভালবাসা সবকিছুই মোবাইল ফোনের বদৌলতে বদলে যাচ্ছে। মোবাইল আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের অতি সম্প্রসারিত রূপ। মোবাইল আমাদের গতি বাড়িয়েছে, বুদ্ধি বাড়িয়েছে। মোবাইল ফোন আজ আমাদের অতি নির্ভরযোগ্য ও সার্বক্ষণিক সঙ্গী। সামাজিক সংগঠন গড়া ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালনার অনন্য শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল।
ইতিহাসে এমন কোন বস্তু, হাতিয়ার বা উপকরণের কথা চিন্তা করা কঠিন যার সাহায্যে এত বেশিসংখ্যক লোক এত দ্রুত ও এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে যেমনটি পেরেছি আমরা। মোবাইলের সাহায্যে। একমাত্র টাকা পয়সা এর কাছাকাছি আসতে পারে। টাকা আমাদের সবসময় সঙ্গে থাকে। টাকা না নিয়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরোই না। কিন্তু তারপরও একথা সত্য যে আমাদের অধিকাংশই ওয়ালেট সঙ্গে নিয়ে বিছানায় ঘুমুতে যাই না, কয়েক মিনিট পর পর ওটাকে নেয়ার জন্য হাত বাড়াই না বা পরখ করে দেখি না। স্মার্ট ফোনের তুলনায় টাকা এক নিরেট জড়বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। স্মার্ট ফোন অনেক কিছুই করতে পারে। এমনকি ওয়ালেটের স্থানও দখল করতে পারে। মোবাইল ফোন নিয়ে আমরা হাঁটি, কথা বলি, ঘুমাই। এ আমাদের নিত্যসঙ্গী।
মানুষ প্রথম যখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তখন সেটির সাইজ ছিল জুতার সমান। আজ সেটা আমাদের মুঠোয় বন্দী। অথচ এর ক্ষমতা বা শক্তি যে কত প্রচ- সে সময়ের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। মুঠো ফোনের বদৌলতে সমস্ত জ্ঞান আজ আমাদের নখদর্পণে। আজ একটা আদর্শ স্মার্ট ফোনের কম্পিউটিং ক্ষমতা প্রথম চাঁদে মানুষ নিয়ে যাওয়া এ্যাপোলো-১১ নভোযানের চেয়েও বেশি। বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের যত না টয়লেট বা ট্যাপের পানি ব্যবহারের সুযোগ আছে তার চেয়ে বেশি আছে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ। লাখ লাখ মানুষের কাছে এটাই হলো জীবনে প্রথম ব্যবহার করতে পারা টেলিফোন।

জীবনটাই হয়ে গেছে মোবাইল
মোবাইল ফোন আমাদের জীবনকে পুরোদস্তুর মোবাইল করে তুলেছে। আমরা হয়ে গেছি সচল ও ভ্রাম্যমাণ। বিভিন্ন দেশে পরিচালিত সমীক্ষা থেকে মোবাইল ব্যবহারের কিছু অভিন্ন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। যেমন মোবাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রাণ। এছাড়া আমরা চলতে পারি না। সেটা একদিনের জন্য না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক ঘণ্টার জন্যেও না। চারজন মানুষের একজন প্রতি ৩০ মিনিটে মোবাইল চেক করে দেখে। আর পাঁচজনের একজন সেটা করে প্রতি ১০ মিনিটে। অনেকে বলেছে অল্প সময়ের জন্য মোবাইল ছাড়া থাকলে তাদের হাঁসফাঁস লাগে, অস্থির ও উদ্বিগ্ন বোধ হয়। মোবাইল এমনভাবে আমাদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে গেছে যে মোবাইল সেটা অথবা লাঞ্চের প্লেটÑ দুটোর একটিকে তুলে নিতে বাধ্য করা হলে দেখা গেছে যতজন লাঞ্চের প্লেট নেবে তার দ্বিগুণ সংখ্যক নেবে মোবাইল প্লেট। ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নরনারীর তিন চতুর্থাংশই মোবাইল নিয়ে ঘুমোয়।
বিশ্বব্যাপী গড়ে ৪৪ শতাংশ লোক বলে যে তাদের প্রাত্যহিক প্রথম ও শেষ কাক্সিক্ষত বস্তুটি হলো মোবাইল।
৫৮ শতাংশের মতে মোবাইলের কারণে পরিবার ছেড়ে দূরে থাকা সহজতর। ৫২ শতাংশের মতে মোবাইল আছে বলেই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ রাখা যাচ্ছে। ৪৯ শতাংশ মনে করে তারা মোবাইলের জন্য বেশি খবরাখবর পাচ্ছে। মোবাইল ব্যবহারকারীদের মতে এর সাহায্যে প্রয়োজনের মুহূর্তে সহজেই সাহায্য পাওয়া যায় বলে তারা নিজেদের অধিক নিরাপদ বোধ করে। মোবাইলের কারণে দৈনন্দিন জীবন নিরাপদ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে জীবনমান উন্নত হয়েছে। ফোন করা ছাড়াও মোবাইল দিয়ে ম্যাসেজ পাঠানো ও গ্রহণ করা যাচ্ছে। ইন্টারনেট ব্রাউস করা যাচ্ছে। মিউজিক শোনা যাচ্ছে। ওয়েবসার্চ করা যাচ্ছে। খবর বা চলমান ঘটনা পড়া বা জানা যাচ্ছে। ছবি তোলা যাচ্ছে। ই-মেইল পাঠানো ও গ্রহণ করা যাচ্ছে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলো পরিদর্শন করা যাচ্ছে। গেম খেলা যাচ্ছে। আবহাওয়ার খবরাখবর নেয়া যাচ্ছে। জিপিএস ব্যবহারের দ্বারা বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করা যাচ্ছে। অনলাইনে কেনাকাটা করা যাচ্ছে। পেমেন্ট গ্রহণ করা যাচ্ছে। ভিডিও চ্যাট করা যাচ্ছে। ৬৫ শতাংশ বাবা-মা মনে করেন মোবাইল ফোন তাদের আরও ভাল অভিভাবক হতে সাহায্য করছে।
বিশ্বব্যাপী গড়ে ৫২ শতাংশ মোবাইল ব্যবহারকারী মনে করে মোবাইলের কল্যাণে তারা আরও বেশি কাজকর্ম ম্যানেজ করতে পারছে। ৩৬ শতাংশের মতে একই কারণে তাদের পক্ষে অফিস থেকে দূরে থেকেও কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। ৪৪ শতাংশের ধারণা মোবাইলের জন্যই তারা আরও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। আর মাত্র ১৬ শতাংশ মনে করে যে মোবাইলের বদৌলতে তাদের চিন্তা করার সময় কম লাগছে। এভাবেই মোবাইল আমাদের জীবনযাপনের ধারা, কাজকর্মের ধারা বদলে দিচ্ছে।

বদলে যাচ্ছে রোমান্সের ধারা
শুধু জীবন ও কাজের ধারা বদলে যাচ্ছে তাই নয়, মোবাইল আমাদের রোমান্সের ধারাও বদলে দিচ্ছে। আগে প্রেম হতো ডেটিংয়ের মাধ্যমে। কপোত কপোতি নির্জনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাত ভালবাসা-ভাললাগার কথা বলে। সে স্থান উত্তরোত্তর দখল করে নিচ্ছে মোবাইল। প্রথম দিকে মোবাইল চলত তাদের আলাপচারিতা। এখন সে জায়গায় এসেছে টেক্সট। তারা মোবাইলেই ভালবাসার কথা লিখে পাঠাচ্ছে। এখানে স্থানের কোন ব্যবধান থাকছে না। দূরত্ব কোন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। মোবাইল টেক্সট এ ডেটিংয়ের কাজ যেখানে প্রতি ৫ জন আমেরিকানের একজন করছে সেখানে ব্রাজিলীয়রা করছে তার ৩ গুণ এবং চীনারা ৪ গুণ। আবার খারাপ দিকও আছে। দশজন বিবাহিত আমেরিকানের একজন ব্যাভিচারের কাজে মোবাইল টেক্সটিংয়ের সহায়তা নিচ্ছে। সেখানে এমন কাজ করছে এক-তৃতীয়াংশ ভারতীয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনা। সব বয়সের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আমেরিকান, বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা তাদের পার্টনারকে অথবা ভালবাসার জনকে যৌন উদ্দীপক ছবি পাঠিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে দক্ষিণ আফ্রিকানরা হলো ৪৫ শতাংশ এবং ভারতীয়রা ৫৪ শতাংশ ও ব্রাজিলীয়রা ৬৪ শতাংশ।
আবার আগের কথায় আসা যাক। মোবাইল প্রেম-ভালবাসার ধরন পাল্টে দিয়েছে। আগে কোন এক স্থানে বসে কপোত-কপোতির সেই কূজন আর নেই। এখন আর কথা বলা নয়। এখন আর আবেগের প্রকাশ কণ্ঠস্বরে নয়, শব্দের উচ্চারণে নয়। এখন সেটা মোবাইলের স্ক্রিনে লিখিত অক্ষরে। মোবাইল টেক্সট আজকের দিনে রোমান্সের ইন্ধন, এর চালিকাশক্তি, এর রাসায়নিক ক্ষরণ। এর জন্য প্রেমিক-প্রেমিকাকে অনবরত মোবাইলের গায়ে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে হয়। এই নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকেও কপোত-কপোতিরা ল্যান্ডফোনেই প্রেমালাপ চালাত। তারপর এলো মোবাইল। এখন চলছে মোবাইল টেক্সটিং। এখন আর শোনা নয়। এখন শব্দের কথামালা শুধু দেখে যাওয়া। এখন সংলাপের স্থান নিয়েছে শব্দগঠন। এই যে উত্তরণ এটা ভাল হয়েছে কি খারাপ হয়েছে সে কথা ভিন্ন। তবে এটা ঠিক যে এতে রোমান্সের সেই আগের স্বাদ আর মিলবে না। তথাপি এটাই তো এখন রোমান্সের মূল ধারা হয়ে উঠছে।

সবখানেই মোবাইল ক্যামেরা
শুধু কথা নয়, প্রেমালাপ, ইন্টারনেট ব্রাউজ আর ওয়েব ভিজিট নয়, আরও নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল। আজ মোড়কের গায়ে ছাপা প্রতিটি পণ্যের ছবিই গোড়াতে মোবাইল ক্যামেরায় তোলা। পোর্ট্রেট থেকে শুরু করে স্টিল ছবি সবই তোলা যাচ্ছে মোবাইল ক্যামেরায়। অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক আলোকচিত্রী আজ এই ক্যামেরা ব্যবহার করছে। মোবাইল ফোনের সুবাদে একজন পেশাদার আলোকচিত্রী কতটা অদৃশ্য হয়ে পড়েন। লোকে তাঁকে জনতার মধ্যে আরেকজন ব্যক্তির অতিরিক্ত আর কিছু দেখে না।
পেশাদার ফটোগ্রাফারের এই অদৃশ্য থেকে যাওয়ার গুরুত্ব আছে সহিংসতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর গোলযোগপ্রবণ দেশগুলোতে যেখানে মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা অহরহ পদদলিত। এমন কিছু দেশ আছে যেখানে সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়। সেখানে মোবাইল ক্যামেরা তাদের যে কত সুবিধা করে দিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে তারা গোপনে তুলে আনতে পারে অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতি, অনিয়ম, বিভীষিকা ও বীভৎসতার এমন দৃশ্য যা প্রচলিত ক্যামেরায় নিতে গেলে জীবনের ঝুঁকি থাকে।

ওয়ালেটের দরকার হবে না
সেলফোনের বদৌলতে নগদ অর্থের লেনদেন একদিন হয়ত বন্ধই হয়ে যাবে। এর আর কোন প্রয়োজনই হয়ত থাকবে না। অদূর ভবিষ্যতে আমরা সবকিছুর দাম মোবাইল ফোন দিয়ে শোধ করব। কাগুজে মুদ্রা বা প্লাস্টিকের কয়েনের চেয়ে লেনদেনের কাজে সেলফোনের ব্যবহার হবে আরও দ্রুত ও নিরাপদ।
এ কাজে সেল ফোনের ব্যবহারের বেশ কিছু উপায় ইতোমধ্যে বের হয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপায়টি হলো গুগল ওয়ালেট। এর মুষ্টিমেয় কিছু এনড্রয়েড মডেল চালু হয়েছে। এর জন্য সেলফোনে থাকতে হবে বিশেষ ধরনের চিপ। গুগল ওয়ালেট ছাড়াও আছে ‘স্কয়ার্স পে।’ এর সুবিধা হলো দাম দেয়ার জন্য আপনাকে পকেট থেকে ফোন বের করার দরকার হবে না। দোকানদার ক্যাশ মেশিনের বোতাম টিপে আপনার মোবাইল ফোনের এ্যাকাউন্ট থেকে দাম নিয়ে নিতে পারবে আপনার ক্যাশিয়ার আইডি ও ফটো চেক করে। এই মোবাইল ফোন চুরি গেলে বা হারিয়ে গেলে চিন্তা নেই। দূর থেকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া যাবে। ওয়ালেটের বদলে সেলফোনের ব্যবহারে মাঝে মাঝে বিভ্রাট যে হচ্ছে না তা নয়। তবে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার পথও নিশ্চয়ই বের হবে।

কিছুই গোপন থাকবে না
মোবাইল ফোন আমাদের গোটা জীবন, আমাদের তাবৎ কর্মকা- উন্মোচিত করে দিয়েছে যে কারণে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা এক কঠিন ব্যাপার। এর কল্যাণকর দিকও অবশ্য আছে। চুরি, ডাকাতি ও অন্য অপরাধ দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল ফোন। (বাকি অংশ আগামীকাল)

No comments

Powered by Blogger.