‘সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ’- সংস্কৃতি সংবাদ

সৃষ্টির সম্ভারে স্বমহিমায় দেশের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নন্দিত এই কথাশিল্পীর রচনার ওপর ভিত্তি করেই শক্ত ভিত্তিভূমি পেয়েছে বাংলাদেশের প্রকাশনা ভুবন। আর তাঁর প্রয়াণের ৫২ দিন পর তাঁকে স্মরণ করলেন প্রকাশকবৃন্দ।


শনিবার বিকেলে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির আয়োজনে নানাভাবে স্মরণ করা হয় হুমায়ূন আহমেদকে। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
শরতের বিকেলে হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র অন্তিম যাত্রা প্রদর্শনের মাধ্যমে শুরু হয় এ স্মরণানুষ্ঠান। ইফতেখার মুনিম নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য এ তথ্যচিত্রে উঠে আসে হুমায়ূনের নাটক কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাণের সময়কার বিভিন্ন চিত্রসহ তাঁর জনপ্রিয় নানা বইয়ের প্রচ্ছদ চিত্র। প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী শেষে কোরান তেলাওয়াত ও দোয়া পড়া হয়। এরপর স্মরণসভার শুরুর আগে লেখককে শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে স্মরণসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব সুরাইয়া বেগম এনডিসি এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘ সময়ের স্মরণসভায় লেখককে স্মরণ করে বক্তব্য রাখেন তাঁর ছোট ভাই আহসান হাবীব, হুমায়ূনের প্রথম নাটকের প্রযোজক নওয়াজেশ আলী খান, শিক্ষা সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, লেখক আনিসুল হক, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, প্রকাশক মফিদুল ইসলাম, মাজহারুল ইসলাম, ডা. মোহিত কামাল, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরসহ অনেকে। এছাড়াও এ স্মরণের আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন হুমায়ূনের সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন এবং দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন, দুই মেয়ে নোভা ও শীলা আহমেদ। স্মরণানুষ্ঠানে নোভা আহমেদের হাতে তুলে দেয়া হয় অন্তিম যাত্রা প্রামাণচিত্রের সিডি। স্মরণানুষ্ঠান শেষে প্রদর্শিত হয় হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত চলচ্চিত্র শ্রাবণ মেঘের দিন। অনুষ্ঠানের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ রচিত দু’টি কবিতা আবৃত্তি করেন বাকশিল্পী হাসান আরিফ। আর তাঁর ছোটগল্প একজন ক্রীতদাস থেকে পাঠ করেন আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মোস্তফা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, হুমায়ূন আহমেদকে মৃত্যু দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। তাঁকে সব সময় স্মরণ করতে হবে। তাঁর লেখা পড়ে, নাটক কিংবা চলচ্চিত্র দেখার মাধ্যমেই স্মরিত হবেন। তিনি ছিলেন সেই বিরল সংখ্যক সাহিত্যিকদের একজন, যিনি কিনা এমন চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যা বাস্তবতার জগতকেও নাড়া দিয়ে যায়। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র যেন বাস্তবতার মাঝে বিভ্রম সৃষ্টি করে। তাই এই লেখককে নতুন করে বোঝা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে আমাদের চেতনাকে শাণিত করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, হুমায়ূন আহমেদকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা উচিত। আমি তাঁর একজন বড় ভক্ত। শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য নয়, তাঁর কর্মের জন্য। তাঁর মতো এমন প্রতিভাবান ব্যক্তির সঙ্গে আমার কম পরিচয় হয়েছে। আমি তাঁর প্রতি মুগ্ধ। বাংলা সাহিত্যকে তিনি নতুন মার্গে নিয়ে গেছেন। আর তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান তিনি পাঠক সৃষ্টি করেছে। আশা করব, এই সৃষ্টি বহাল থাকবে। চলচ্চিত্রেও হুমায়ূন সুস্থ ধারার প্রবর্তন করেছেন। সেটাকেও ধরে রাখতে হবে। আর প্রকাশকদের দায়িত্ব হবে তাঁর লেখা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা এবং সব রচনার তালিকা তৈরি করা। তিনি আরও বলেন, হুমায়ূনেরর মৃত্যুতে খুব বেশি শোক করার কিছু নেই। কারণ, তিনি নিজে শোক পছন্দ করতেন না। তাঁর মৃত্যুর পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে এ বিষয়টি জানতে পেরেছি। তিনি শোক-দুঃখ নিয়ে রসিকতা করতেন। সেজন্য তাঁকে আনন্দের মধ্যে স্মরণ করা উচিত।
গল্পচ্ছলে আহসান হাবীব বলেন, অনেকদিন আগের কথা। তখনও দাদা ভাইয়ের (হুমায়ূন আহমেদ) ক্যান্সার ধরা পড়েনি। হঠাৎ একদিন আমাকে বললেন, ডাক্তার ডেকে নিয়ে আয়। সাত সকালে আমি ডাক্তার নিয়ে তাঁর ধানম-ির বাসায় গিয়ে দেখি তিনি লিখছেন। এমন সময় ডাক্তারকে দেখেই তিনি বললেন, এই পর্যন্ত কয়টা রোগী মারছ? দাদাভাই মৃত্যু নিয়ে এভাবেই রসিকতা করতেন। এমনকি তিনি মারা গেলে তাঁর শোকসভায় কে কি বলবে বা কেমন আচরণ করবে সেসব নিয়েও রসিকতা করতেন। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তিনি সব সময় বলতেন, তাঁর মৃত্যু হবে এদেশে, আমেরিকায় কেন হবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমেরিকাতেই তাঁর মৃত্যু হলো।
আনিসুল হক বলেন, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন প্রতিভার বরপুত্র। তিনি লিখেছেন সহজ-সরল পূর্ব বাংলার গদ্যে। তাঁর কারণে এদেশের গদ্য সুন্দর হয়েছে। আর লেখার ক্ষেত্রে তাঁর সেন্স অব হিউমার ছিল অসাধারণ। তিনি ছিলেন হাস্যরসের রাজা। তাঁকে অনুসরণ করেই আমি প্রকৌশলী থেকে লেখক হয়েছি। তিনি আমাদের প্রতিটি দিনকে আনন্দময় করেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। পাঠক তৈরি করেছেন। এদেশের প্রকাশনা জগতকে তিনি গড়ে দিয়ে গেছেন। তিনি না থাকলে প্রকাশনা শিল্প এত সমৃদ্ধ হতো না। আর তাঁর মৃত্যুর পর সারাদেশের এত লোক কেঁদেছে, পৃথিবীর আর কোন লেখককে নিয়ে এমন উন্মুাদনা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
মফিদুল হক বলেন, প্রকাশনা শিল্পে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ওয়ান ম্যান বুক ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল। ছোট-বড় অনেক প্রকাশককেই তিনি গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমে এদেশের প্রকাশকরা যা পেয়েছেন তা সহজে মেলে না। পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁর বই কিনেছে। তিনি এক জীবনে যত কাজ করেছেন, তার মধ্যে প্রকাশনা শিল্পে রেখেছেন বিশাল ভূমিকা।
ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী বলেন, হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন লেখককে পেতে হলে আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর কারণে বাংলা একাডেমীর বইমেলা ঔজ্জ্বল্য পেয়েছিল। লাইন ধরে পাঠকের বই কেনার সেই দৃশ্য হয়ত আর দেখা যাবে না। আর তাই মৃত্যুর পর পাঠকের কাছ থেকে যে ভালবাসা পেয়েছেন, তা ছিল এই লেখকের জীবনের আসল জয়মাল্য। এ সময় শিক্ষা সচিব হুমায়ূন আহমেদের নেত্রকোনায় গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহীদ স্মৃতি বিদ্যা নিকেতনের জন্য সরকারী সহায়তার আশ্বাস দেন।
ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, হুমায়ূন আহমেদের বহু সাহিত্যকর্ম ও নাটক হারিয়ে যাচ্ছে। বিটিভিতে তাঁর অনেক নাটক ও মাগ্যাজিন অনুষ্ঠান রয়েছে, বিশেষ করে তাঁর ম্যাজিক শো ও গানের অনুষ্ঠানের টেপের অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের এখন উচিত তাঁর এসব সৃষ্টিকর্মকে বাঁচিয়ে রাখা। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।’
সালেহ চৌধুরী বলেন, হুমায়ূন উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, নুহাশ পল্লীÑযা করেছে তার কিছুই নিজের জন্য করেন নি। তিনি সবার জন্য এসব সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন। আমাদের সে সৃষ্টিকর্মকে ধরে রাখতে হবে।
ছায়ানটের নজরুল প্রয়াণ দিবসের অনুষ্ঠান ॥ শনিবার শরতের সন্ধ্যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। ধানম-ির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে গানে গানে স্মরণ করা হয় জাতীয় কবিকে। শুরুতেই ছিল ক্ষুদে শিল্পীদের কণ্ঠে সম্মেলক গানের পরিবেশনা। তারা গেয়ে শোনায় ‘জাগো অমৃত-পিয়াসী-চিত আত্মা-অনিরুদ্ধ’ ও ‘হে পার্থসারথী! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ’ শিরোনামের দুটি গান। শিশুদের গানের পালা শেষে গান শোনান লায়েকা বশির, সাদিয়া ইসলাম লতা, মেহ্নাজ আফরিন, মনীষ সরকার, স্বর্ণা নাগ, মাকসুদুর রহমান, মোহিত খান, অর্পিতা চক্রবর্তী, সালেহা তুজ জোহরা, তানভীর আহমেদ, শ্রাবন্তী ধর, কানিজ হুসনা আহম্মদী সিম্পী, দিদারুল করিম, সুস্মিতা দেবনাথ প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.