গার্মেন্টস মালিকদের বেকায়দায় ফেলার চক্রান্ত চলছে- অভিযোগ বিজিএমইএ’র ॥ শ্রমিক নেতাদের অভিযোগÑ ছাঁটাই ও মজুরি শোধ না করায় অস্থিরতা by তৌহিদুর রহমান

সরকার ও পোশাক শিল্প মালিকদের বেকায়দায় ফেলে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার চক্রান্ত চলছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে আবারও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।


সমস্যা সমাধানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে জরুরী সভা ডাকার আহ্বান জানিয়েছে পোশাক শিল্প মালিকদের এই সংগঠন। অপরদিকে শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিক ছাঁটাই ও মজুরি পরিশোধ না করার জন্য এ খাতে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি আশুলিয়া-সাভার এলাকার বিভিন্ন পোশাক শিল্প কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ঈদের ছুটির পরে কারখানা খোলা হলে বেশ কয়েকটি কারখানায় শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে। মূলত শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে এসব কারখানায় অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ প্রেক্ষিতে গত ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গার্মেন্টস এ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের বরাবর সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চিঠি দেয়। চিঠিতে জরুরীভাবে সভা ডাকার জন্য আহ্বান করা হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘একটি স্বার্থান্বেষী কুচক্রীমহল রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নানা ধরণের উস্কানি, ইন্ধন দেয়ার মাধ্যমে এ খাতকে আবার অস্থিতিশীল করার মধ্যে দিয়ে সরকার এবং পোশাক শিল্প মালিকদের বেকায়দায় ফেলে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার চক্রান্ত করছে। আপনি ইতোমধ্যে অবগত আছেন, ইদ-উল-ফিতরের ছ’টির পরে কারখানা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আশুলিয়া এলাকায় এজাক্স সোয়েটার, ওপেক্স সোয়টার লিমিটেড, টেক্সটাউন লিমিডেড, ভিনটেজ গার্মেন্টস লিমিটেড, এনডি এ্যাপারেলস লিমিটেড, ক্রসওয়্যার লিমিটেড, সাউদার্ন মিলেনিয়াম গার্মেন্টস লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল গার্মেন্টস লিমিটেড, ডেকো গার্মেন্টস লিমিটেডসহ বিভিন্ন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের আঘাত, ভাংচুর, মারামারি, জোরপূর্বক শ্রমিকদের কাজ করতে না দেয়াসহ ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আবার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। এছাড়াও বিভিন্ন লিফলেট, হাতে লেখা চিরকুট পাওয়া যাচ্ছে। গত জুলাই মাসের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পাঁয়তারা মনে হচ্ছে। এ ব্যাপারে শ্রম অধিদফতর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা অবগত আছে। এখনই শক্ত হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে যে কোন সময় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, যা আদৌ কারও কাম্য নয়।’
বিজিএমইÑএর চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়-এ অবস্থায় সদয় হস্তক্ষেপ ও নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের হীনচক্রান্ত নস্যাত করার লক্ষ্যে আইজিপি, ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি প্রধান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ প্রতিনিধি সমন্বয়ে জরুরী সভা আহ্বান করার জন্য অনুরোধ করছি।’
বিজিএমইএর চিঠির অনুলিপি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছেও দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি সপ্তাহে এ বিষয়ে একটি বৈঠক ডাকা হবে।
জানা গেছে, গত ২৯ আগস্ট সাভার ও আশুলিয়ার তিনটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। এর মধ্যে দুটি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে ও অপর একটি কারখানার অপারেটরের মধ্যে কথা কাটাকাটির জের ধরে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। পরে কারখানাগুলোতে দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এই কারখানা তিনটি হলো- সাভার পৌর এলাকার দক্ষিণ দরিয়াপুরে অবস্থিত জে. কে. গার্মেন্টস, আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকায় অবস্থিত ক্রসওয়্যার লিমিটেড ও টেক্সটাউন গার্মেন্টস লিমিটেড।
জে. কে. গার্মেন্টসের শ্রমিকদের দাবি, তারা ১০ দিন ঈদের ছুটি কাটিয়ে গত ২৫ আগস্ট কাজে যোগদান করেন। এই ১০ দিনের ছুটির মধ্যে শ্রমিকদের প্রাপ্য বার্ষিক ছুটি থেকে চার দিন কেটে নেয়া হয়। শ্রমিকরা তাদের নৈমিত্তিক (সিএল) ছুটি থেকে চার দিনের ছুটি কেটে নেয়ার দাবি জানালেও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের মেডিক্যাল ছুটি থেকে ৪ দিন কেটে নেয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা ওই দিন সকাল থেকে তাদের দাবি মেনে নেয়ার জন্য কর্মবিরতি পালন করে। এরপর নোটিস বোর্ডে তালিকা টানিয়ে ১৩৪ শ্রমিককে ছাঁটাই (টার্মিনেট) করে জে. কে. গার্মেন্টস মালিকপক্ষ। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে এবং ছুটির ব্যাপারে তাদের দাবি মেনে নেয়ার দাবিতে তারা কারখানার সামনে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করলে পরে থানা পুলিশ ও শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাঠিচার্জ করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশের লাঠিচার্জে প্রায় ১০ শ্রমিক আহত হয়। শ্রমিকদের দাবি, সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের ছাঁটাই করা হয়েছে।
শিল্প পুলিশ সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় জে. কে. গার্মেন্টসের কয়েক শ্রমিক সামান্য অজুহাতে কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। সিসি ক্যামেরায় তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করত কারখানা কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ঈদের নির্দিষ্ট ছুটির পরও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কিছুসংখ্যক শ্রমিক অতিরিক্ত ছুটি কাটিয়ে কারখানায় যোগ দেয়। বিভিন্ন সময়ের এ ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ দেখিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ ১৩৪ শ্রমিককে অব্যাহতি (টার্মিনেট) দিয়ে একটি নোটিস টানিয়ে দিলে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। এ ধরনের নোটিস দেখে কারখানার প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক বিক্ষোভ করে।
এছাড়া ওই একই দিনে সহকর্মী এক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে এমন খবর পেয়ে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের কাঠগড়া এলাকার ক্রসওয়্যার লিমিটেডের শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ সময় তারা কর্মবিরতিসহ কারখানার বাইরে এসে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অপরদিকে, একই এলাকায় গত ২৯ আগস্ট টেক্সটাউন নামের অপর একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। এ কারখানার একজন কাটিং মাস্টারের সঙ্গে অপর একজন কাটিং অপারেটরের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। এরপর ওই কারখানার শ্রমিকরা ওই ঘটনার বিচারের দাবিতে অন্য শ্রমিকদের কাজে যোগদান করতে বাধা দেয়। এ সময় কারখানার সামনে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করে। সম্প্রতি এমন ধরনের বিভিন্ন ঘটনা ঘটে চলছে আশুলিয়ার নানা কারখানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তপন সাহা শনিবার জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের পরে বেশ কয়েকটি পোশাক শিল্প কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। এজাক্স সোয়েটারের ৬৫ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। এছাড়া তোবা গ্রুপের এক শ’ জন শ্রমিককে অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে। এসব ছ্াটাইয়ের প্রতিবাদে শ্রমিকরা মিছিল করলেই বলা হচ্ছে অস্থিতিশীলতা তৈরির পাঁয়তারা চলছে। কোন ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে না। শ্রমিকরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে আন্দোলন করছেন। আর এ নিয়ে মালিকপক্ষের লোকজনই শ্রমিকদের উল্টো হুমকি দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ঈদের আগে ১১ জুন থেকে টানা আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে। সে সময় প্রতিদিন সড়ক অবরোধ করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় শ্রমিকরা। বেশ কয়েকটি কারখানা ভাংচুর করে শ্রমিকরা। এরপর সরকার কারখানা মালিক ও শ্রমিক নেতাদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালেও অস্থিরতা চলতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে আশুলিয়া এলাকার সব কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। এরপর ১৭ জুন থেকে আশুলিয়ার সকল পোশাক কারখানা টানা চারদিন বন্ধের পর শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও মালিকপক্ষের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করে ২১ জুন কারখানা খুলে দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.