রং-বেরঙের ঘুড়ি, ঈগল প্রজাপতি ও রূপচাঁদা হৃদয়ে প্রশান্তি- জাতীয় ঘুড়ি উৎসব by মনোয়ার হোসেন

 আকাশে ঘুড়ি উড়লে বিষণœ মনটাও যেন প্রফুল্ল হয়ে যায়। ঘুড়ির রংগুলো যেন ছড়িয়ে পড়ে মনের দিগন্তে। সেই রঙের বর্ণময়তায় প্রশান্তি বয়ে যায় হৃদয়ে। আর এমন প্রশান্তির আনন্দময়তার আবহ ছড়িয়ে ছিল শুক্রবার কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে।
আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল লাল-নীল, হলুদ-সবুজ, খয়েরি, কমলা এমন নানা রঙের ঘুড়িতে। আর ঘুড়িগুলোরও ছিল নানা রূপ। বাজপাখির রূপ নিয়ে নীল আকাশে, উড়ে বেড়াল বর্ণিল ঘুড়ি। শুধু যে বাজপাখি ছিল ঘুড়ির আকৃতিতে তা নয়। বক, মৎস্য কুমারী, রূপচাঁদা, বাদুর, প্রজাপতি, ঈগল, উড়োজাহাজ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সান্তাক্লজ এমনও নানা বৈশিষ্ট্যের ঘুড়ি ওড়াউড়ি করেছিল ওই আকাশের আঙ্গিনায়। বিকেল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলল ঘুড়ির খেলা। আর ঘুড়ি নিয়ে এমন মজার উৎসবে যোগ দিয়েছিল শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষ। বিদেশী পর্যটকরাও মহাউৎসাহে শামিল হয়েছিল এই উৎসবে। সবার মনটাই যেন ঘুড়ির মতোই উড়তে চেয়েছিল উর্ধাকাশে।
শুক্রবার সকাল থেকেই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভিড় জমিয়েছিল ঘুড়িবাজরা। বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের ছায়াতলে। এই ফেডারেশনের আয়োজনেই বসেছিল জাতীয় ঘুড়ি উৎসব। এবারের উৎসবের সেøাগান ছিল ‘প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব সবার/ধর্ম যার যার, উৎসব-আনন্দ সবার। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেলের শুরু তখনই যেন উৎসবের শুরু। একে একে ঘুড়ি উড়তে থাকল আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন লাবণী পয়েন্টের সামনের আকাশটায় ছড়াল নানান রং। নানা রঙের সঙ্গে দেখা মিলল নানা আকৃতির জীববৈচিত্র্যের ছটা।
বিকেল সাড়ে চারটায় প্রধান অতিথি হিসেবে উৎসব আঙ্গিনায় এলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী ফারুক খান। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলেন বিশেষ অতিথি চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিং। দু’জন মিলে ঘুড়ি উড়িয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতার সূচনা করলেন। এরপর গোটা আকাশটাই যেন চলে গেল ঘুড়িবাজদের দখলে। শতাধিক রকমের হাজারও ঘুড়ি উড়ে বেড়াল সমুদ্র হাওয়ায়। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ঘুড়ি ফেডারেশনের সভাপতি এ আর খান, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মৃধা বেনু, স্থানীয় জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন, বিটিভির মহাপরিচালক ম. হামিদ ও প্রবীণ সাংবাদিক বিভূ রঞ্জণ সরকার।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ফারুক খান বলেন, দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশ ও মানোন্নয়নে কক্সবাজারের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। এখানের পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য সরকার বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরও স্বাগত জানিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘুড়ি উৎসব পর্যটন শিল্প বিকাশে ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মন্ত্রী। নতুন আশার কথা জানিয়ে বলেন, কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বিকাশে চীনা বিনোয়োগকারীদের একটি দল এখানে অবস্থান করছে। তারা ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
উৎসবের অতিথি বিভূ রঞ্জণ সরকার জানালেন এদেশের ঘুড়ির ঐতিহ্যের কথা। বললেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আমাদের মাঝ থেকে ঘুড়ি ওড়ানোর অভ্যাস বিলুপ্তির পথে। একটি ঘুড়ি আকাশে উড়লে উর্ধমুখী হওয়ার প্রবণতা ভর করে সেই ঘুড়িবাজের মনে। মনটা হয়ে যায় বিশাল। নতুন প্রজন্মের মাঝে এই উর্ধমুখী হওয়ার প্রবণতাটাকেই ছড়িয়ে দিতে হবে।
ঘুড়ি উৎসবে ঢাকার ওয়ারী থেকে পরিবারের সঙ্গে এসেছিল ‘ও’ লেভেলের ছাত্রী ফারাহানাজ আলী সিথি। দারুণ উচ্ছ্বাসিত এই কিশোরী বলল, জীবনে এই প্রথম ঘুড়ি নিয়ে কোন উৎসবে এসেছি। উড়িয়েছি দুই-একটি ঘুড়ি। এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিন মনে থাকবে সমুদ্রসৈকতের এই উৎসবের কথা। সিথির মতো এমনই অনুভূতি ছিল মোশারেত ইমরাত সাদাতেরও।
উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকার কলাবাগানের কর্মজীবী নারী লায়লা ফেরদাউস ন্যান্সি। উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললেন, নগর জীবনের যান্ত্রিকতা থেকে একটু আনন্দের খোঁজে এসেছিলাম কক্সবাজারে। বেড়ানোর সঙ্গে বাড়তি প্রাপ্তি হয়ে রইল এই ঘুড়ি উৎসব। দারুণ মজায় কেটে গেল সারাটা বিকেল।
উৎসবের শেষ দিন আজ শনিবার। সুগন্ধা পয়েন্টে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেয়া হবে হট এয়ার বেলুন। এরপর সকাল ৯টায় থাকবে ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতা। দুপুর ২টায় থাকবে আধুনিক ঘুড়ি প্রতিযোগিতা। বিকেল ৫টায় অপশক্তি রুখতে অনুষ্ঠিত হবে সাম্প্রদায়িক দানবদাহ। এরপর সন্ধ্যায় থাকবে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও আলোকিত ঘুড়ি উড্ডয়ন। সবশেষে সমুদ্র আকাশে ওড়ানো হবে ২৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে মহাঘুড়ি।

No comments

Powered by Blogger.