আখাউড়া থেকে বাণিজ্য কমছে

রপ্তানিনির্ভর আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্য কমছে। অবকাঠামোর দুর্বলতা ও বাণিজ্যসহায়ক সুবিধা না থাকায় রপ্তানিকারকেরা এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
এক বছর আগেও এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই শ পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের ত্রিপুরায় যেত। এখন প্রতিদিন ৭০-৭৫টি ট্রাক যায়।
অবকাঠামোর দুর্বলতা, লোকবলসংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত আখাউড়া স্থলবন্দর। সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থলবন্দরের ১৫ একরের বিশাল ইয়ার্ড (পণ্য ওঠানো-নামানোর স্থান) থাকলেও তা ব্যবহার হয় না। স্থলবন্দর এলাকার নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ। স্থলবন্দরের মাঠে ধানের চাষ করা হয়।
অথচ ভারত, ভুটান ও নেপালকে যে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে, তাতে আখাউড়া স্থলবন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর হিসেবে রয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌ—সব পথেই আখাউড়া স্থলবন্দরকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ট্রানজিট-সুবিধা নিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যাওয়ার মূল প্রবেশদ্বার হিসেবে আখাউড়া স্থলবন্দরই বিবেচিত হচ্ছে।
বাণিজ্য কমছে: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে মাছ, পাথর, সিমেন্ট, চিটাগুড়, পাট ও পাটজাতীয় দ্রব্য, প্লাস্টিক ও মেলামাইনের সামগ্রী, কোমল পানীয় রপ্তানি হয়। কদাচিৎ ভারতের পণ্য আসে। কয়েক মাস আগেও এই স্থলবন্দর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে দৈনিক দেড় থেকে থেকে দুই শ পণ্যবাহী ট্রাক যেত। বর্তমানে ৭০ থেকে ৭৫টি ট্রাকে করে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, ত্রিপুরার আগরতলা স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের অসহযোগিতায় এই বন্দর দিয়ে রপ্তানি কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলাতে পারে, এমন আশঙ্কায় ওপারের আমদানিকারকেরাও কিছুটা ধীরে চল নীতি গ্রহণ করেছেন। এতে এই বন্দর দিয়ে রপ্তানি বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ত্রিপুরাসহ আশপাশের সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের একটি বড় বাজার রয়েছে। আগরতলা কাস্টমস বিভাগ শুল্কায়নে গড়িমসি করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পণ্যবোঝাই ট্রাককে অপেক্ষা করতে হয়। আবার আগরতলা স্থলবন্দরে শ্রমিক ধর্মঘট লেগেই থাকে। এতে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
রপ্তানির নামে শুভংকরের ফাঁকি: আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় মাছ। স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে দুই কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে মাছ রপ্তানির পরিমাণ দেড় কোটি টাকা। আগরতলার বাজারে এই মাছ বিক্রি হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই মাছ রপ্তানির আড়ালে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। কাগজে-কলমে মাছ রপ্তানি হয়। এতে একজন বাংলাদেশি রপ্তানিকারক, আর আগরতলার একজন আমদানিকারক থাকেন। বাংলাদেশি রপ্তানিকারক এলে প্রতিনিধির মাধ্যমে আগরতলার পাইকারি বাজারে মাছ বিক্রি করেন। আগরতলার ‘মাছ আমদানিকারক’ মূলত বাংলাদেশি মাছ ব্যবসায়ীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। এ জন্য তিনি ৮ শতাংশ হারে কমিশন পান। তিনি এলসির বিপরীতে ‘বৈধ পথে’ অর্থ পাঠিয়ে দেন মাছ বিক্রেতার ব্যাংক হিসাবে।
এভাবেই কাগজে-কলমে চলে মাছ রপ্তানি। এই বিষয়ে মাছ রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউ মুখ খোলেননি।
একইভাবে বাংলাদেশের পাথর ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন আগরতলার ব্যবসায়ীরা। সিলেটে বোল্ডার (বড় পাথর) ভেঙে পাথর ছোট করা হয়। সেখান থেকে ট্রাকে করে আনা হয় আখাউড়ায়। পরে তা রপ্তানি হয় ত্রিপুরায়। ভাঙা থেকে পরিবহন পর্যন্ত বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরাও পুঁজি খাটাচ্ছেন।
সরু রাস্তা, বিপজ্জনক বাঁক: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার সড়কটি ১৫ থেকে ১৮ ফুট প্রস্থ। দুটি পণ্যবাহী ট্রাক মুখোমুখি পার হতে কষ্ট হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। আখাউড়া পৌর শহরের নারায়ণপুর এলাকার প্রায় দেড় শ গজের বেশি অংশ দেবে গেছে। সরু রাস্তা ও বিপজ্জনক বাঁকের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রাক শ্রমিক সমিতির সভাপতি স্বপন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সড়কটির নারায়ণপুর এলাকায় বড় আকারে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এই অংশ পার করার সময় রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো প্রায় সময়ই আটকে যাচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে ট্রাকের চাকা ও যন্ত্রাংশের।

No comments

Powered by Blogger.