ভাব ও রূপের বৈচিত্র্য আবেগ রসমাধুর্য মানুষের প্রতি মমত্ব- শিল্পকলায় সপ্তাহব্যাপী লোক উৎসব শুরম্ন

সৈয়দ সোহরাব লোকসঙ্গীতের ধারাটিই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূলধারা। এ ধারার এক অনিঃশেষ রত্নভা-ারও আছে আমাদের। ভাব ও রূপের বিপুল বৈচিত্র্যে, রসমাধুর্যে, যুগপৎ সারল্য ও গভীরতায়, সংখ্যার বিপুলতায়, আবেগের তীব্রতায় বাংলার এ লোকসঙ্গীত বিশ্ব সঙ্গীতসভায়ও উচ্চাসনের দাবিদার। এর অসাম্প্রদায়িক সহজিয়া চরিত্রই বাংলার মানুষের মানসিকতাকে করেছে নির্মাণ।
অথবা বলা যায় বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক সহজিয়া চরিত্রই লোকসঙ্গীতের এ পুণ্য ধারাকে নির্মাণ করেছে হাজার বছর ধরে। তাই এ ধারার বিপুলতা, সমৃদ্ধি আবহমান বাংলার সার্বিক সমৃদ্ধিরই নির্দেশক। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনাচার, সংগ্রামের ইতিহাস, উৎপাদনের মাঠে কৃষক-শ্রমিকের ঘাম, কিংবা চোখের জলে সেচ দিয়ে ফসলের কাল গোনা এসবই লোকসঙ্গীতের উপাদান। আর এই গানই আমাদের চৈতন্যোদয় ঘটিয়েছে শ্রেণী শোষণের বিরম্নদ্ধে, সাহস দিয়ে বলেছে-কাসত্মেধরা কড়া হাতে রম্নখব সবাই অত্যাচার। কিন্তু বর্তমানে অপসংস্কৃতি আর প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার বোনোজলে অর্ধনিমজ্জিত দেশকে মূলধারার পুণ্যসলিলে ফিরিয়ে আনতে লোকসঙ্গীতকেই বেছে নিয়েছে শিল্পকলা একাডেমী। এ গীতের বিলীয়মান ধারাসমূহের পুনরম্নদ্ধার, গবেষণা ও ব্যাপক চর্চারও উদ্যোগ নিয়েছে একাডেমী। এ উপলৰে আয়োজন করেছে সপ্তাহব্যাপী লোকসঙ্গীত উৎসবের। এই সাত দিনে সাত লোকসাধককে স্মরণ করবে একাডেমী। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার এ উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন।
উৎসবের উদ্বোধনী দিনে একাডেমী স্মরণ করে বাউল সাধক শাহ আব্দুল করিমকে। তাকে নিয়ে আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন একাডেমীর মহাপরিচালক কামাল লোহানী। মুখ্য আলোচক ছিলেন সুমন দাস। শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন সঙ্গীত ও নৃত্যকলা বিভাগের পরিচালক মাহমুদ সেলিম। বক্তারা এই সাধক পুরম্নষ প্রসঙ্গে বলেন, ভাটি বাংলার সুর আর হৃদয়ের টানে এখনও তিনি গীতরসে আপস্নুত করে রেখেছেন বাঙালী ও বাংলাভাষীকে। প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের প্রতি এই কবির ছিল অকৃত্রিম যোগ। প্রকৃতি প্রেম, নির্সগচিত্র, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবন, ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি চেতনায় আস্থাবান ছিলেন এই কবি। এ কারণেই তিনি হয়ে আছেন গণমানুষের কবি, প্রতিবাদী এক চারণ বাউল। জীবদ্দশায় চষে বেড়িয়েছেন সমগ্র ভাটি বাংলা। তাই তাঁর রচিত পঙক্তিমালায় ফুটে উঠেছে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ বঞ্চিত মানব জীবনের নির্যাস, শাসক-শোষণের নিপীড়ন, অন্যায় অবিচারের বিরম্নদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চারণ এবং সেই সঙ্গে তাঁর জন্মভূমি ও মাটি-মানুষের প্রতি মমত্ববোধের কথা। বক্তারা আরও বলেন, বাউল করিম সারাজীবনই প্রেমকে প্রধান অবলম্বন করে জগত জীবনের রহস্যময়তাকে খুঁেজ ফিরেছেন। তাই ধর্ম বিচার না করেই গেয়েছেন প্রেমের জয়গান।
সাংস্কৃতিক পর্বে শাহ আব্দুল করিমের কালজয়ী ও দশর্কপ্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনান সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাউল শিল্পীরা। তাঁদের পরিবেশিত উলেস্নখযোগ্য গানগুলো হলো-আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম..., গাড়ি চলে না, চলে না, চলে নারে..., করিমনা কাম ছারেনা..., মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়নারে..., সখি কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে..., মানুষ হয়ে জন্মেছিতো বাঁচতে চাই মানুষের মতো..., খাজা তোমার প্রেম বাজারে আমি কাঙ্গাল যেতে চাই..., রক্ত দিয়ে স্বাধীন হলাম দুর্দশা কেন যায় না..., আর কিছু চায়না মন গান ছাড়া... প্রভৃতি গান। এছাড়া মিশ্র লোকসঙ্গীতও পরিবেশিত হয় এ অনুষ্ঠানে। আর এসব গান গেয়ে শোনান আবদুর রহমান, বশিরউদ্দিন সরকার, অনিমা মুক্তি গোমেজ, লাইলী পারভীন, রম্নপক চৌধুরী, সুতপা রায়, কানন বালা সরকার, বকুল বয়াতী ও তাঁর দল, কাঙ্গালিনী সুফিয়া প্রমুখ। নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যলোক, নৃত্যধারা ও অভিব্যক্তি।
সপ্তাহব্যাপী এই লোক উৎসবে আজ মঙ্গলবার আরেক বাউল সাধক বৈষ্ণব ধারার অন্যতম কবি রাধারমন দত্তকে নিয়ে আলোচনা ও গানের আয়োজন রাখা হয়েছে। এতে মুখ্য আলোচক হলেন অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা। এভাবেই আগামী রবিবার পর্যনত্ম ধারাবাহিকভাবে বিজয় সরকার, হাছন রাজা, জালাল খাঁ, কবিয়াল রমেশ শীল এবং সমাপনী দিন বাউল সম্রাট লালন শাহ্র আধ্যাত্মিক গান ও তাঁকে নিয়ে আলোচনার আয়োজন থাকছে।

No comments

Powered by Blogger.