একদিকে বর্জ্য নিষ্কাশন, অন্যদিকে নির্বাধ বর্জ্য নিৰেপ- বুড়িগঙ্গা সমাচার by শাহীন রহমান

সালাহউদ্দিন মিয়া বুড়িগঙ্গার বর্জ্য পরিস্কারের কাজ শুরম্ন হলেও বর্জ্য উৎপাদনকারীদের বিরম্নদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। আগের মতোই নদীর দু'তীর থেকে বর্জ্য সমানে মিশছে নদীতে। ট্যানারি বর্জ্য, ডায়িং শিল্পের বর্জ্য, পয়োবর্জ্য এবং পলিথিন তো আছেই।
পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার কেমিক্যাল, পশুর চামড়ার রক্ত, রায়ায়নিক পদার্থযুক্ত ড্রাম, চটের ছালা ও পলিথিন_ সবই ধোয়া মোছার কাজ চলছে নদীর পানি দিয়ে। এমন কোন দূষিত পদার্থ অবশিষ্ট নেই যা বুড়িঙ্গাকে হজম করতে হচ্ছে না। প্রকাশ্যে এসব কাজ করলেও দেখার যেন কেউ নেই। সংশিস্নষ্টদের মতে, বুড়িগঙ্গাকে সবচেয়ে বেশি ৰতি করছে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প এবং নদীর তীরে ডায়িং প্রিন্টের পানি। হাজারীবাগের ট্যানারির বর্জ্যে দুর্গন্ধ হচ্ছে পানি। আর ডায়িং শিল্পের পানিতে নদীর পানি ধারণ করছে কালো রং। তাঁদের মতে, একদিকে বর্জ্য পরিষ্কার, অন্যদিকে দূষিত পদার্থ নদীতে ফেলা হলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও সফলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। সরকার যেহেতু বর্জ্য পরিষ্কারের মতো কঠিন একটি কাজে হাত দিয়েছে, কেউ যাতে নতুন করে কোন দূষিত পদার্থ নদীতে ফেলতে না পারে তা রোধ করার জন্য কঠোর পুলিশী পাহারার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান বর্জ্য ট্রিটমেন্ট না করে নদীতে ফেলছে তাদের আইনের আওতায় এনে শাসত্মির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। পাশাপাশি অন্য কোন উৎস থেকে পানি এনে নদীর প্রবাহ বাড়িয়ে দূষিত পানি বের করে দিতে হবে।
বুড়িগঙ্গার পানি বর্তমানে আলকাতরার রং ধারণ করেছে। পাড়ে গেলে এর উৎকট গন্ধে সরাসরি নাকে এসে লাগে। এক কোটির বেশি লোকের বসবাস ঢাকা শহরে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গার উভয় তীরে রয়েছে ২০ লাখ লোকের বসবাস। আর কেরানীগঞ্জে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখের ওপরে। এত অধিক সংখ্যক লোকজনের পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশনের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সরাসরি মিশছে বুড়িগঙ্গায়। ফতুলস্না থেকে গাবতলী পর্যনত্ম নদীর দু'তীরে রয়েছে কয়েক হাজার মিল-কলকারখানা, ট্যানারি এবং ডায়িং প্রিন্টের ফ্যাক্টরি। এগুলো বর্জ্য ফেলার একমাত্র পথ বুড়িগঙ্গা নদী। সংশিস্নষ্টরা বলছেন, বুড়িগঙ্গাকে সবচেয়ে বেশি ৰতি করছে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প এবং নদীর তীরে ডায়িং প্রিন্টের পানি। ট্যানারির বর্জ্যে পানি হয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ এবং ডায়িং শিল্পের পানিতে কালো রং ধারণ করছে। এ ছাড়া যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে পোড়া মবিল তেল নিয়মিত পড়ছে। সরে জমিনে দেখা গেছে, নদীর তীরে শ্যামপুর, ফতুলস্না, আরশিন গেট, মিল ব্যারাকের নর্দমা, মিটফোর্ডের নর্দমা, চাঁদনীঘাটের নর্দমা, হাজারীবাগের ট্যানারির দুর্গন্ধজনিত ময়লা, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ফেরিঘাটের নর্দমা এবং শুভাঢ্যা খালের পয়ঃনালীর দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা_সবই পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। বিশেষ করে সদরঘাট টার্মিনালের দৰিণ পাড়ে শুভাঢ্যা খালে বর্জ্য ছাড়া এখন পানি বলতে কিছুই নেই। এখানে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার গার্মেন্টস কারখানা ও তার শোরম্নম। পয়ঃবর্জ্য, গোসল ও ধোয়া মোছার সব পানি এই খাল হয়ে মিশছে নদীতে।
পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গার উভয় পাশে যত প্রকার কলকারখানা রয়েছে তার বেশির ভাগেরই ছাড়পত্র নেই। এ ছাড়পত্রবিহীন কারখানাগুলো বুড়িগঙ্গাকে দূষিত করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অধিদফতরের পৰ থেকে সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয় সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এই সুপারিশ মালার ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন অনুযায়ী অচিরেই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে। পরিবেশ অধিদফতরের সুপারিশমালায় বলা হয়েছে নদী তীরবর্তী মার্কেট, বিভিন্ন পণ্যের বাজার, নৌ-টার্মিনাল ও জলযানসহ বিভিন্ন উৎস থেকে আবর্জনা বা পলিথিন নদীতে না পড়ে সেদিকে নজর দেয়া এবং এ বিষয়ে প্রচারণা জোরদার করা জরম্নরী। অন্য কোন উৎস থেকে পানি এনে নদীর প্রবাহ বাড়ানো, নদী দূষণের জন্য দায়ী কারখানাগুলোর বিরম্নদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক জামশেদ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নদীর উভয় পাড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব প্রতিষ্ঠানই নদী দূষণের জন্য দায়ী। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের এনভায়রনমেন্ট ট্রিটমেন্ট পস্নান (ইটিপি) বসানোর কোন ব্যবস্থা নেই। আবার অনেক ক'টির বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ৰেত্রে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য দায়ী তাদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে ইটিপি স্থাপনের জন্য নোটিস দেয়া হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নোটিস অনুযায়ী কাজ করবে না তাদের বিরম্নদ্ধে মন্ত্রণালয়ের গাইড লাইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তা অচিরেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর বর্জ্য পরিষ্কারের পাশাপাশি নদী দূষণের সব দুষ্কর্মের বিরম্নদ্ধে কার্যকর পদৰেপ না নিলে কোটি টাকার প্রকল্পের অপচয় ছাড়া কোন কাজে আসবে না। গোড়ায় গলদ রেখে কাজ করা হলে তা হবে ফুটো কলসিতে পানি ঢালার মতো। নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, চৌবাচ্চার নিচে ছিদ্র রেখে ওপরে পানি ঢেলে কোনদিন চৌবাচ্চা ভরা যাবে না। তিনি বলেন, দূষণকারীদের বিরম্নদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারপর দূষণ প্রক্রিয়া রোধ করতে হবে। এরপর নদীর পানি শোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী দূষণকারীদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। নতুন আইনের কোন প্রয়োজন নেই। বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে নদীর তলদেশ থেকে পলিথিন উত্তোলন করা হচ্ছে। যে পলিথিনের জন্য নদীর এই সর্বনাশ হতে চলেছে সেই পলিথিন উৎপাদন এখনও অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, পলিথিনের উৎপাদন অব্যাহত রেখে নদী দূষণমুক্ত করা যাবে না।
এদিকে বুড়িগঙ্গার পানি পরিষ্কার এবং ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে যমুনা নদী থেকে খাল কেটে অথবা নদীতে ফো বাড়িয়ে বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি বের করে দেয়া হবে। এটা করতে পারলে নদীতে ব্যবহার উপযোগী পানি পাওয়া যাবে। বুড়িগঙ্গার বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ এখনও অব্যাহত রয়েছে। বিআইডবিস্নউটিএ সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। যার ওজন ২৭ হাজার টনের বেশি। প্রথম পর্বে ৩ লাখ ঘনমিটার বজর্্য অপসারণ করা হবে বলে জানান, প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম।

No comments

Powered by Blogger.