দাঁতের সব রোগ- টুথপেস্টের মন্দ রসায়ন

দাঁতের পরিচর্যায় একটি ভাল টুথপেস্ট অপরিহার্য। টুথপেস্টের পাশাপাশি মানসম্পন্ন টুথব্রাশের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। কিন্তু অনেক টুথপেস্টের মাঝে কোন্ টুথপেস্ট ব্যবহার করা ভাল তা নিয়ে সর্বসাধারণের মনে প্রশ্নের কোন শেষ নেই।
টুথপেস্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সব বাহারি বিজ্ঞাপন প্রচার করে যা অবলোকন করলে মনে হয় সবই ভাল। অবস্থা এমন যে কোনটা ছেড়ে কোনটা ব্যবহার করি। আবার কোন কোন টুথপেস্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রচার করে তাদের টুথপেস্ট বিশেষ সংস্থা কতর্ৃক অনুমোদনকৃত। কিন্তু অনুমোদন কিভাবে হলো, অনুমোদনের প্রক্রিয়া বা অনুমোদনের মাঝে কোন স্বার্থসংশিস্নষ্ট গোপনীয় কিছু লুক্কায়িত আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়। সবচেয়ে বড় সত্য কথা হলো পৃথিবীর কোন স্থানে এমন কোন টুথপেস্ট নেই যার মধ্যে দাঁত ও মুখের জন্য উপকারী সব উপাদান বিদ্যমান। ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের টুথপেস্ট প্রস্তুত করা সব সময় সম্ভব নয়। তবে নামমাত্র লাভ করলে এ ধরনের টুথপেস্ট বাজারজাত করা সম্ভব।
টুথপেস্টে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান বিদ্যমান থাকে। টুথপেস্টের মন্দ রাসায়নিক উপাদানের একটি হলো সোডিয়াম লরিল সালফেট বা এসএলএস। সোডিয়াম লরিল সালফেট দেখতে সাদা বা ক্রিম রং-এর হয়ে থাকে। সোডিয়াম লরিল সালফেট বা এসএলএস, একটি ডিটারজেন্ট যা টুথপেস্ট, সেভিং ক্রিম, শ্যাম্পু, হেয়ার কন্ডিশনার, বডিওয়াশ ইত্যাদি প্রসাধন সামগ্রীতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসএলএস-এর কারণেই টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশ করার সময় ফেনা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এসএলএস-কে টুথপেস্টের ফোমিং এজেন্টও বলা হয়। তবে টুথপেস্টের বেশি ফেনা দেখা আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এসএলএস ত্বকে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। অনেকের ৰেত্রে মুখের কোমল ওরাল মিউকোসাতে আলসার সৃষ্টি করে থাকে। টুথপেস্টে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এব্রেসিভ এজেন্ট বা উপাদান যা দাঁতকে পরিষ্কার করে। কিন্তু টুথপেস্টে বিদ্যমান এ ধরনের উপাদান সবার জন্য ভাল ফলের পরিবর্তে বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।
আমাদের দেশে বাজারজাত অধিকাংশ টুথপেস্টেই এসএলএস বিদ্যমান। এ কারণেই অনেকের মুখে কোন রোগ না থাকার পরও মুখে আলসার বা ঘা দেখা দেয়। নাম উলেস্নখ না করেই বলছি এমনও টুথপেস্ট রয়েছে যা সবাই ব্যবহার করে কিন্তু তাতে প্রচুর পরিমাণে এসএলএস বিদ্যমান। তাই টুথপেস্ট ব্যবহারের পূর্বে টুথপেস্টের মন্দ রসায়ন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তা না হলে মুখে আলসার হলে মুখের রিবোফাভিন ট্যাবলেট খেতে খেতে জীবন অতিবাহিত হবে। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে, মুখে আলসার হলেই তা টুথপেস্টের কারণেই হয়েছে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। আপনার দাঁত ও ওয়াল মিউকোসার ধরন দেখেই নির্ধারণ করতে হবে কোন টুথপেস্ট আপনার জন্য ভাল। সেৰেত্রে বিজ্ঞাপন নয় বরং একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপন
বিভিন্ন কারণে একজন মানুষের মুখে এক বা একাধিক দাঁত নাও থাকতে পারে। দাঁতের যত্নে অবহেলাই এর প্রধান কারণ। তবে কোন কোন ৰেত্রে চিকিৎসার জন্য দাঁত ফেলে দিতে হয়। মুখের এসব হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপন করা অতীব জরম্নরী। কথা বলা, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ ও চর্বণ ছাড়াও মুখের স্বাভাবিক গঠন ঠিক রাখার জন্য হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপন জরম্নরী। হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপন বিভিন্নভাবে করা যায়। প্রধান প্রতিস্থাপন পদ্ধতিগুলো হলো-
ক্স কৃত্রিম দাঁত বা ডেনচার স্থাপনের মাধ্যমে
ক্স ডেন্টাল ব্রিজের মাধ্যমে
ক্স ডেন্টাল ইমপস্নান্ট-এর মাধ্যমে।
কৃত্রিম দাঁত বা ডেনচার অতি প্রাচীনকাল থেকে হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে সাধারণত এক্রিলিক ডেনচার গ্রামগঞ্জসহ সর্বত্র বেশি ব্যবহৃত হয়। এক্রিলিক ডেনচার ব্যবহারে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। মুখে ক্যান্ডিডসিস সংক্রমণ হতে পারে। ডেনচারের কোন অংশ মুখে ঠিকভাবে না লাগলে ওরাল আলসার সৃষ্টি হতে পারে এবং মুখে ছত্রাক সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ডেনচার রাতের বেলায় ব্যবহার না করলে এক গস্নাস পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়। আমাদের দেশে অভাবী অসহায় মানুষদের এসব ডেনচার ব্যবহার করা ছাড়া আর কোন উপায়ও থাকে না। তবে হারানো দাঁত প্রতিস্থাপনে কৃত্রিম দাঁত হিসেবে মেটালিক ডেনচার ব্যবহার করা যায়। মেটালিক ডেনচার হাল্কা এবং মুখে কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না।
ডেন্টাল ব্রিজ করার মাধ্যমে হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপন করা যায়। সাধারণত পোরসেলিন ডেন্টাল ব্রিজ করা হয়। এৰেত্রে এক বা একাধিক দাঁতের জন্য ডেন্টাল ব্রিজ করা যায়। ডেন্টাল ব্রিজ করার মাধ্যমে মোটামুটি স্বাভাবিক দাঁতের মতো কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু ডেন্টাল ব্রিজ করার সময় ভাল কিছু দাঁত কাটতে হয়। অনেক সময় পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে রোগী হতাশ হয়ে পড়েন। অভিজ্ঞ হাতে ডেন্টাল ব্রিজ করলে আসলে কোন সমস্যা হয় না। ডেন্টাল ব্রিজ করার সময় পাশের দাঁতের এবং হাড়ের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আনতে হবে।
হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপনে ডেন্টাল ইমপস্নান্ট করা যায়। ডেন্টাল ইমপস্নান্ট-এর ৰেত্রে টাইটেনিয়াম স্ক্রু চোয়ালের হাড়ে স্থাপন করা হয় এবং এর উপরে দাঁতের ক্রাউন সংযুক্ত থাকে। ডেন্টাল ইমপস্নান্ট-এর ৰেত্রে টাইটেনিয়াম স্ক্রু ব্যবহৃত হয় এ জন্যই যে টাইটেনিয়াম আমাদের দেহে কোন প্রকার পাশর্্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। যাদের মুখে কোন দাঁত নেই অর্থাৎ ইডেনটুলাস্ট রোগী তাদের ৰেত্রে টাইটেনিয়াম ইমপস্নান্ট বেশ কার্যকরী। তবে কিছু সিস্টেমিক রোগের ৰেত্রে তা সমান ভূমিকা রাখে না। বিশেষ করে ডায়াবেটিস থাকলে এৰেত্রে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ইমপস্নান্টের ৰেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ইমপস্নান্ট ব্যয়বহুল চিকিৎসা। কারণ টাইটেনিয়াম একটি মূল্যবান ধাতু। তাছাড়া এর সাথে আনুষঙ্গিক খরচ তো থাকছেই।
হারানো দাঁতের প্রতিস্থাপনে কোন্ পদ্ধতি আপনি গ্রহণ করবেন সে সিদ্ধানত্ম একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শক্রমেই গ্রহণ করা উচিত। তবে সবচেয়ে ভাল নিজে সচেতন ও যত্নবান হওয়া যাতে করে দাঁত হারিয়ে না যায়।
রম্নট ক্যানেল নাকি
ডেথ ক্যানেল

দনত্মমজ্জায় প্রদাহজনিত চিকিৎসায় দাঁতের সংরৰণে রম্নট ক্যানেল চিকিৎসা জরম্নরী। রম্নট ক্যানেল চিকিৎসায় কিছু সূক্ষ্ম সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রম্নট ক্যানেল চিকিৎসার ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলোর মাঝে রিমার, ফাইল, ব্রোচ উলেস্নখযোগ্য। রম্নট ক্যানেল চিকিৎসায় ব্যবহৃত এসব সরঞ্জাম উন্নত বিশ্বে সাধারণত একবার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর একাধিকবার ব্যবহার করতে হলে এগুলোর জন্য আলাদা ধরনের স্টেরিলাইজার প্রয়োজন যা গস্নাস বিড স্টেরিলাইজার নামে পরিচিত। আমাদের দেশেও অন্যান্য দেশের মতো রম্নট ক্যানেল চিকিৎসায় এসব সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এসব সরঞ্জাম যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয় না। ফলে হেপাটাইটিস, এইডসসহ যে কোন জীবাণু দেহে সংক্রমিত হতে পারে। দাঁতের চিকিৎসা করতে গিয়ে যদি আরেকটি ঘাতক ব্যাধি শরীরে স্থান করে নেয় তাহলে এরচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কি হতে পারে?
রম্নট ক্যানেল চিকিৎসা মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। সাধারণত একটি দাঁতের রম্নট ক্যানেল চিকিৎসার জন্য রোগীকে তিনবার ডাক্তারের নিকট আসতে হয়। রম্নট ক্যানেল চিকিৎসায় ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে রোগীরা চিকিৎসা করার সময় দর কষাকষি থেকে শুরম্ন করে বিভিন্ন কিনিকেও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। এতে করেই কিছু ডাক্তার রম্নট ক্যানেল চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত না করে স্যাভলন মিশ্রিত পানি দিয়ে ওয়াশ করে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন খরচ কমানোর জন্য। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। রোগীর সার্বিক চাহিদা পূরণ করার জন্য ডাক্তার বা কিনিক মালিকরা বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। একবার ব্যবহার করে কোন সরঞ্জাম ফেলে দেয়া আমাদের দেশেও করা সম্ভব। সেৰেত্রে ডাক্তার বা কিনিক কর্তৃপৰের হয়ত আয় কম হবে। কিন্তু মানুষের জন্য কিছু করতে হলে কিছু ত্যাগ স্বীকার তো করতেই হবে। আর রোগীদেরও একটা কথা মনে রাখতে হবে, বেশি টাকা দিয়ে বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কৰে চিকিৎসা করালেই যে আপনি নিরাপদ তা কিন্তু অনত্মত আমাদের দেশে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। চিকিৎসার জন্য সব সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কৰ জরম্নরী নয়। হয়ত সেলুনের জন্য হতে পারে আরাম-আয়েশের জন্য। চিকিৎসার ৰেত্রে খেয়াল রাখতে হবে চিকিৎসার যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা হলো কিনা বা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ওয়ান টাইম ব্যবহৃত হচ্ছে কি না অথবা চিকিৎসার স্থানটি স্বাস্থ্যসম্মত কিনা। রোগীদের মনে রাখতে হবে রম্নট ক্যানেল-এর মতো চিকিৎসা কম টাকা দিয়েও সুচারম্নরূপে সম্পন্ন করা সম্ভব। রম্নট ক্যানেল চিকিৎসা করার আগে আপনাকে অবশ্যই জেনে নিতে হবে রম্নট ক্যানেল করা দাঁতটি চিকিৎসা করার পর তাতে কোন ক্যাপ বা ক্রাউন বসাতে হবে কিনা। যদি ক্যাপ বা ক্রাউন রম্নট ক্যানেল-এর পাশাপাশি করতে হয় সেৰেত্রে আপনার খরচও অনেক বেড়ে যাবে। ক্যাপ বা ক্রাউন করার সামর্থ্য যদি আপনার না থাকে সেৰেত্রে রম্নট ক্যানেল করিয়ে কিছুদিন হয়ত আপনার দাঁতটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব কিন্তু ক্যাপ বা ক্রাউন করাতে দেরি হলে দাঁতটি আসত্মে আসত্মে ভেঙ্গে বা ৰয় হয়ে যায় অথবা ডেন্টাল পকেট সৃষ্টি হতে পারে। চিকিৎসার ৰেত্রে নিরাপত্তা প্রয়োজন।
আপনার ডাক্তারের ওপর আপনার বিশ্বাস থাকতে হবে। বিশ্বাস না থাকলে খরচের কমবেশি বিবেচনায় এনে কি লাভ হবে? ডাক্তারদেরও এ ধরনের ব্যয়বহুল চিকিৎসায় গরিব রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। দাঁতের সংরৰণে রম্নট ক্যানেল চিকিৎসা সম্পর্কে আপনাকে সচেতন হতে হবে। তা না হলে রম্নট ক্যানেল না হয় আপনার ডাক্তার দিয়ে সিল করিয়ে নিলেন কিন্তু তা করতে গিয়ে যদি ডেথ ক্যানেলের জন্ম হয় তখন কি করবেন?
ডা. মোঃ ফারম্নক হোসেন
ওরাল এ্যান্ড ডেন্টাল সার্জন
শাহ্ আলী মিরপুর মাজার শরীফ
জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুর-১, ঢাকা।
মোবাইল : ০১৮১৭৫২১৮৯৭

No comments

Powered by Blogger.