তৃণমূল নারী জনপ্রতিনিধিরা অনেক এগিয়ে

গ্রামের মানুষের খুব কাছের স্থানীয় সরকারের তৃণমূলের সেবাদানকারী সংস্থা ইউনিয়র পরিষদে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের মাত্রা কত? স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত নারী সদস্যরা আরও বেশি কাজ করতে চায়।
কিন্তু কাজের সুযোগ এখনও সীমিত বলে মনে করছেন নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিরা। সাধারণ মানুষও আজ নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে উচ্চকিত। এ নিয়ে সরকারী এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানা সময়ে সভা-সেমিনার করছে। তবে নারীরা এখন অনেক এগিয়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে শতকরা ৩০ ভাগ নারী সদস্যদের জন্য সরকার সংরক্ষিত রাখলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ খুব সীমিত দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন পুরোপুরি নিশ্চিত হচ্ছে না। ক্ষেত্র বিশেষে অবহেলারও শিকার হচ্ছেন তারা। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলি, কাওয়াকোলা ও শিয়ালকোল ইউনিয়নে সরেজমিন ঘুরে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিশ্চিত হলেও তার মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নারীর ক্ষমতায়ন এখনও প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছেনি বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে নারীরা এখন আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে। নির্বাচিত অনেক মেম্বারের নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তেমন কোন ধারণা নেই। তবে চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং এলাকার সাধারণ মানুষ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করেন। তারা চায় নারী সদস্যরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের পুরোপুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। কিন্তু নারী সদস্যরা ক্ষমতায়নে মুখের কথা বিশ্বাস করেন না, তারা এর বাস্তবায়ন দেখতে চান। বিলগাজারিয়া গ্রামের ৬নং ওয়ার্ড মেম্বার মোঃ সিরাজ বলেন, নারী সদস্যদের ক্ষমতায়ন কি বুঝি না।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের নির্বাচিত মহিলা মেম্বার রাজিয়া পারভিন সরকারের দেয়া ক্ষমতা কতটুকু প্রয়োগ করছেন প্রশ্নে জানান, নারী সদস্যদের ক্ষমতায়ন শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। নির্বাচিত হবার পর এখনও তাকে কোন কাজ দেয়া বা কোন কমিটির চেয়ারম্যান করা হযনি। শুধু প্রকল্প বাস্তবায়নে উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। এত কিভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছেÑ বলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন। তবে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন, আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছেন তা অকপটে স্বীকার করেন। ইউপি চেয়ারম্যান টিএম শাহাদত হোসেন অবশ্য নারী সদস্যের বক্তব্যের উল্টো বলেছেন। তিনি বলেছেন, তার ইউনিয়নে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীরা এখন ওয়ার্ড চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলেও তিনি জানান।
৩নং বহুলী ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের ৯নং ওয়ার্ড বাসিন্দা বাবলু মাস্টার বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে নারী সদস্যদের ক্ষমতায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুরুষ সদস্যরা যে কোন প্রকল্পের কাজ বুঝে নিয়ে তাদের ইচ্ছামতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। বণ্টনের ক্ষেত্রে তারা স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি করে থাকেন। এজন্য গ্রামের মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। নারী সদস্যদের আরও বেশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে বাজেট বৃদ্ধি করে কাজ দিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
৩নং বহুলী ইউনিয়ন তেলকুপি গ্রামের মোঃ এনামুল হকের মতে, গ্রামের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনসাধারণের সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে নারী সদস্যদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। চেয়ারম্যান এবং পুরুষ সদস্যরা বরাদ্দের বেশির ভাগই ভোগ করেন। বরাদ্দ কম হওয়ায় নারী সদস্যরা তাদের মেধা, যোগ্যতা, সততা মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করতে পারছে না। তারা সঠিক সময়ে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ পেলে পুরুষের চেয়েও ভাল করতে পারবেন। আমাদের বাঙালী নারীরা কঠোর পরিশ্রমী ও মনোযোগী। তাই স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণকে গতিশীল করতে হবে।
নারী বৈষম্য ও সীমাবদ্ধতা দূর করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজে লাগোনোর জন্য নীতিমালার বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ দিয়ে এলাকাবাসীর সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। নারী সদস্যরা নিজ নিজ এলাকাবাসীর দুঃখ-দুর্দশা মোচনে বেশি আগ্রহী ও পরিশ্রমী। ফলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের প্রত্যন্ত এলাকায় কাজে নিয়োজিত করা দরকার। নারীর ক্ষমতায়ন যত বৃদ্ধি পাবে, জনসেবা নিশ্চিত করা তত সহজ হবে। এজন্য সরকারের সঠিক পরিকল্পনা দরকার।
বহুলী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের রোঘুরগাতী গ্রামের মেম্বার মোঃ শাজাহান আলী জানান, চেয়ারম্যানের দিকনির্দেশনায় আমরা একসঙ্গে একযোগে দায়িত্ব পালন করছি। এ ইউনিয়নে সব জনসেবা সমানভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। নারী সদস্যরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই নিজ নিজ এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাতে আমাদের কোন অসুবিধা নেই।
৩নং বহুলী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার মোঃ আকবর আলীর মতে, নারী সদস্যরা ভালভাবেই কাজ করছেন। তাদের তো সরকার অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। সরকার আমাদের চেয়ে ভাল জানেন, সরকারই ঠিক করবে নারীর কতটুকু ক্ষমতা দেয়া দরকার।
৩নং বহুলী ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের কদমপাল গ্রামের মেম্বার মোঃ রেজাউল করিম বলেন, নারী-পুরুষের অধিকার সমান। এ অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতা প্রয়োগের নীতিমালা নিশ্চিত করা দরকার। সেই সঙ্গে আরও নীতিমালা বৃদ্ধি করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন জোরদার হলে সমাজের উন্নয়ন কর্মকা- ত্বরান্বিত হবে। এ বিষয়ে ওপর থেকে কোন নির্দেশনা এলে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবেন বলে তিনি জানান।
৪, ৫, ৬নং ওয়ার্ড থেকে বহুলী ইউপি মহিলা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মোসা. রোকেয়া পারভীন। নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি এলজিএসপি ও ডব্লিউডিসি প্রকল্পের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার বলে নারীর সমান অধিকার, যা শুধু কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। যেখানে একজন পুরুষ সদস্য মাত্র ৬-৭টি গ্রাম মিলে নির্বাচিত সেখানে একজন মহিলা সদস্য প্রায় ৩০টি গ্রাম মিলে নির্বাচিত। পুরুষদের যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা দিয়ে ৬-৭টি গ্রাম সমন্বয় করা সম্ভব হয় না আর আমরা সেই বরাদ্দ দিয়ে কিভাবে ৩০টি প্রামের মানুষের চাহিদা পূরণ করব। এজন্য তিনি মহিলা সদস্যদের বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান
৭, ৮, ৯নং ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত মহিলা সদস্য মোসা. বিউটি বেগম বলেন, গ্রামের অনেক মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ল্যাট্রিন, টিউবওয়েল ব্যবহার থেকে বঞ্চিত। স্যানিটেশন ল্যাট্রিন স্থাপন ও টিউবওয়েল বিতরণ করলে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ কমবে, পরিবেশ দূষণ রোধ হবে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাদের যেভাবে বণ্টন করে দেন, তাই নিয়েই সীমিত আকারে আমরা এলাকায় কাজ করি। সামান্য বরাদ্দ দিয়ে গরিব, অসহায় এলাকাবাসীর সমান সহযোগিতা করা সম্ভব হয় না।
সিরাজগঞ্জ সদর উজেলা কাওয়াকোলা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মনোয়ারুল ইসলাম জানান, এ ইউনিয়ন পরিষদে চেয়াম্যানের নেতৃত্বে নিয়মিত মাসিক মিটিং পরিচালিত হয়। মিটিংয়ে সব সদস্য নিয়মিত উপস্থিত থেকে সম্মিলিতভাবে তাদের কাজের দায়িত্ব বুঝে নেন। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নারী সদস্যরা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন।

Ñবাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.