পানি বাড়বে ভাসবে বাড়ি, দু'কৰের ডুপেস্নক্স- পৃথুলা প্রসূনের লিফট হাউস প্রকল্প

সৈয়দ সোহরাব অধিক জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশ। এর সমস্যার অনত্ম নেই। শিৰা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব তো আছেই, তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে প্রতিবছরই। এত সব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়তই কাজের খোঁজে হচ্ছে শহরমুখী।
ফলে ঢাকা পরিণত হয়েছে মেগাসিটিতে। তার ওপর দিন দিন বেড়েই চলেছে এর জনসংখ্যা। এক কোটি ছাড়িয়েছে বহু আগেই। অতি দ্রম্নত ক্রমবর্ধমান এই রাজধানীর শতকরা ২৮ থেকে ৩০ ভাগ নাগরিক বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাদের আবাসন সঙ্কট তীব্র। মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে অৰম এমন নাগরিকরা তখন বাধ্য হয় নিম্নমানের বাসস্থানে বসবাস করতে। যেখানে বন্যা ও জলাবদ্ধতাজনিত সমস্যা বিদ্যমান। এদিকে উষ্ণায়নের প্রেৰিতে পৃথিবীর তুষারপাত অঞ্চলের বরফ গলে সে পানি ধাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চলের দিকে। এই ৰতির দিক দিয়েও বাংলাদেশ আছে এক নম্বরে। এমনই অবস্থায় ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের কথা এবং বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে নিম্নাঞ্চলের উপযোগী ভাসমান 'লিফট হাউস' প্রকল্প নিয়ে এসেছে কানাডা প্রবাসী তরম্নণ স্থপতি পৃথুলা প্রসুন।
বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী এই পৃথুলা ৯ বছর বয়সেই পিতামাতার সঙ্গে কানাডা চলে যান। সেখানে সাফল্যের সঙ্গে স্থাপত্যবিদ্যায় গ্র্যাজুয়েশন করে বর্তমানে ওয়াটার লু বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছেন। এই লিফট হাউস প্রকল্পটি উভচর নির্মাণসংক্রানত্ম থিসিস রিসার্চ, যা তিনি তাঁর শিৰক ড. এলিজাবেথ ইৎলিজার তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করেছেন। এর গবেষণা ও ডিজাইনের জন্য আইডিআরসি'র (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার) কাছ থেকে পুরস্কারপ্রাপ্তও হয়েছেন তিনি। এই প্রকল্পটিই তিনি নিজ দেশের গরিব মানুষের জন্য উদ্ভাবন করেছেন।
তাঁর এই লিফট হাউস প্রকল্পটি দোতলা। নিম্নআয়ের ৪/৫ সদস্যের দুইটি পরিবারের জন্য একটি ডবল ইউনিটের বাড়ির শেইপে এর কাঠামো তৈরি। আবার এর প্রতিইউনিটকে দুই কৰের ডুপেস্নক্সও বলা যায়। নিচের কৰের ভেতর দিয়েই সিঁড়ি আছে, যার মাধ্যমে ওপরের কৰে যেতে হয়। কৰের উচ্চতা ১০ ফুট করে। তবে এই বাড়ির দুইটি পরশন_ সামনের অংশ বাঁশ ও চটি দিয়ে তৈরি, যা পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠবে এবং পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসবে। আর পেছনের অংশটি রড, ইট সিমেন্ট দিয়ে তৈরি, যা ভাসবে না। পেছনের অংশেই রয়েছে রান্নাঘর, বাথরম্নম, টয়লেট ও বারান্দা। বন্যার পানি যদি ১০ ফুট পর্যনত্ম বাড়ে তাহলে নিচের কৰটি ভেসে কংক্রিটের তৈরি অংশের লেবেলে চলে আসবে। এখানে সৌরবিদু্যতের ব্যবস্থা, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা ও রিসাইকেলের ব্যবস্থা, মলমূত্রের মাধ্যমে বায়োগ্যাস তৈরির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ফলে সিটি সার্ভিসপ্রাপ্তি অগ্রাহ্য করে মানুষ বসবাস করতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে পৃথুলা প্রসুন বলেন, লিফট হাউসটি এমন একটি বাসস্থান যা বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাসবে এবং পানি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাবস্থায় মাটিতে ফিরে যাবে। স্থাপনাটির ভাসমান ব্যবস্থা দু'ভাবে করা হয়েছে_ এক পাশে ব্যবহৃত পস্নাস্টিক বোতল (মিনারেল ওয়াটারের) এবং অন্য পাশে ফাঁপা ফেরো সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। একটি বাড়ি ভাসমানের জন্য একদিকে ৫০০ মিলির সাড়ে আট হাজার বোতল এবং অন্যদিকে ৩ ফুট গভীরতা নিয়ে ১৪০ স্কয়ার ফুট ফাঁপা তৈরি করতে যে পরিমাণ ফেরো সিমেন্ট লাগে তা ব্যবহার করা হয়েছে। ঢাকা শহরের পরিবেশের অবস্থা বিবেচনায় রেখে এবং সিটি সার্ভিসপ্রাপ্তিকে গ্রাহ্যে না রেখে বিশেষ কৌশলে স্থাপনাটি স্বচালিত রাখার জন্য স্থাপত্যবিদ্যার বিশেষ কৌশল প্রকল্পটিতে ব্যবহার করেছি। বসবাসকারীদের জন্য সারাবছর ধরেই প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা অর্থাৎ বৃষ্টির পানি সংগ্রহ, পরিশোধন, বিদু্যত, যৌথ শৌচাগার ইত্যাদির ব্যবস্থা এই লিফট হাউসে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা শহর এলাকায় ভূর্গভস্থ পানি গভীর টিউবওয়েলের মাধ্যমে উত্তোলন করার ৰতিকর দিক বিবেচনায় রেখে এই বৃষ্টির পানি পরিশোধন এবং পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে এখানে। আলো ও বৈদু্যতিক পাখার জন্য ৬০ ওয়াটের সৌরবিদু্যত উৎপাদনের ব্যবস্থা রেখেছি। যৌথ শৌচাগারের বর্জ্য বসবাসকারীরা হয় বিক্রি অথবা দশ বছর পর জৈবসার হিসেবে সবজি বাগানে ব্যবহার করতে পারবে। শৌচাগারের মূত্র একটি ভূতল পাইপের মাধ্যমে পুষ্টিকর পদার্থ হিসেবে বাগানে ব্যবহার করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষের কথা চিনত্মা করে সহজলভ্য বাঁশ সর্বাধিক ব্যবহার করা হয়েছে এই স্থাপনায়। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এই বাড়ি তৈরির বাঁশগুলোতে কেমিক্যাল ব্যবহার করে এমনভাবে ট্রিট করা হয়েছে যে বাঁশগুলোতে আর ঘুণ ধরবে না। ফলে বাড়ির স্থায়িত্ব হবে ২৫ থেকে ৩০ বছর। তবে প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে কোন অংশের পরিবর্তন করা যাবে। এখানে আবহাওয়ার অনুপযোগী কোন ঢেউটিন ব্যবহার করা হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রক্রিয়াজাত করা এসব স্থানীয় বাঁশ সহজেই নির্মাণ সামগ্রীর কাঠামোগত এবং দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করবে। তিনি আরও বলেন, ৮/১০টি বাড়ি একসঙ্গে করলে ব্যয় হবে কম, বাড়িপ্রতি দুই লাখ টাকা করে পড়বে। আরও বেশি করলে ব্যয় আরও কমে আসবে। কিন্তু একটি বাড়ি করলে ব্যয় তিন লাখ টাকার ওপরে হবে। প্রকল্পটির পরিকল্পনা বা নকশা এমনভাবে করেছি, যা নিম্নআয়ের পরিবারের জীবনযাপন পদ্ধতির সহায়ক হবে। প্রকল্পটি পরিবেশসচেতন নগর এলাকায় নিম্নআয়ের মানুষের জন্য একটি আদর্শ বাসস্থান হবে বলেই আশাবাদী।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় উপদ্রম্নত এলাকাতেও এই বাড়ি করা যাবে, তবে ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারের সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে সরকার। নানা প্রজেক্ট নিয়ে আলাপও হচ্ছে। এনজিওদের সঙ্গে এখনও সেভাবে বসা হয়নি। মঙ্গলবার রাতেই তিনি কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ফেব্রম্নয়ারিতে এসে এ বিষয়ে সরকারসহ সকলের সঙ্গে আলাপ করবেন।
মঙ্গলবার এই লিফট হাউস প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে এবং ফুলের ফিতা কেটে ঘরে প্রবেশ করেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান।

No comments

Powered by Blogger.