বাংলাবান্ধা নামেই স্থলবন্দর

দেশের সবচেয়ে উত্তরের পঞ্চগড় জেলার স্থলবন্দর বাংলাবান্ধার পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। স্থলবন্দরটি শুধু নামেই, কার্যক্রমে তেমনটা নেই। স্থলবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কার্যালয়েই আসেন দুপুর ১২টার পর।
তিন-চার ঘণ্টা কাজ করেই আবার চলে যান। ঢিলেঢালাভাবে চলে আমদানি-রপ্তানির শুল্কায়নসহ অন্যান্য কার্যক্রম। প্রতিদিন মাইক্রোবাসে করে পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে বাংলাবান্ধা যান কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ক্লিয়ারিং-ফরোয়ার্ডিং এজেন্টের (সিঅ্যান্ডএফ) লোকজন। দিনে এখানে ২৫-৩০টি বেশি পণ্যবাহী ট্রাক আসে না। বন্দরটিতে ট্রাক থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর আলাদা কোনো জায়গাও (ইয়ার্ড) নেই। একটি গুদাম (ওয়্যারহাউস) থাকলেও তা নির্মাণাধীন ভবনের রড-সিমেন্ট রাখার কাজে ব্যবহার হয়। ওজন যন্ত্রের নিয়মিত ব্যবহার নেই।
আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দেওয়ার যে উদ্যোগ রয়েছে, তাতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাবান্ধা সীমান্তের অপর পাড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ী স্থলবন্দর।
আঞ্চলিক ট্রানজিটের জন্য সাতটি সড়কপথ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কাঠমান্ডু (নেপাল)-কাকরভিটা-ফুলবাড়ী (ভারত)-বাংলাবান্ধা (বাংলাদেশ)-মংলাবন্দর/চট্টগ্রাম। মূলত ভারত ও নেপালকে পণ্য ট্রানজিট দেওয়ার জন্য এই পথটি বেছে নেওয়া হয়েছে।
পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই: বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাবান্ধা ল্যান্ডপোর্ট লিমিটেডকে ২৫ বছরের জন্য স্থলবন্দরটি হস্তান্তর করা হয় ২০০৬ সালে। প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ একর জমিও দেওয়া হয়। অথচ ছয় বছর পার হলেও কোনো অবকাঠামোই গড়ে তোলেনি তারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় পাঁচ একর জমি পণ্য ওঠানামার জায়গা বা ইয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেখানে তা গড়ে ওঠেনি। সেখানে গরুও চরে। অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থলবন্দরের পাশে মূল সড়কে পণ্যবাহী ট্রাককে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
তিনটি গুদাম বা ওয়্যারহাউস তৈরি করার কথা থাকলেও করা হয়েছে একটি। পাশের ছোট একটি দোতলা ভবনের নিচতলায় চলে স্থলবন্দরের যাবতীয় কার্যক্রম। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা স্থলবন্দর এলাকার মাঝখান দিয়ে পার্শ্ববর্তী জারুয়াপাড়া গ্রামের লোকজন যাতায়াত করে। এতে পুরো স্থলবন্দর কার্যক্রমের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে রয়েছে বলে বন্দর-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
স্থলবন্দরের বেহাল দশা সম্পর্কে বাংলাবান্ধা ল্যান্ডপোর্ট লিমিটেডের প্রতিনিধি কাজী আল তারেক প্রথম আলোকে জানান, পণ্য আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ না বাড়লে বেসরকারি অপারেটর বিনিয়োগ করে পোষাতে পারবে না। পণ্যের পরিমাণ না বাড়ালে আরও বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়।
লোকবল নেই: এমনিতেই স্থলবন্দরটি পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই। একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দিয়ে চলে শুল্কায়ন-সংক্রান্ত কার্যক্রম। সবাইকেই দুপুর ১২টার দিকে আসতে দেখা গেল। তাঁরা কার্যালয়ে আসার পরেই পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ শুরু হয়। আবার চারটার দিকে একযোগে মাইক্রোবাসে করে ৫৩ কিলোমিটার দূরে পঞ্চগড় জেলা সদরে চলে যান সবাই। এভাবেই চলছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর।
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আসাব উদ্দিন খান প্রথম আলোকে জানান, ভারতের ফুলবাড়ী স্থলবন্দরে পণ্যবাহী ট্রাক আসা-যাওয়ার জন্য ফটক খুলে দেওয়া হয় একটার পর। তাই সকালে স্থলবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কার্যালয়ে এলেও কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। ভারতের স্থলবন্দরের ফটক সকালে খুললে সারা দিনই কাজ করা যেত।
১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বাংলাবান্ধা শুল্ক স্টেশনকে ব্যবহার করে নেপালকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ। এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে এখন নেপাল থেকে ডাল ও ভুসি আমদানি করে বাংলাদেশ। ছয় ঘণ্টার জন্য পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে ভারত। সময় এত কম বলে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
পঞ্চগড় জেলা আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মেহেদী হাসান খান বলেন, ভারত থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানির সুযোগ দিলে স্থলবন্দরটি আরও গতিশীল হবে। ইতিমধ্যে এনবিআরে এ জন্য আবেদন করা হয়েছে।
মানুষ চলাচলের সুযোগ নেই: বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে মানুষ চলাচলের (ইমিগ্রেশন) সুযোগ নেই। অথচ বাংলাবান্ধা ও ফুলবাড়ী স্থলবন্দর থেকে শিলিগুড়ি শহর মাত্র সাত কিলোমিটার ও শৈলশহর দার্জিলিং মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ ছাড়া জলপাইগুড়ি জেলাও বাঙালি অধ্যুষিত। আর বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাকরভিটা সীমান্ত মাত্র ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে।
পঞ্চগড় জেলা নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন সরকার প্রথম আলোকে জানান, বাংলাবান্ধা দিয়ে অভিবাসন সুবিধা চালু হলে যোগাযোগ আরও সহজ হবে এবং পর্যটকেরাও আকৃষ্ট হবেন।

No comments

Powered by Blogger.