এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত হোক by মুহম্মদ শফিকুর রহমান

কোন কিছু লিখতে বসলে মনের অজান্তে কিছু কিছু ব্যক্তিগত ঘটনা সামনে চলে আসে এবং চিত্রিত হয়ে যায়। অভিজ্ঞতার বর্ণনাও বলা যায়। সবসময় যে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাও কিন্তু নয়।
কখনও কখনও একেবারে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলে আসে, যাতে পাঠকের বিরক্তি ঘটার প্রশ্নটিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ১০ জানুয়ারি :
১০ জানুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। এ এমন একটি দিন যেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে ফিরে এসেছিলেন। একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের বাস্তবায়নে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একদিকে ইতিহাসের জঘন্য বর্বর গণহত্যা শুরু করে, আরেকদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের লায়ালপুর ক্যান্টনমেন্ট কারাগারে বন্দী করে। গোপন বিচারে তাঁকে ফাঁসি দেয়ার আয়োজনও করেছিল হায়েনার দল। কিন্তু বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্ব-বিবেকের প্রতিবাদের মুখে পাকি-মিলিটারি জান্তা ৯ মাস পর বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি প্রথমে লন্ডন যান এবং সেখান থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিশেষ বিমানে দিল্লী হয়ে তিনি ১০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন লন্ডন, দিল্লী এবং ঢাকায় কত মানুষ যে রাজপথে নেমেছিল তা আজকের প্রজন্ম বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। তবে এই ছিল সেদিনের চিত্র। দিল্লী থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সেখান থেকে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত যারা ভারতীয় রেডিওর কণ্ঠ-সাংবাদিক দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের ধারা-বর্ণনা সরাসরি বা ঘরে বসে রেডিওতে শুনেছেন তাদের কাছে মনে হবেÑএই তো সেদিনের ঘটনা, কখন যে ৪১ বছর পার হয়ে গেল। সময় কি দ্রুত পার হয়ে যায়!
সেদিন বঙ্গবন্ধু যদি দেশে ফিরে না আসতেন বা ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে না ঘটে যদি পাকিস্তানের কারাগারে ঘটত তাহলে কি হতো! কিংবা কি হতে পারত না! আজ এতদিন পরও যখনই ভাবতে বসি একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়।
১৯৮৫ সালের কথা। সাংবাদিকতায় জাপান ফরেন প্রেস ইনস্টিটিউটের ফেলোশিপ লাভ করে কিছুকাল টোকিওতে অবস্থান করার সুযোগ হয়েছিল। সপ্তাহের ৫ দিন (সোম থেকে শুক্র) ক্লাস, সেমিনার, এসাইনমেন্ট, এক্সাম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। শনি-রবি এই দু’দিন (ডববশবহফ) কখনও কিয়োটো, কখনও ওসাকা, কখনও হিরোশিমা-নাগাসাকি, কখনও মিয়াজিমা আইল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হতো দেখার জন্য। এক ডববশবহফ-এ-বীঢ়ড়-৮৫ দেখারও সুযোগ হয়েছিল। তবে যে ংরমযঃ ংববরহমটি এখনও মনের মধ্যে দাগ কেটে আছে তা হলো ফুজি মাউন্টেন। এক ডববশবহফ-এ আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ফুজি মাউন্টেনে আর্মির মহড়া দেখাবার জন্য। ভোরের পাহাড়ী-প্রকৃতি, ছোট-বড় গাছের পাতায় শিশির কণার ওপর প্রভাতী সূর্যের আলো যেন নানান রঙের হীরক দিয়ে সাজানো হয়েছে ফুজি মাউন্টেন। ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। তারপরও মনের কোণে যেন একটা কাঁটা বিঁধে গেল। দেখলাম আমেরিকান আর্মির অফিসাররা পুরো মহড়াটি পরিচালনা করছেন। ইনস্টিটিউটের একজন ইনস্ট্রাক্টরকে প্রশ্ন করলে তিনি কোন কথা বললেন না। মুখের ওপর আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকতে বললেন। কোর্স সমাপ্তি অনুষ্ঠানে আমি বিষয়টি উত্থাপন করলে দেখলাম অনেকেই জিহ্বায় কামড় দিলেনÑ বিশেষ করে জাপানীরা। মনে হলো ফাউল করে ফেলেছি। আর বেশি এগোলাম না। ফেরার পথে ইনস্ট্রাক্টর ভদ্রলোক আমাকে ংবব ড়ভভ করতে আসেন। তখনই এক পর্যায়ে কানের কাছে মুখ এনে বললেন, তোমার মতো একই প্রশ্ন আমারও। সকল জাপানীরও। ততদিনে আমিও জেনেছিলামÑ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে আমেরিকান আর্মি জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা ফাটিয়ে সেই যে আসন গেড়ে বসেছে, আর যায়নি।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যদি দেশে ফিরে না আসতেন তাহলে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলার মাটি থেকে কতদিনে যেতেন, নাকি বাংলার কোন ফুজি মাউন্টেনে আসন গেড়ে বসতেন কে জানে? বঙ্গবন্ধু এলেন বলে তারা মার্চের প্রথমার্ধেই চলে গেলেন; তাও সম্ভব হয়েছে আমাদের বঙ্গবন্ধু এবং প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর কারণেই।
আমাদের সাংবাদিক জগতের অনুসরণীয় নাম শ্রী নির্মল সেন, গত বুধবার চলে গেলেন অনন্তলোকে। না ফেরার দেশে। এই মানুষটি ছিলেন ব্যাচেলর। আমাদের এমন কোন আন্দোলন ছিল না যাতে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেননি। মনেপ্রাণে স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস করতেন, ছিলেন মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, নির্লোভ এবং বিপ্লবী। যখন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর অহেতুক বিতর্ক তোলে তখন নির্মলদা বলেছিলেন, তিনি ২৬ মার্চ বেলা ১টার দিকে ফরিদপুর শহরে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার সাইক্লোস্টাইল কপি পেয়েছিলেন। এ কথাটি আমি ইতিপূর্বেও আমার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। তবে এখানে নির্মলদার কথা আমার বিষয় নয়। নির্মলদার মতোই সাংবাদিকতা জগতের আরেক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং দেশপ্রেমিক বিপ্লবী ছিলেন প্রয়াত ফয়েজ আহমেদ। এই দু’জনের মধ্যে একটা জায়গায় মিল আছেÑ তারা দু’জনই অবিবাহিত ছিলেন; বাংলার মানুষই ছিলেন তাঁদের আত্মার-আত্মীয়, এমনকি মৃত্যুর পরও দু’জনই তাদের দেহ মেডিক্যাল ছাত্রÑছাত্রীদের গবেষণার জন্য দান করে গেছেন। সাংবাদিক হিসেবে দু’জনই এত বড় মাপের ছিলেন যে, তাঁদের বিশালত্ব মাপার সাংবাদিকও আজ আর পাওয়া যাবে না। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজলেও না।
ফয়েজ ভাইর মুখে শোনা একটি ঘটনা দিয়ে প্রবন্ধের এ অধ্যায় সমাপ্ত করব। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার মুহূর্তে সাংবাদিক হিসেবে প্রথম তিনিই বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন এবং কথা বলতে পেরেছিলেন। কুশল বিনিময়ের পর ফয়েজ আহমেদের প্রশ্ন ছিল :
ফ. আহমেদ : মিসেস গান্ধীর সাথে দিল্লীতে বৈঠক হয়েছিল?
বঙ্গবন্ধু : হয়েছিল। ৪০ মি. আলোচনা করেছি।
ফ. আহমেদ : কি আলোচনা হয়েছিল?
বঙ্গবন্ধু : শুনতে চাস, তবে শোন, মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা হবার সাথে সাথেই প্রশ্ন করলামÑ
বীপবষষবহপু, ঃযব যড়হঁৎধনষব ঢ়ৎরসব গরহরংঃবৎ ড়ভ মৎবধঃ ংড়রষ ড়ভ ওহফরধ, যিবহ ুড়ঁ ধৎব মড়রহম ঃড় রিঃযফৎধি ুড়ঁৎ অৎসভড়ৎপবং ভৎড়স ঃযব রহফবঢ়বহফবহঃ ংড়রষ ড়ভ ইধহমষধফবংয? প্রশ্ন শুনে মিসেস গান্ধী হাসলেন, বললেন, ঝড় ুড়ঁ ধৎব ঃযব মৎবধঃ ষবধফবৎ ড়ভ ঃযব মৎবধঃ ইবহমধষর ঘধঃরড়হ. অহুধিু, রভ রঃ রং ফড়হব নু ১৭ঃয ড়ভ হবীঃ গধৎপয, ও নবষরাব, ুড়ঁ রিষষ নব যধঢ়ঢ়ু.
ফ. আহমেদ : প্রথমেই এমন প্রশ্ন করলেন?
বঙ্গবন্ধু : শোন ফজা (বঙ্গবন্ধু ফয়েজ আহমেদকে ‘ফজা’ বলে ডাকতেন), ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার সময় ৯০০ পালা-কুত্তা (আমলা) রেখে গেছে। তার মধ্যে পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল মাত্র ৬০টি। ঐ ৬০টি ২৩ বছরেই পাকিস্তান শেষ করে দিয়েছে। ভারত পেয়েছিল ৮৪০টি, সব এই ২৩ বছরে মরেনি। একটু দেরি করলে কখন কি কুপরামর্শ দেবে কে জানে? এ জন্য আগেভাগেই কমিটমেন্ট আদায় করে নিলাম।
মিত্র বাহিনী মার্চ ’৭২-এর ১২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী বলেই এসব সম্ভব হয়েছিল।
১০ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলায় ফিরে রেসকোর্সে যে নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেন তার দু’একটি কথা তৎকালীন ইখঋ বা মুজিব বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ নেতা তোফায়েল আহমেদের স্মৃতিচারণ থেকে (প্রথম আলো, ১০ জুন : ২০১৩) উদ্ধৃত করলাম :
“আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
“আমার সাথে দিল্লীতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই বাংলাদেশ ত্যাগ করবে।....
“গত ২৫ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।”
১,০৪,০০০ প্রাথমিক শিক্ষক সরকারী চাকরি পেলেন : ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪১তম দিবসের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা আরেকটি ঐতিহাসিক এবং বিশাল কাজ করলেন। বাংলাদেশের রেজিস্টার্ড, নন রেজিস্টার্ড, অনুমতিপ্রাপ্ত বা ঘএঙ পরিচালিত ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এগুলোতে নামমাত্র বেতনে কর্মরত এক লাখ ৪ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করলেন। পিতা করেছিলেন ১৯৭৩ সালে প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় আর এবার করলেন তাঁর কন্যা ২৬ হজোর ১৯৩টি। আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে এখানেও।
১৯৭৪-৭৫ সালের কথা। দৈনিক ইত্তেফাকে আমার সহকর্মী রিপোর্টার শফিকুল কবির তখন জুরাইনে বাসা করে থাকতেন। তার একমাত্র ছেলে তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। তাকে অঙ্ক শেখানোর জন্য একজন বিএসসি পাস প্রাথমিক শিক্ষককে প্রাইভেট টিউটর রাখেন। একদিন ভদ্রলোক ছেলেকে অঙ্ক করাতে গিয়ে তখনকার বঙ্গবন্ধু সরকারের খুব সমালোচনা করছিলেন। এমনকি তিনি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও আজেবাজে কথা বলছিলেন। মিসেস শফিকুল কবির ভেতর থেকে তার কথা শোনেন এবং ভেতরে গিয়ে পুরো মাস + আরও এক মাসের টিউশন ফী তাকে দিয়ে বললেন, “মাস্টার সাহেব, এই নিন আপনার টাকা। আপনার মতো বেঈমান মুনাফিকের কাছে আমার ছেলেকে পড়াব না।”
ঘটনার আকস্মিকতায় শিক্ষক ভদ্রলোক অবাক এবং বিব্রত হলেন। বুঝতে পারলেন না কেন তাকে বেঈমান বলা হচ্ছে। মিসেস কবির বললেন, “বুঝতে পারছেন না? পাকিস্তান আমলে প্রাথমিক শিক্ষকরা কত টাকা বেতন পেতেন? ছিলেন বেসরকরী। বঙ্গবন্ধু আপনাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আপনাদের চাকরি সরকারীকরণ করলেন। বেতন ৪৫ টাকা থেকে ৬০০ টাকা করলেন। তারপরও আপনি বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করছেন। আপনি কেবল অকৃতজ্ঞই নন, বেঈমান মুনাফিক! যান।
এই ঘটনাটি এ জন্য উল্লেখ করলামÑ প্রথমত, এত বড় একটি ঘটনা, এক ঘোষণায় ২৬ হাজার বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারী প্রতিষ্ঠান হলো; ১,০৪,০০০ বেসরকারী শিক্ষক সরকারী কর্মচারী হলেন, অথচ বাংলাদেশের ক’জন মানুষ তা জানতে পারলেন? প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রী যখন এ ঘোষণাটি দিচ্ছিলেন তখন তো লাখো নারী-পুরুষ সেখানে ছিলেন। তাদের কি উচিত ছিল না....
প্রথমত, সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় একটি আনন্দ মিছিল বের করার?
দ্বিতীয়ত, সেই আনন্দ মিছিল থেকে দেশব্যাপী জেলা-উপজেলায় আনন্দ মিছিল করার দিন-ক্ষণ ঘোষণা করার?
তৃতীয়ত, সরকার বা দলের পক্ষ থেকে যারা প্যারেড গ্রাউন্ডের সমাবেশটির আয়োজন করলেন তাদের কি উচিত ছিল নাÑশিক্ষকদের নিয়ে একটি আনন্দ মিছিলের আয়োজন করার?
“সব মানুষের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের প্রচার সেল দুর্বল। বড় বড় অর্জনের কথাও মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারে না।” এ অভিযোগের কি জবাব আমি জানি না। তবে এটা জানি, “কাজ করলেও শেখ হাসিনা, মানুষের কাছে দলের অর্জন তুলে ধরলেও শেখ হাসিনা।”
গত বুধবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম আমেরিকার পিটার্স-বার্গ ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত আমার কন্যা ও কন্যা-জামাতাকে ঝবব ড়ভভ করার জন্য। আন্তর্জাতিক লেভেলে উঠতেই দেখলাম জঙ্গি মিছিল, কান ফাটানো সেøাগান, ‘চলবে না চলবে না।’ জানতে চাইলাম, ‘কি চলবে না ভাই’? তিনি বললেন, ‘বিমানের নির্যাতন।’ বললাম কি ধরনের নির্যাতন? তিনি বললেন, ‘সামনের নেতারা জানেন।’ বললাম, ‘আপনাদের দাবি কি?’ ভদ্রলোক এবার একটু রেগে বললেন , ‘বললাম না, সামনের নেতারা জানেন?’
খানিক পরেই আরেকটি মিছিল এলো। দর্শনার্থী লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ সেøাগান দিল। এক পর্যায়ে একজন বললেন, ‘এভাবে হবে না, মিডিয়া ডাকতে হবে এবং তাদের সামনে ভাঙচুর করলে তবেই টনকনড়বে?’
বেলা ২টা পর্যন্ত বিমানবন্দরের গ্রাউন্ডের কাজ বন্ধ ছিল। যে কারণে সাড়ে ১১টার আমিরাত বেলা ২টা ২০ মিনিটে ছেড়ে যায়। তবে রাতে টেলিভিশনে শুনলাম ২টার দিকে বিমানমন্ত্রী তাদের দাবি মেনে নেন। সেই সঙ্গে টিভি চ্যানেলে দেখা গেল একদল লোক বিমানবন্দরে ভাঙচুর করছে। অর্থাৎ মিডিয়া যাবার পর ভাঙচুর তারপর দাবি মেনে সমাধান? এর মধ্যে অন্যতম প্রধান দাবি ছিল বিমান শ্রমিক লীগ সভাপতির বিরুদ্ধে দায়রকৃত মামলা প্রত্যাহার। দেখলাম বিমানমন্ত্রী কর্নেল (অব) ফারুক যখন সমাধানের ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন তার পাশে যে ভদ্রলোককে দেখানো হয় তার পরিচয় দেয়া হয় বিমান শ্রমিক লীগ সভাপতি বলে।
ঘরে ঘরে চাকরি : এখন কি বলবেন খালেদা জিয়া ও তার দলের মওদুদ, মোশাররফ-তরিকরা? বিগত চার বছর সরকারী খাতের পাশাপাশি বেসরকারী খাতেও অনেক চাকরি হয়েছে। সরকারী খাতের মধ্যে বিসিএস, শিক্ষা, পুলিশ, আনসার, ইউনিয়ন, স্বাস্থ্য সহকারী, মিলিটারি প্রায় সব কটি সেক্টরেই চাকরি হয়েছে চার বছর ধরে। বেসরকারী খাতের মধ্যে বিশেষ করে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল এবং পাটকল খাতে চাকরি হয়েছে। জনসংখ্যা রফতানির দিক থেকেও বিগত ৪ বছর অনেক উপরে, সর্বশেষ এই ১,০৪,০০০ বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তত এই দাবিটি গর্বের সঙ্গে করতে পারেন যে, তিনি তাঁর বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার’ যে ওয়াদা করেছিলেন তা অনেককাংশে পুরণ করেছেন।। এরপরও যে সকল তথাকথিত গবেষক বা মধ্যরাতের গলাজীবী চিবিয়ে সমালোচনা করেন, শেখ হাসিনার সরকারের কোন অর্জনই তাদের চোখে পড়ে না, তাদের মুখে এখন কি বের হবে! আমি নিশ্চিত তাদের মুখে কুলুপ আঁটবে। তবে হ্যাঁ, যারা সিদ্ধান্তই নিয়েছেন শেখ হাসিনার কোন কিছুই তাদের ভাল্লাগবে না তাদের কি বলা যাবে? যেদিন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে সেদিন থেকে এই পিয়াজ করিমরা যেন একটু বেশি সোচ্চার হয়েছেন। স্বপ্ন দেখেন সিংহাসনের অপ্সরীদের, স্বপ্ন দেখেন হাওয়া ভবনের, স্বপ্ন দেখেন খোয়াব ভবনের। কিন্তু কেবল স্বপ্ন দেখলেই চলবে না, শেখ হাসিনার মতো স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্ন দেখাতে এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন জানতে হয়Ñযা খালেদা জিয়া জানেন না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করতে হবে
ঘরে ঘরে চাকরি হলো। এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত হোকÑএ দাবি আজ প্রতিটি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক বাঙালীর (খালেদা জিয়া ও তার জঙ্গীদের মতো পাকি দেশপ্রেমিক নয়) বিচার প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ হবে জামায়াত-শিবিরের শয়তানীর ক্ষেত্রও তত বিস্তৃত হবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গোয়েবলসের কায়দায় এই বিএনপি-জামায়াত শিবির একটি নির্জলা মিথ্যা ও রং-রূপ মিশিয়ে এমনভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারে যে, সরল মানুষের বিভ্রান্ত হবার সুযোগ থেকে যায়।
এ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের মাত্রাও একেবারেই কম নয়। যেমন বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা বলেছিলাম, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০১ সময়ে ১০ টাকা কেজি চাল খাইয়েছে। এবার হয়ত আর ১০ টাকায় নামানো যাবে না। তবে ২০ টাকা প্লাস-মাইনাস করা যাবে ইনশাল্লাহ। ব্যাখ্যাও দেয়া হয় এভাবে যে, কৃষকদের উপকরণে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে মূল্য কম রাখা হবে।
কি এক উকিল অসীম আছে বিএনপির, ইটিভির অঞ্জনেশ্বর রায়ের অনুষ্ঠানে প্রতিনিয়ত বলছে, আওয়ামী লীগ নাকি বলেছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবে।
যেদিন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে সেদিন থেকে বিএনপি-জামায়াত বলতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ না-কি জামাতকে নিয়ে আন্দোলন করেছে। এটি চরম মিথ্যা কথা। আসল কথা হলো শেখ হাসিনা বিরোদলীয় নেত্রী থাকাকালে জামায়াতের কয়েকজনও সংসদে বিরোধী বেঞ্চে ছিলেন।
এর অর্থ কি এটা যে, শেখ হাসিনা তাদের নিয়ে বসেছেন? তাছাড়া জামায়াত যে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে এটা নতুন নয়। বঙ্গবন্ধুর ৩২নম্বর সড়কের বাড়ি তখনও জাদুঘর হয়নি। এবং শেখ হাসিনা সেখানেই থাকেন। এক সকালে দুই ব্যক্তি তার জন্য একখানা কোরান শরীফ নিয়ে দেখা করতে আসেন। এবং বলেন, তাকে কোরান শরীফ উপহার দেয়ার জন্য এনেছেন। শেখ হাসিনা কোরান শরীফ গ্রহণ করেছেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আর ওই দুই ব্যক্তি (যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামান) (তখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তারা অতটা পরিচিতও ছিল না), কোরান শরীফ নিয়ে গেছেন রাজনীতি করতে। যদিও আমি নিশ্চিত তারা কখনও কোরান শরীফ নিয়ে খালেদা জিয়াকে দিতে যাননি। গেলেও অন্য কিছু নিয়ে যেতেন।
অথচ বিএনপি-জামাতীরা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করেছে। কত বড় মিথ্যা দেখুন।
সর্বশেষ যে কথাটি বলতে চাই, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা দরকার। প্রয়োজনে আরও অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করা দরকার। এত বড়, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিচার প্রক্রিয়ায় যাকেÑ তাকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ মোটেই কাম্য নয়। ভুলে গেলে চলবে না, এতদিন চ্যানেলে চ্যানেলে মধ্যরাতের গলাজীবীরা সত্য-মিথ্যা যা খুশি মুখে এসেছে বলেছে। এবার পত্র-পত্রিকা নেমে পড়েছে জরিপের হাতিয়ার নিয়ে। নির্বাচন যত ঘনীয়ে আসবে এদের তৎপরতা বাড়বে বই কমবে না।

ঢাকা-১১ জানুয়ারি ২০১৩
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.