নীল by মনিজা রহমান

মেয়েটির কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল বিপুল। শুধু সুরেলা আওয়াজ নয়। বলার ভঙ্গিতে কোথায় যেন এক ধরনের বিশেষত্ব আছে। এখানকার মেয়েদের সঙ্গে মানায় না।
_ ভাল না বাসলে ভালবাসার সুখ বা দুঃখ কোনটাই বোঝা যায় না। আয়শা বলল। এমন নয় যে এই ধরনের কথা প্রথম শুনল বিপুল। প্রেমের উপন্যাসে হরহামেশাই নায়ক-নায়িকারা এ সমসত্ম সংলাপ বলে। তবু বিপুলের কানে কথাটা লেগে থাকল। প্রতু্যত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু মোম কোন কথা মনে আসল না। ওদিকে শাহজাদা সবাইকে ট্রলারে ওঠার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। একটু সময় নিল বিপুল। দেখল আয়শা দুই ট্রলারের মধ্যে কোন্টায় ওঠে। আয়শা ওঠার পরেই একটাতে উঠল ও।
বান্দরবানের নিবিড় প্রকৃতি কোলে সবাই। কিছুণ কার মুখে কথা আসছিল না। অনাবিল ভাললাগায় কানায় কানায় ভরে যাচ্ছিল সবার মন। বিপুলরা একদল বন্ধু প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে এদিক ওদিক। জীবনকে কানায় কানায় উপভোগ করতে কোন বাধা নেই ওদের। সবাই অর্থশালী পরিবারের সনত্মান। তার মধ্যে বিপুলের অবস্থা বেশ ভাল। সৃষ্টিকর্তা ওকে সব দিয়েছেন। চেহারা, মেধা, পারিবারিক অবস্থান_ কোন কিছুতে খামতি নেই। স্কুলবয়স থেকে মেয়েদের প্রতি ওর দুর্বলতা প্রচ-। আজ পর্যনত্ম কাঙ্তি কোন মেয়েকে চেয়ে পায়নি এমন কখনও ঘটেনি। যেভাবে হোক ছলে বলে তাকে বশ করেছে। প্রায় সবার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে ওর। এ নিয়ে মনে কোন গস্নানি নেই ওর। এক জীবনে কোন স্বাদই অপূর্ণ রাখার ইচ্ছা নেই বিপুলের।
ঢাকা থেকে আগত এই দলটির একজন মামুন। ওর চাচার এখানে কাঠের ব্যবসা আছে। সেখানে চাকরি করে শাহজাদা। চাচাকে বলে মামুন শাহজাদাকে এখানকার গাইডের দায়িত্ব দিয়েছে। শাহজাদার মামাত বোন আয়শা। ওরা এখানকার স্থানীয় নয়। শাহজাদা ও আয়শার পরিবার বরিশাল থেকে মাইগ্রেট হয়ে এখানে এসেছে। কাঠের কারখানায় শ্রমিকের চাকরি করে আয়শার বাবা। দরিদ্রই বলতে হবে। বেড়ার ওপরে ছনের ছাউনি দেয়া ঘর। তিন বেলা খাবার জুটলেও মাছ-মাংস জোটে না। হয়ত পরিবারের সদস্য কম হওয়াতে টানাটানি কিছুটা কম। এই রকম পরিবারের মেয়ে হিসেবে আয়শাকে দেখে প্রথমেই মনে হবে, যেন গোবরে পদ্মফুল।
বিপুলের চোখ ঘুরেফিরে আটকে যাচ্ছে আয়শার দিকে। নদীর বাতাসে খুচরো চুলগুলো এসে বার বার ওর মুখ ঢেকে দিচ্ছিল। বিপুলের খুব ইচ্ছা করছিল মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে।
এখানে আসার আগে বিপুলরা সবাই মিলে কক্সবাজার-টেকনাফ ঘুরে এসেছে। টেকনাফে মাথিনের কূপ দেখা নিয়ে আলোচনা করছিল সবাই। মাথিন নামে সাধারণ এক মেয়ে ভালবেসেছিল কলকাতার এক পুলিশ অফিসারকে। প্রেমের অভিনয় করে সেই লোক চলে যায় কলকাতায়। দয়িতের জন্য অপো করে করে কুয়ার ধারে বসে কাঁদত মাথিন। একদিন এভাবে সে মরে গেল। সেই প্রতারিত ভালবাসার কাহিনী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আয়শা সেই প্রসঙ্গে বলছিল কথাটা। নৌকার সবাই যে যার মতো গান গাইছিল। একজনের গান শেষ হলে গান ধরছিল আরেকজন। বিপুলও ওদের সঙ্গে কোরাসে কণ্ঠ মেলাল।
মামুন বলল, হিন্দী-ইংরেজী-বাংলা সব গানই তো শোনা হলো। এবার স্থানীয় ভাষায় একটা গান শোনা যাক। শাহজাদা এখানকার ভাষার কোন গান্ পারো?
শাহজাদা দেখিয়ে দিল আয়শাকে। সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে একটুও ঘাবড়ে গেল না মেয়েটা। বরং বেশ মিষ্টি করে হাসল। তাতে আত্মবিশ্বাস ঝরল। কোন জড়তা নেই। মারমা ভাষায় একটা গান ধরল। 'নিখা নিখা আখি মা/কাসি তেরে গখা মা/সইতু যাদি মাহি খিলিলে। একটু পরে সেই গানের অর্থ বুঝিয়ে দিল। এক রমণীর মনের মানুষ দূরে চলে গেছে। এজন্য তার মন খারাপ। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যায়। মেয়েটি তার মন ভাল করতে সেই পাখির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই মুগ্ধ হলো গান শুনে। বিশেষ করে বিপুলের মুগ্ধতা আকাশ ছাড়াল। মনে মনে সিদ্ধানত্ম নিল মেয়েটাকে ওর যেভাবে হোক পেতে হবে।
বিপুল এর আগে শহুরে মেয়েদের যেভাবে পটিয়েছে সেই পদ্ধতিতে সুবিধা করতে পারল না আয়শাকে পেতে। এখানে ইন্টারনেট নেই। মোবাইল নেই। এসএমএস কিংবা ইমেইলে কারও মন দ্রবীভূত করার উপায় নেই। কিংবা রেস্টুরেন্টে নিয়ে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়ে, শপিং করার ফ্যাশন আয়শার মতো মেয়ের কাছে রূপকথার মতোই। বিপুল সেই পুরনো ফ্যাশন চিঠি লেখায় ফিরে গেল। প্রতিদিন আয়শাকে একটা করে চিঠি দিতে শুরম্ন করল। তাতে কাকুতি মিনতির শেষ নেই। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছে যে নাবিক, তাকে দু'দ- শানত্মি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। আয়শা যেন সেই বনলতা। মেয়েটি যে একটু সাহিত্যপ্রেমী, রোমান্টিক মনের এটা বুঝতে দেরি হয়নি বিপুলের। সমস্যাটা হলো অবস্থানের। আয়শার তুলনায় ও বলা চলে তালগাছের মগডালে অবস্থান করছে। আয়শা সেটাই বোঝাতে চাইল। জীবনটা যে সিনেমা নয়, এখানে রাজপুত্রের সঙ্গে ঘুটে কুড়ানির সম্পর্ক হয় না সেই কথা জানিয়ে দিল। বিপুল হাল ছাড়ল না। এই বিষয়ে ও হাল ছাড়ার পাবলিক নয়। বন্ধুরা কেউ কেউ শুভকামনা জানিয়ে ঢাকায় চলে গেল। দুই-একজন নিষেধ করল, সহজ সরল মেয়েটিকে ছেড়ে দেবার জন্য। কি দরকার ওকে প্রেমের ফাঁদে জড়ানোর ? শহরে তো বান্ধবীর অভাব নেই বিপুলের। কিন্তুও তখন আয়শা নামে মাতোয়ারা। কোন পরামর্শ কানে ঢুকতে চায় না।
অবশেষে আয়শা বশ মানল। হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে প্রেমের চিঠি লিখল বিপুল। আসলে ওটা ওর রক্ত ছিল না। কিন্তুসেই চিঠি পেয়ে আয়শার সেকি কান্না ! বিপুল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল। দমকে দমকে কাঁদতে লাগল আয়শা। এভাবে কেটে গেল অনেক সময়। তারপর আসত্মে আসত্মে আয়শার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল বিপুল। ওর জন্য এ এক এ্যাডভেঞ্চার। কিন্তুসম্পূর্ণ অজানা পুলকে পাগল হবার দশা আয়শার। জীবনে এই স্বাদ ও কোনদিন পায়নি। প্রথম দিন বলে বিপুল বেশী এগোল না। চুমুতেই সীমাবদ্ধ রাখল ওদের প্রথম কয়েক দিনের দেখাসাাত।
বিপুলের চোখে চোখ রেখে আয়শার মনে হলো ওর চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এই পৃথিবী শুধু ওর। ভুলে গেল নিজের অবস্থান। কত অসম্ভবই তো ঘটে পৃথিবীতে। বিপুলের হাত ধরে ও পাড়ি দেবে ঝঞ্ঝাবিুব্ধ নদী। খাড়া উঁচু পাহাড়। বিপুল পাশে থাকলে ও পারবে না এই সৌরজগতে তেমন কিছু নেই।
আয়শার প্রত্যেকটা দিন কাটতে লাগল স্বপ্নের মতো। সকালের সূর্য যখন আলো ফেলত ওর মুখে, মনে হতো এই পৃথিবী এত সুন্দর কেন? জীবন এত আনন্দময় কেন? পুরো দুনিয়া যেন ওর পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়তে প্রসত্মুত।
বিপুলকে নিয়ে পুরো এলাকা এদিক সেদিক চষে বেড়াতে লাগল আয়শা। জীবনটা সরল মেয়েটির কাছে মনে হলো সিনেমার মতো। ঠিক সেভাবে যেন ও পেয়ে গেল কিছুটা লোকচুর অনত্মরালে থাকা এক মাজার। মানুষজন আছে, তবে অন্যান্য মাজারের তুলনায় এখানে ভিড় কম। বিপুল ওকে একদিন শাড়ি পরে আসতে বলল। তারপর ওরা মাজারে বিয়ে করল। সেটা কতখানি ধর্মমতে কিংবা আইনগত প্রক্রিয়াতে হলো বুঝতে পারল না আয়শা। আসলে ওসব বোঝার জ্ঞান ছিল না ওর। শুধু জানল এখন থেকে বিপুল ওর স্বামী।
অবশেষে একদিন নীলগিরি রিসোর্টে আয়শাকে নিয়ে গেল বিপুল। সমুদ সত্মর থেকে অনেক ওপরে অপরূপ সৌন্দর্যপূর্ণ এক জায়গা। সেনাবাহিনীর বড় অফিসার এক আত্নীয়ের মাধ্যমে রম্নম পেতে সমস্যা হলো না। সেখানে দুইদিন আয়শাকে নিয়ে থাকল বিপুল। এক বান্ধবীর বাসায় থাকার কথা বলে আয়শাকে এখানে নিয়ে এসেছে বিপুল। বুদ্ধিটা ওরই দেয়া।
স্বামীর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেয়াই তো নারীর ধর্ম। আয়শার মধ্যে কোন দ্বিধা থাকল না। দু'দিন ওরা ণে ণে একজন আরেকজনের মধ্যে হারিয়ে গেল। কি উত্তেজনা, কি ভালবাসা দু'জনের। দু'দিনের মাথায় বিপুলের আকাশ সম আবেগ সমুদ্রের তলানিতে নেমে আসল। কিন্তু আয়শা তো রীতিমতো প্রেমে উন্মাদিনী। আয়শাকে বাড়ির কাছে পেঁৗছে দিয়ে ঢাকার বাসে রওনা হলো বিপুল। সরল মেয়েটি জানলই না, ওর সারা শরীরে ভালবাসার চিহ্ন এঁকে দিয়ে এভাবে চলে গেছে ওর ভালবাসার মানুষ।

ঢাকায় পা রেখেই বিপুল বড় করে নিশ্বাস নিল। মোবাইলে এদিক ওদিক ফোন করতে লাগল। বাসায় এসে দেখে বাবা-মার মুখ ভার। কেন বন্ধুদের সঙ্গে ফিরে এলো না, ওখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ ইত্যাদি নিয়ে তাদের টেনশনের কথা জানালেন তাঁরা। বিপুল সব অপরাধ মাথায় নিয়ে বাবা-মায়ের কোলে মুখ গুঁজে থাকল। হঠাৎ চমকে উঠল একটি কথা শুনে। বাবা-মা ওর জন্য পাত্রী দেখেছেন। সহসাই বিয়ে দিতে চাইছেন তারা। বিপুল প্রথমে একটু দমে গেল বিয়ের কথা শুনে। কিছুণ পরে ভাবল মন্দ কি? সে তো আর মেয়ে নয় যে বিয়ে করলে সমসত্ম স্বাধীনতার অবসান ঘটবে? বৌকে ঠিকই ম্যানেজ করে নিজের পেস্নবয় কর্মকা- অব্যাহত রাখতে পারবে।

কয়েক মাস চলে গেল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আয়শার অন্ধ হবার দশা। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো ওর গর্ভে সনত্মান। মা নিজের ভাগ্যকে দুষছেন দিনে শতবার। বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কত গর্ব ছিল এই মেয়েকে নিয়ে। এমন পরিবারে জন্ম নিয়েও আয়শার এসএসসি-এইচএসসির ফলাফল যথেষ্ট ভালো। ভেবেছিলেন মেয়ে কোন স্কুলে চাকরি নিয়ে থাকবে বাবা-মায়ের আশপাশে। গর্বে তাদের বুক ভরে উঠবে। কিন্তুভাগ্যের একটি নির্মম পরিহাস!
আয়শার শরীরে আরেকটি মানুষের আগমন বেশিদিন গোপন রাখা গেল না। সবাই ছি ছি করতে লাগল। ওদের বাড়িতে মানুষের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। খেয়ে-না খেয়ে কাটতে লাগল আয়শাদের দিন। গ্রাম্য মাতব্বররা ফতোয়া দিলেন। ১০১ টি দোররা মারা হবে আয়শাকে। একদিন সকালে সালিশ ডেকে হাজির করা হলো জীবন্মৃত আয়শাকে। ১২টি দোররা মারার পরেই আয়শা জ্ঞান হারাল। তারপর চলল যমে মানুষের টানাটানি। একটি অপরিপক্ব শিশুর জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তরণ হতে হতে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল আয়শা । যে বলেছিল, ভালবাসায় সুখের চেয়ে কষ্টটাই বেশি। সে বিড়বিড় গান গাইত নিখা নিখা আমি মা / কাসি তেরে গখা মা।
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যনত্ম আয়শার বিশ্বাস ছিল, বিপুল ফিরে আসবে। দিকে দিকে ঘোষণা দিয়ে বলবে, এই সনত্মান আমার। আয়শা আমার জীবন। আমি ওর স্বামী। তোমরা কোনভাবে আমার স্ত্রীকে অপমানিত করতে পার না।
কিন্তুঅপমান দিয়েই শেষ হলো আয়শার জীবন।
গৌরবে সমুজ্জ্বল বিপুলের বর্তমান অবস্থান। বাবার ব্যবসাবাণিজ্য বেশিরভাগ সে দেখাশোনা করে। প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়। প্রতিবারই সঙ্গে থাকে নিত্যনতুন বান্ধবী। মাঝে মধ্যে স্ত্রী মাহজাবিনও যায়। সে অবশ্য সময় পায় না। সমাজসেবা নিয়ে ব্যসত্ম থাকতে হয়। পথশিশুদের জন্য একটি আশ্রম তৈরি করেছে। এই কাজে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে সে। সেই সুনামের ঝলক বিপুলের গায়েও লেগেছে। সে তার স্ত্রীর বাইরের কোন কাজে বাধা দেয় না। বরং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে, স্ত্রীর বন্দনায় গদগদ হয়ে বুঝিয়ে তার মতো স্বামী আর হয় না। স্বামীর অতিরিক্ত নারীপ্রীতি মাহজাবিন যে বোঝে না তা নয়। কিন্তু মনে মনে ভাবে, আমার তো কোন সমস্যা হচ্ছে না। কারণ তারা কেউ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। খুচরা সম্পর্ক যতই করম্নক, রাতে বাড়ি ফিরে আমার সামনে মাথা নোয়ালেই হলো।
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আয়শার অপরিপক্ব সনত্মানটি বেঁচে যায়। দিন দিন খেয়ে না খেয়ে হাড্ডিসার হয়ে বাড়তে থাকে ও। পথে ঘাটে পড়ে থাকে। কেউ দয়া হলে কিছু খেতে দেয়। নানা-নানির নিজেরই খাবারের বন্দোবসত্ম নেই। নাতিকে কি খেতে দেবে। কাঁদায়-ধুলায় এভাবে কাটে শিশুর জীবন। সবাই ওকে ডাকে নীল। মৃতু্যর আগে আয়শা তাঁর সনত্মানের নাম নীল রাখতে অনুরোধ করেছিল। নীলগিরি পাহাড়ে উদ্দাম ভালবাসার ফসলই তো ওই সনত্মান।
ভিাবৃত্তি করে দুই বেলা খাবার যোগাড় করে নীল। নানা-নানিকেও চালায়। রাসত্মায় বের হলে নীলকে দেখিয়ে সবাই ওর মায়ের কলঙ্কের কথা বলে ্যাপায়। ও মাথা নিচু করে থাকে। কিছু বলে না। অনেকে ওকে জারজ বলে ্যাপায়। তবে ওর সুন্দর ফর্সা চেহারা দেখে কারও কারও মায়া হয়। এখানে বেড়াতে আসা মানুষজন দয়া করে ওকে এটা ওটা খেতে দেয়। টুকটাক ফাইফরমাশ খেটে কিছু টাকা পায় ও।
একদিন নানা-নানির অজ্ঞাতে নীলকে অপহরণ করে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দল। তাদের কাজই হলো ছোট শিশুদের নিয়ে হাত পা কেটে রাসত্মায় ফেলে রেখে ভিা করানো। এভাবে নীল আরও একদল অভাগা শিশুদের সঙ্গে ঢাকায় আসে। কিন্তু জীবনে এই একবার সে ভাগ্যের পরশ পায়। পুলিশ দারম্নন দৌরাত্ব্য দেখিয়ে উদ্ধার করে অভাগা শিশুদের। ওদের নিয়ে আসা হয় পথকলিদের আশ্রমে। যার প্রধান নির্বাহী বিপুলের স্ত্রী মাহজাবিন।
সকালে পত্রিকার পাতায় মাহজাবিনের সংস্থার খবর বলে একটু বেশি মনোযোগের সঙ্গে সেটা পড়ছিল বিপুল। পত্রিকায় নীলের সাাতকার ছাপা হয়েছে। সেখানে সাংবাদিকরা ওকে প্রশ্ন করে, ওর নাম কি ? ওর মায়ের-বাবার নাম জিজ্ঞাসা করে।
নীল উত্তর দেয়, মায়ের নাম আয়শা। সে ওকে জন্ম দিয়েই মারা গেছে। মায়ের ভালবাসা কি ও জানে না।
বাবার কথা বলাতে ঘৃণায় নীলের মুখ নীল হয়ে গেল । কঠিন মুখে জানাল, ওর ইচ্ছা হয় কাছে পেলে তাকে ধরে পেটাতে। কেন ওকে আর ওর মাকে এভাবে প্রতারিত করে চলে গেল লোকটা।
_ কি পড়ছ এত মনোযোগ দিয়ে। ছেলে বাঁধনকে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় মাহজাবিন। স্বামী ও নিজের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছে ও। খুব লক্ষ্মী হয়েছে বাঁধন। এই যে সকাল বেলা তড়িঘড়ি করে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে। কোন কান্নাকাটি নেই।
- তোমার সংস্থার খবর পড়ছিলাম। একদল ছেলেমেয়েকে উদ্ধার করে পুলিশ তোমাদের ওখানে দিয়ে গেছে। ছেলেকে বিপুল কাছে টেনে নিতে নিতে বলে।
_ হঁ্যা শোনো... আমি আজ সারাদিন এটা নিয়ে খুব ব্যসত্ম থাকব। সকাল থেকে পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলো থেকে ফোন আসছে। ব্যাপক প্রচার পাবে আমাদের এই উদ্যোগ। আমি বাঁধনকে স্কুলে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি পিস্নজ ওকে গিয়ে নিয়ে এস, কেমন ?
বিপুল মাথা নাড়ায়। বাঁধনকে আবার কাছে টেনে নিয়ে চুমু খায়। বাঁধনও চুমু খায় বাবাকে। হঠাৎ করে বলে ওঠে, বাবা এই ছেলেটার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে কেন?
_ পুলিশ এদের ধরে তোমার মায়ের অফিসে দিয়ে গেছে। বিপুল কিছুটা বক্রস্বরে উত্তর দেয়। শেষে যুক্ত করে, এরা হলো সব জারজ বাচ্চা।
_ কি বললে বাবা? বাঁধন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
_ ছেলের সামনে এমনভাবে কথা বলো না? মাহজাবিন বিরক্ত হয়ে বাঁধনকে নিয়ে চলে যায়।
বিপুল পত্রিকাটি টেবিলে রাখতে রাখতে আবার বলে ওঠে, শালা জারজ!

No comments

Powered by Blogger.