বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দেশ- যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিলের আশঙ্কা by শওকত হোসেন

তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও শ্রম-অধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা (জিএসপি) বাতিল করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে যে বিশেষ শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পায়, তার নাম জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স বা জিএসপি। এই সুবিধা বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এর অংশ হিসেবে শিগগিরই সরকারি প্রজ্ঞাপন (ফেডারেল রেজিস্টার) জারি করা হবে। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) রন কার্ক বাংলাদেশ সরকারকে একটি চিঠি দিয়ে জিএসপি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শ্রমিক সংগঠনের ইউনিয়ন আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) ২০০৭ সালে বাংলাদেশকে জিএসপি-সুবিধা বাতিলের আবেদন করেছিল। ওবামা প্রশাসন সেই আবেদনটি এবার গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে রয়েছে: শ্রমিক ইউনিয়ন করতে না দেওয়া, শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা ও হত্যার ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। পাশাপাশি সাম্প্রতিক তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে রন কার্কের চিঠিতে।
বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাকপণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইছে। এ জন্য তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে লবিস্ট প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দিয়েছিল। অথচ বাংলাদেশ এখন সেই সুবিধা তো পাচ্ছেই না, বরং অন্যান্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধাও বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এতে পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য পণ্যের বহুমুখীকরণও বাধাগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র পোশাকপণ্যে জিএসপি-সুবিধা না দিলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশকে তা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি বাতিল করলে ইইউর ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এর ফলে সারা বিশ্বে একটি বার্তা যাবে যে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত না। এতে পোশাক খাতের ক্রেতারা একধরনের নেতিবাচক সংকেত পাবেন বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
বিজিএমইএর সভাপতি শফিকুল ইসলাম মহিউদ্দিন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। বাংলাদেশ কর্মপরিবেশ উন্নতির জন্য কাজ করছে। অনেক অগ্রগতিও আছে। আবার বিজিএমইএও চায়, আমিনুল ইসলাম হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। বিষয়গুলো সরকারের সঙ্গে বসে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হবে বলেও তিনি জানান।
রন কার্কের চিঠি: রন কার্ক প্রথম চিঠিটি পাঠান গত ২১ ডিসেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরকে। এরপর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা গত ২৭ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে এ বিষয়ে একটি চিঠি লেখেন। বাণিজ্যমন্ত্রীকে লেখা রন কার্কের চিঠির একটি অনুলিপিও এর সঙ্গে দেওয়া হয়।
বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে রন কার্ক বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপিসুবিধা বাতিলের আবেদনপত্রে বলা আছে, এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করছে না। বিশেষ করে শ্রমিক অধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এসব ব্যাপারে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছিল।
রন কার্ক আরও লেখেন, সরকারের নিজস্ব পর্যালোচনায়ও অনেকগুলো উদ্বেগের বিষয় বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে পোশাকশ্রমিকদের দর-কষাকষির ক্ষেত্রে সংগঠিত হতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে, এ বিষয়ে অগ্রগতি খুবই সামান্য। সরকারের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে অগ্রগতি তো হয়ইনি, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ ও কর্মপরিবেশ উন্নতিতে সংগঠিত ও নিবন্ধিত হতে দেওয়া হচ্ছে না। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আছে যে, যেসব শ্রমিক সংগঠিত হতে চেয়েছেন তাঁদের চাকরিচ্যুত অথবা কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
চিঠিতে রন কার্ক আরও লিখেছেন, এমনও দেখা গেছে, যারা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। যেমন, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার সংগঠন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের তদন্তেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সবশেষে, তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে রন কার্ক বলেন, এই ঘটনার কারণে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশে পোশাক কারখানার নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
এরপরই চিঠিতে রন কার্ক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিএসপিসুবিধা বাতিল করার কথা বিবেচনা করছে তা লেখেন। তিনি বলেছেন, শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিয়মানুযায়ী ফেডারেল রেজিস্টারে (সরকারের গেজেট) নোটিশ জারি করবে। সেখানে ঘোষণা থাকবে, শ্রমিক অধিকারের বিষয়েই তারা বাংলাদেশের জিএসপিসুবিধা বাতিল বা স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছে। এ জন্য গণমতামত চাওয়া হবে। এরপরই প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত কিছু দিন সময় পাবে বাংলাদেশ। সে কথা রন কার্ক চিঠিতেও লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন খুব দ্রুত পরস্থিতির উন্নতির জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’ কী কী ধরনের ব্যবস্থা বাংলাদেশ গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে কিছু ধারণা রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা উপস্থাপন করবেন বলেও সবশেষে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রন কার্ক চিঠিতে উল্লেখ করেন।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির চিঠির জবাব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। কারণ, রন কার্ক যে কথাগুলো চিঠিতে লিখেছেন, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানাতে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অভিযোগগুলো নতুন নয়: বাংলাদেশের শ্রম মান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নতুন নয়। তবে এত দিন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ছাড়াও একাধিক সিনেট ও কংগ্রেস সদস্য এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এবারই প্রথম সরাসরি অভিযোগ উঠল দেশটির নির্বাহী বিভাগ থেকে। এর আগে গত বছরের ১৯ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের শুনানিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পাশাপাশি শ্রম অধিকার ও শ্রমিক নির্যাতনের প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
ওই শুনানিতে মার্কিন শ্রম দপ্তরের কর্মকর্তা রবার্ট বিয়েল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের শ্রমমান এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো অনেক সমস্যা রয়েছে। পোশাক ও চিংড়ি উৎপাদন শিল্পে শ্রমিক নির্যাতন চলছে। আর আমিনুল ইসলাম, যিনি শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করছেন, তাঁর মৃত্যু নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের উদ্বেগ রয়ে গেছে।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে অগ্রগতি দেখাতে হবে। কর্মপরিবেশ উন্নতির ক্ষেত্রে এত দিন পর্যন্ত অর্জন যেমন দেখাতে হবে, তেমনি যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে তার প্রতিশ্রুতিও থাকতে হবে। আর বাকি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) মার্কিন শ্রমিক ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় সংগঠন। এটি এক কোটি ১০ লাখ শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব করে। আর এই শ্রমিকেরা হচ্ছেন ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের সবচেয়ে বড় ভোট ব্যাংক। এ কারণেই এএফএল-সিআইওকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া ২০১৪ সালের ৪ নভেম্বর হবে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও মধ্যবর্তী নির্বাচন। এ কারণেও শ্রমিক সংগঠনগুলো বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চার হাজার ৮৮০টি পণ্যে ১২৯টি দেশকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দিয়ে আসেছে। এ দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ৫০ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আছে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র স্লিপিং ব্যাগ রপ্তানিতে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছিল। এ ছাড়া একই সময়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া ও ইকোয়াটরিয়াল গায়ানার জিএসপি সুবিধা বাতিল করে। কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে একটি দেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল সহসা যুক্তরাষ্ট্র করেনি বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.