জন্মই কি আজন্ম পাপ!- আফসা পারভীন

একুশ শতকে এসেও নারী নির্যাতন কমেনি বরং নির্যাতনের ধরন বদলেছে। আমরা নির্যাতন বলতে কেবল শারীরিক নির্যাতনকে বুঝি। কিন্তু একজন নারী শুধু শারীরিকভাবে নির্যাতিত নয়, সে মানসিকভাবেও নির্যাতনের শিকার হয় প্রতিমুহূর্তে।
যা হয়ত আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায় এবং আমরা সে বিষয়ে সচেতন নই। একজন নারীর যখন জন্ম হয় কন্যাসনত্মানরূপে তখন থেকেই শুরম্ন হয় নির্যাতন এবং এ নির্যাতন চলে মৃতু্য পর্যনত্ম। পিতার পুত্রসনত্মানের আশায় কন্যাসনত্মানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কন্যাটি পিতার আদর ও স্নেহ থেকে যতটা বঞ্চিত হয় ঠিক ততটাই শোষণ ও শাসনের শিকার হয়। একই পরিবারে একটি ছেলের দিকে যতটা দৃষ্টি দেয়া হয়, মেয়েটিকে ততটাই অবহেলা করা হয়। ছেলেটিকে বেশি পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হয়, যাতে তার শারীরিক বিকাশ হয়। তেমনি পড়াশোনার দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়, যাতে তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়। অথচ একটি মেয়ে যদি বাবা-মায়ের সমান আগ্রহের বিষয় হতো তাহলে সেও যথার্থভাবে বেড়ে উঠত। মেয়েটি সাবালিকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যে একজন মেয়ে এবং মেয়ে হওয়ার জন্য তাকে সমাজে কিভাবে চলতে হবে তারই প্রেসক্রিপশন পরিবার থেকে অহরহ দেয়া হয়। তখন বিষয়টি দাঁড়ায় এ রকম চুন থেকে পান খসলেই খবর আছে। এ খবর চলে সারাজীবন ধরে।
পর্দাপ্রথা, বাল্যবিবাহ, যৌতুকের শিকার হয়ে কত মেয়ে যে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে তার সঠিক হিসেব দেয়া কারও পইে সম্ভব নয়। এ বিষয়টি আপাতত আলোচনার বাইরে থাক। এবার যৌন নির্যাতন বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। একটি মেয়ে তার আত্মীয়স্বজন থেকে শুরম্ন করে বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক, অফিসের বস, সহকর্মী দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার হয় এবং সবই নীরবে সহ্য করতে হয়। প্রতিবাদ করা তো দূরে থাক; কারও সঙ্গে শেয়ার পর্যনত্ম করতে পারে না অপবাদের ভয়ে। পাছে তাকে সবাই খারাপ মনে করে। এ যৌন হয়রানি এমন পর্যায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, তার প েপড়াশোনা অথবা চাকরি করাও দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। যৌন প্রসত্মাবে সাড়া না দেয়ায় অনেক সময় তিগ্রসত্ম হতে হয়। শিক কৌশলে পরীায় কম নম্বর দেয়। পরীার ফলাফল আশানুুরূপ হয় না। অনেক সময় বস অথবা সহকর্মী হয়রানিতে সম্মানের ভয়ে চাকরি পর্যনত্ম ছাড়তে হয়। প্রেমের প্রসত্মাবে সাড়া না দিয়ে এ্যাসিড নিেেপর শিকার হয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে অনেক মেয়ে। স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও সেটা সহজভাবে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। পত্রিকার পাতা খুললে দেখি শিশু ধর্ষণের শিকার। এটি আমাদের সমাজে কলঙ্কিত অধ্যায়। শুধু যৌন নির্যাতন নয়, মানসিক নির্যাতনও চলে নীরবে। বাবা-ভাইয়ের শাসন অনেক সময় শোষণের পর্যায়ে চলে যায়। ঘরের বাইরে যাব ইভটিজিং তো আছে। এ ইভটিজিং এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পেঁৗছেছিল যে, কিশোরী থেকে শুরম্ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। প্রেমে প্রতারিত হয়ে আত্মহনন করেছে অনেক মেধাবী ছাত্রী। এ চিত্র নারীর চরম অসহায়ত্বের পরিচয় দেয়।
নারী অসহায় মা-বোন-মেয়ে-স্ত্রীরূপে। কেননা তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়। প্রথমে বাবা-ভাইয়ের দিকে এবং পরে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাই সকল ইচ্ছা-অনিচ্ছার মৃতু্য ঘটে। অন্যদিকে আমরা যদি দেখি স্ত্রী যদি স্বামী থেকে বেশি শিতি হয় অথবা উচ্চ পর্যায়ে চাকরি করে তাহলে সেটাও অনেক সময় নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ পুরম্নষতান্ত্রিক সমাজে পুরম্নষের চেয়ে বেশি নারীর অগ্রগতি কাম্য নয়। নারী থাকবে তার অধীনস্থ । তাই বেগম রোকেয়া যথাযর্থ বলেছেন_
"পাঠিকাগণ আপনারা কি কোনদিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিনত্মা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি? দাসী। পৃথিবী হইতে দাসব্যবস্থা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই। কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না, যায় নাই।"
নারীকে যখন টিভির বিজ্ঞাপন অথবা সিনেমার পর্দায় যেভাবে উপস্থাপিত হতে দেখি তখন বলতে ইচ্ছে করে এসব বন্ধ কর। নারীকে তার যথার্থ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে সকল েেত্র দেখতে চাই। নারী যখন তার আপন যোগ্যতায় সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখনও তাকে বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়।
নারী তার পোশাক, সাজগোঁজ, বেড়ানো সব কিছুতেই সমালোচনার শিকার হতে হয়। কোন কিছুই যেন সমাজকে খুশি করে না। পুরম্নষ মানুষকে খুশি রাখাই যেন নারীর জীবনের একমাত্র ল্য, ধ্যান-জ্ঞান, সাধনা হওয়া উচিত। নারীর কোন েেত্র সমঅধিকার নেই। বাসের মধ্যে নারীর জন্য কয়েকটি সিট বরাদ্দ থাকে। সেই সিটে বসতে গিয়ে ঝগড়া করতে হয়। কটুবাক্য শুনতে হয়। সেখানে সম্পত্তিতে সমঅধিকারের কথা ভাবতেই যেন ভয় লাগে। নারী যে কতটা নির্যাতিত তার জন্য ইতিহাসের পাতা উল্টানোর প্রয়োজন নেই। কিংবা রবীন্দ্রনাথের হৈমনত্মী অথবা আধুনিককালে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়তে হয় না। নিজের জীবনকে বিশেস্নষণ করলেই বোঝা যায় নির্যাতনের স্বরূপ।
আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী হওয়া সত্ত্বেও তারা পুরম্নষতন্ত্র ভাঙ্গতে পারেনি। কারণ পুরম্নষতন্ত্রের শেকল ভেঙ্গে দেশ শাসন করা তাদের প েসম্ভব নয়।
বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণের আন্দোলন থেকে বর্তমানে নারীবাদী আন্দোলন নারীকে তার অধিকার আদায়ের পথে কয়েক ধাপ আগালেও নারী নির্যাতন কিন্তু বন্ধ করতে পারেনি। এ নির্যাতন-নিপীড়ন কঠোরভাবে দমন করার ল্যে এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো ঘৃণ্য অপরাধের যথাযথ বিচার করার জন্য সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ প্রণয়ন করে এবং ২০০৩ সালে এর সংশোধনী অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে নারী ও শিশুদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন যেমন- ধর্ষণ, এ্যাসিড নিপে, নারী ও শিশু পাচার, অপহরণ এবং যৌতুকের নির্যাতনসহ অন্য সকল অপরাধের কঠোর শাসত্মির বিধান করা হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এ আইন কি যথেষ্ট?
যখন দেখি বাড়ির কাজের মেয়েকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, জোর করে নারীকে দিয়ে যৌন ব্যবসা করানো হচ্ছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকের মানসিক অসুস্থতা ঘটছে। তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এ ধরনের নির্যাতন রোধের কোন আইন আছে কি? কেননা শারীরিকভাবে নির্যাতনকেই আমরা নির্যাতন বলে জানি। কিন্তু মানসিকভাবে যে নির্যাতন প্রতিমুহূর্তে নারীকে তার কাঙ্ৰিত ল্যে পেঁৗছাতে বাধাগ্রসত্ম করছে তার কি কোন বিচার আছে? কেননা নারী নির্যাতনের সঠিক পরিসংখ্যান সরকার অথবা বেসরকারী সংস্থা কারও পইে দেয়া সম্ভব নয়। প্রশাসন এ বিষয়ে সঠিক পদপে গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারে যে, নারী নির্যাতন বাড়ছে না কি কমছে। কিন্তু প্রশাসনের উদাসীনতা অথবা ব্যর্থতা নারী নির্যাতন বন্ধে একটি বড় অনত্মরায়। সরকার অবিলম্বে এ বিষয়ে সঠিক পদপে নেবে বলে নারীসমাজ আশা করে।

No comments

Powered by Blogger.