তত্ত্বাবধায়কের হালুয়ারুটি যাঁরা খেয়েছেন তাঁরাই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন- আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরে জুলুম-নির্যাতন ও ভীতিকর অবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ওই সময়ে তত্ত্বাবধায়কের যে ভূত চেপে বসেছিল, তা এখনও বিলীন হয়ে যায়নি। আমরা শুধু ঠেকিয়েছি।


ওই অবস্থা আবার ফিরে এলে আজ যারা সোচ্চার তারাও রেহাই পাবে না। ওই তত্ত্বাবধায়কের সময় যাঁরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন ও হালুয়ারুটি খেয়েছেন, তাঁরাই আজ বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের দোষ দেখতে তৎপর। নানাভাবে তাঁরা দেশবাসীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এদের কথায় বিভ্রান্ত না হতে এবং তত্ত্বাবধায়ক সময়ের ভীতিকর অবস্থা বাংলাদেশে যেন না আসে সে জন্য দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সৃষ্ট অসন্তোষে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনের নামে একজন শিক্ষক বা ছাত্র আরেক ছাত্র বা ছাত্রীর গা থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে তা সিঁড়িতে ঢেলে দেয়ার মতো বিকৃত চিন্তা কিভাবে আসে? যেসব শিক্ষক তাঁদের কলিগদের (সহকর্মী) অপমান করতে ছাত্রদের ব্যবহার করছেন, একদিন তাঁদেরও যে এভাবে অপমানিত হতে হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? আমরা পরিস্থিতি শান্ত করতে কঠোরভাবে কিছু করতে চাইনি। সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি। তবে কঠোর কিভাবে হতে হয় তা আমাদের জানা আছে। আমরা কোন শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না।
শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের সাত সহযোগী ও তিন ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে এক সৌজন্য বৈঠকে সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। হলমার্কসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানেই কোন অনিয়ম হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কাউকে আমরা ছাড় দিচ্ছি না। ছাড় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থা কারোর মনোপূত হচ্ছে না বলেই তারা নানা কথা বলার চেষ্টা করছেন।
সূচনা বক্তব্যের পর সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। জানা গেছে, ওই বৈঠকে সাবেক ছাত্রনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রীয়সহ সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- এবং বিরোধী দলের নেতিবাচক রাজনীতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ দেয়া হয়। বুয়েটসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক অসন্তোষ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কেননা তিনিই চ্যান্সেলর। কোন ভিসিকে কারও পছন্দ হচ্ছে নাÑএ নিয়ে আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চিত করে তোলা কারও কাম্য হতে পারে না। কেননা এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কিছু শিক্ষক ছাত্রদের ব্যবহার করে তাদের সহকর্মীদের অপমান করার জন্য ব্যবহার করছেন, মধ্যরাতে ভিসির অফিস দখল করাচ্ছেনÑ এটা কেমন কথা। ছেলেদের বেয়াদব বানালে একদিন তারাই চড় মেরে বসতে পারে।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রদের এসব কী শেখাচ্ছেন, কী দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন? আজ ছাত্রদের যেসব শেখাচ্ছেন একদিন তা আপনাদের ঘাড়েও পড়তে পারে। একদিন আপনাদেরও যে এমন অপমানকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? যদি কোন সমস্যা থাকে জানাতে পারেন। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করব। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভিসির অপসারণে আন্দোলন করা হলো, পরবর্তী ভিসি প্যানেলের নির্বাচনে ওই ব্যক্তিই সর্বোচ্চ ভোটে বিজয়ী হলো। তাহলে আন্দোলনকারীদের মুখ থাকল কোথায়?
বিএনপি-জামায়াত জোটের ৫ বছর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এই সাত বছরের উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে বর্তমান মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের উন্নয়নের তুলনা করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সাড়ে তিন বছরে যা করেছি, গত সাত বছরে তা করতে পেরেছে কিনা তা দেশবাসীকে একটু বিচার করার জন্য অনুরোধ করব। জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে বলেই আমরা এত উন্নয়ন করতে পেরেছি।
বিদ্যুত উৎপাদন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমরা বিদ্যুত উৎপাদন করে রেখে গিয়েছিলাম ৪৩শ’ মেগাওয়াট। সাত বছর পর এবার ক্ষমতায় এসে পেলাম ৩২শ’ মেগাওয়াট! অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ৫ বছর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এই সাত বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন তো বাড়েইনি, বরং কমেছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জরুরী অবস্থা দিয়ে সেনা সমর্থিত উচ্চ ক্ষমতার সুশীল সমাজের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন দুই বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারল না? আমরা মাত্র সাড়ে তিন বছরে যা করতে পেরেছি, বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাত বছরেও তা পারল না কেন? যারা কিছু করতে পারে না তারাই আজ বড় বড় কথা বলছে।
দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে যে কোন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, উচ্চ ক্ষমতার সুশীল সমাজের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের কোন উন্নয়ন করেনি, শুধু ধর-মার, অত্যাচার-নির্যাতন করে দেশকে ভীতির রাজ্যে পরিণত করতেই ব্যস্ত ছিল। রাজনীতি করি বলে আমাদের জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করতে হয়Ñএটা আমরা জানি। কিন্তু ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক-ব্যবসায়ীসহ এমন কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ নেই যে তখন অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হন।
সঠিক তথ্য সংবলিত সংবাদ পরিবেশনের জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু গণমাধ্যম আছে যারা অনেক কিছু লিখে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেন। একটি গণমাধ্যমে লেখা হলো যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণে ওয়াসার পাইপ সরানো নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, আমার হস্তক্ষেপে নাকি অনেক টাকার খরচ বেঁচেছে। আসল তথ্য হচ্ছে, ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় ওয়াসার পাইপসহ অন্যান্য কিছু না সরিয়ে সবকিছু ঠিক রেখে প্রয়োজনে দুটি পিলার নির্মাণের কথা বলেছি।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, কয়েক জায়গায় একটির স্থলে দুটি পিলার নির্মাণের ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খরচ কিছুটা বাড়বে। যেখানে কোন ওয়াসার পাইপ সরানোই হয়নি, সেখানে খরচ বা দুর্নীতি হলো কোথা থেকে? তিনি বলেন, সঠিকভাবে সবকিছু জেনেই নিউজ করা উচিত। কোন আজগুবি বা কাউকে টার্গেট করে হেয় করার জন্য কোন নিউজ লেখা ঠিক নয়।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির ওই ৫ বছরে দুর্নীতিতে কোন রাখঢাক ছিল না, সবকিছু ছিল ওপেনসিক্রেট। বল্গাহীন দুর্নীতি, দুঃশাসন, জঙ্গীবাদ সৃষ্টি, হত্যা, নির্যাতন ও প্রশাসনের সর্বস্তরে নগ্ন দলীয়করণের মাধ্যমে সমস্ত সিস্টেমকেই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। একজন প্রধানমন্ত্রী (খালেদা জিয়া) হয়েও দুর্নীতির কালো টাকা জরিমানা দিয়ে সাদা করেছেন। তাঁর পুত্রদের ঘুষ-দুর্নীতির কথা তো দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এসে বাংলাদেশে তাঁর (খালেদা জিয়া) পুত্রদের বিদেশে অর্থ পাচার ও ঘুষ-দুর্নীতির কথা সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন।
মহাজোট সরকার জনগণের ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করেছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে প্রায় ৫ হাজার দু শ’টি বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে। এমন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে কোনদিন হয়নি। আমরা জনগণের ভোটের সাংবিধানিক অধিকারে বিশ্বাস করি বলেই কোন নির্বাচনে কোন হস্তক্ষেপ করিনি। জনগণ স্বাধীন ও মুক্তভাবে ভোট দিয়ে যাকে খুশি নিজের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। একটি নির্বাচনেও কেউ কোন অভিযোগ আনতে পারেনি।
এ সৌজন্য বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, কেন্দ্রীয় নেতা মৃণাল কান্তি দাস, এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, এনামুল হক শামিম, যুবলীগের ওমর ফারুক চৌধুরী, হারুন-অর-রশিদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোল্লা মো. আবু কাউছার, পংকজ দেবনাথ, শ্রমিক লীগের শুক্কুর মাহমুদ, সিরাজুল ইসলাম, কৃষক লীগের মোতাহার হোসেন মোল্লা, খন্দকার শামসুল রেজা, মহিলা আওয়ামী লীগের আশরাফুন্নেসা মোশাররফ এমপি, পিনু খান এমপি, যুব মহিলা লীগের নাজমা রহমান এমপি, অধ্যাপিকা অপু উকিল এমপি, তাঁতি লীগের এনাজুর রহমান চৌধুরী, সাধনা দাশগুপ্তা, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান এবং ছাত্রলীগের এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সিদ্দিকী নাজমুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.