স্টিভ জবসের জীবনের ৯ তথ্য by জাহাঙ্গীর আলম

প্রযুক্তি পণ্যের শীর্ষ কোম্পানি অ্যাপলের কর্ণধার থাকাকালে এবং মৃত্যুবধি স্টিভ জবস বিভিন্ন দিক দিয়েই এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যু সরাসরি জানা গেল না আর শেষকৃত্যও হয়ে গেলো একান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গোপনীয়। জীবনের নির্দিষ্ট কিছু বিষয় সব সময়ই গোপন করেছেন। পারিবারিক জীবন থেকে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার; যে রোগে শেষ পর্যন্ত গত বুধবার মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি চিরবিদায় নিলেন, এর মাঝের বর্ণময় জীবনের খুব কম তথ্যই সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে।

অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং এর প্রধান নির্বাহী থাকা অবস্থায় বেশিরভাগ সাক্ষাতকারেই তিনি ব্যক্তিগত বিষয় এড়িয়ে গেছেন। ব্যক্তি জবসকে জানতে ভক্তদের সীমাহীন আগ্রহ তো রয়েছেই, তাছাড়া সেসব বিষয় জানতে পারলে হয়ত বুঝা যেতো কীসে তাকে প্রযুক্তি জগতের মহীরুহে পরিণত করল।

সেই আগ্রহ থেকেই তার জীবনের জানা কিছু তথ্য তুলে ধরা গেলো-

শৈশব ও প্রথম জীবন

স্টিভ জবসের জন্ম হয় যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। জন্মের কিছু পরেই ক্লারা ও পল জবস দম্পতি তাকে দত্তক নেন। ক্যালিফোর্নিয়ার মাউনটেন ভিউতে জবস দম্পতির পরিবারে তিনি বড় হন। দত্তক পিতা ছিলেন লেজার কোম্পানির যন্ত্র মেরামতকারী এবং মা চাকরি করতেন হিসাব রক্ষক হিসেবে।

পরে জবস তার আসল বাবা-মাকে খুঁজে বের করেছিলেন। তার জন্মদাত্রী মা জোয়ান সিম্পসন; স্নাতক পাস করার পর বাকশক্তির সমস্যাজনিতক রোগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। আর তার আসল বাবা আবদুল ফাত্তাহ জন জানদালি একজন সিরীয় মুসলিম। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যান মাত্র ১৮ বছর বয়সে। এখন নেভাদাতে একটি ক্যাসিনোর ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে জানা যায়। জবস যখন তার মাকে খুঁজে পান তখন বাবার সঙ্গে মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

অর্থ সঙ্কটে কলেজের পড়া বন্ধ

এ যাবতকালের সবচে সফল প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিকল্পক, পরিচালক স্টিভ জবস, অথচ তিনি কখনোও কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিতে পারেননি। শুধু তাইই নয়, প্রচলিত পড়াশুনায় মনোযোগীও ছিলেন না। ক্যালিফোর্নিয়ার কুপারটিনো উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক নেওয়ার পর ১৯৯২ সালে রিড কলেজে ভর্তি হন। কুপারটিনো শহরেই অ্যাপলের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। পোর্টল্যান্ড অরেগোনের লিবারেল আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রিড কলেজে তিনি মাত্র এক সেমিস্টার শেষ করেছিলেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি অনেক বেশি হওয়ায় বাবা-মা খরচ চালাতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি কলেজ ছেড়ে দেন।

২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া সেই বিখ্যাত বক্তৃতায় জবস রিড কলেজে তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন এভাবে- ‘সব কিছু মিলিয়ে সেখানের স্মৃতি খুব সুখকর ছিল না। কলেজের হোস্টেলে আমি কোনো কক্ষ বরাদ্দ পাইনি, সুতরাং বন্ধুদের কক্ষে গিয়ে মেঝেতে ঘুমোতে হতো। কোকের বোতল সংগ্রহ করে ৫ সেন্ট পেতাম, তা দিয়ে খাবার কিনতাম। একটু ভাল খাবারের লোভে প্রতি রোববার রাতে সাত মাইল দূরে হরেকৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম, পায়ে হেঁটে।’

আটারিতে প্রথম কাজ

স্টিভ জবস ব্যক্তিগত কম্পিউটার, মোবাইল প্রযুক্তি এবং সফটওয়ারের বিস্ময়কর উদ্ভাবনী যোগ্যতার জন্য বিখ্যাত। তবে সবচে জনপ্রিয় ভিডিও গেম তৈরিতেও তার অবদান রয়েছে। ১৯৭৫ সালে জবস ভিডিও গেম তৈরির প্রতিষ্ঠান আটারির সঙ্গে যুক্ত হন। সেখানে তিনি পোং এর মতো ব্রেকআউট নামে একটি ভিডিও গেম উন্নয়নের কাজে চুক্তিবদ্ধ হন।

এই কাজের জন্য তাকে ৭৫০ ডলার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেই সঙ্গে গেমের চূড়ান্ত ডিজাইনের পর প্রত্যেকটি ভুলভ্রান্তি সমাধার জন্য আরও ১০০ ডলার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই চ্যালেঞ্জে সহযোগিতার  জন্য জবস স্টিভ ওজনিয়াককে সঙ্গী হিসেবে নেন।

ওজনিয়াক গেমটির প্রাথমিক ডিজাইন এতোটা দক্ষতার সঙ্গে ছোট করে ফেলেন যে, আটারি খুশি হয়ে তাদের ৫ হাজার ডলার বোনাস দেয়। কিন্তু বোনাসের পুরো টাকা জবস নিজের জন্য রাখেন আর ওজনিয়াককে দেন মাত্র ৩৭৫ ডলার। ওজনিয়াক তার আত্মজীবনীতে এ কথা লিখেছেন।

প্রিয় সহধর্মীনি, যাকে তিনি একা ফেলে গেলেন

পরিবারের অন্য সব বিষয়ের মতোই জবস তার বিয়ের বিষয়টিও সাধারণের গোচরের বাইরেই রেখেছেন। পণ্যের বিজ্ঞাপণ বা অন্যকোনো কারণে সবসময়ই তিনি যেভাবে মানুষের সামনে আসতেন সেই স্টাইল অনেকটা তার ট্রেডমার্ক হয়ে গিয়েছিল। মঞ্চে একা, উঁচু বৃত্তকার গলার বিশিষ্ট কালো সোয়েটার আর জিন্স পরিহিত জবস যেনো আইকন হয়ে গেছেন।

কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো, প্যালো আলটোর বাসায় তিনি বসবাস করতেন স্ত্রী ল্যরেন পাওয়েল ও তিন সন্তানের সঙ্গে। তবে পরিবারে স্বামী ও পিতা হিসেবে জবস কেমন তা কখনও জানা হয়নি। এখন যদি তার স্ত্রী বা সন্তানরা কিছু জানান..।

ল্যরেন একজন উদ্যোক্তা। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত হোয়ারটোন বিজনেস স্কুলে পড়েছেন তিনি। পরে স্ট্যানফোর্ড থেকে এমবিএ করেন। এখানেই জবসের সঙ্গে দেখা হয় তার।

১৯৯১ সালে উসোমাইট ন্যাশনাল পার্কে আহুয়ানি হোচেলে জবস-পাওয়েলের বিয়ে হয়। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করেন কোবিন চিনো নামে এক জেন বৌদ্ধ ভিক্ষু।

জবসের লেখক বোন

আসল বাবা-মাকে খুঁজতে গিয়ে আপন বোনেরও খোঁজ পেয়ে যান জবস। তার বোনের নাম মোনা সিম্পসন। জন্মের সময় অবশ্য নাম রাখা হয়েছিল মোনা জানদালি। একজন মা ও তার মেয়েকে ঘিরে তার লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘এনিহোয়ার বাট হেয়ার’ অবলম্বনে হলিউডে চলচ্চিত্র হয়েছে। অভিনয় করেছেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী নাটালি পোর্টম্যান এবং সুসান স্যারানডোন।

বোনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তারা অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমসেকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জবস একদিন তার বোন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমরা একটা পরিবার। পৃথিবীতে সে আমার সেরা বন্ধু। প্রতি দিনই আমি তাকে ফোন করি এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি।’

মোনা সিম্পসন তার এনিহোয়ার বাট হেয়ার উপন্যাসটি জবসকে উৎসর্গ করেছেন।

জবসের রোমাঞ্চ

রিড কলেজের এক সহপাঠীর লেখা জীবনীতে জবসের রোমন্টিকতার কিছু ঘটনা জানা যায়। দ্য সেকেন্ড কামিং অব স্টিভ জবস নামের ওই গ্রন্থে বন্ধুটি দাবি করেছেন, জোয়ান বায়েজ নামে এক ফোক সিঙ্গারের সঙ্গে জবসের মাখামাখি ছিল।  জোয়ান স্বীকার করেছেন, খুবই অল্প সময় জবসের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। অবশ্য বিখ্যাত ফোক সিঙ্গার বব ডিলানের সঙ্গে জোয়ানের মন  দেওয়া নেওয়ার ঘটনা সবাই জানে। ডিলান আবার জবসের সবচে প্রিয় শিল্পী।

ওই বইতে আরও দাবি করা হয়েছে, অভিনেত্রী ডিয়ানে কিটোনের সঙ্গেও জবসের ক্ষণিক সম্পর্ক ছিল। তবে এসব তথ্য খুব নির্ভরযোগ্য নয়।

জবসের প্রথম কন্যা

হাইস্কুলে পড়ার সময়ই যখন জবসের বয়স ২৩ বছর তখন বান্ধবী ক্রিস অ্যান ব্রেনান গর্ভবতী হন। ১৯৭৮ সালে তিনি লিসা ব্রেনান জবস নামে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন। ঠিক ওই সময়ই অ্যাপল তরতর করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।

ব্রেনানের সঙ্গে অবশ্য জবসের কখনও বিয়ে হয়নি। এমনকি ওই সন্তানের পিতৃত্বও স্বীকার করতে চাননি তিনি। তবে পরে ব্রেনানের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং জবস তার প্রথম মেয়েকে হার্ভার্ডে পড়াশুনার জন্য খরচ দিতে রাজি হন। মেয়ে ক্রিস ব্রেনান ২০০০ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এখন তিনি একটি সাময়িকীতে লেখেন।

ল্যরেন পাওয়েলের সঙ্গে বিয়ের পর জবসের ঘরে তিনটি সন্তান এসেছে।

তার জীবনের অন্য দিক

ব্যক্তিগত অনেক কিছু গোপন রাখলেও প্রথম জীবনে এলএসডি ড্রাগ নেওয়ার কথা অবশ্য আকারে-ইঙ্গিতে স্বীকার করেছেন জবস। এক সাক্ষতকারে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তার শুভ কামনা করি, এবং তা মনে প্রাণেই করি। আমি মনে করি, তিনি এবং মাইক্রোসফট একটু চাপা স্বভারের। তাকে অনেক বড় মনের মানুষ বলতাম, যখন ছোট ছিলেন তখন যদি তিনি একটিবারের জন্য এসিডটা ছেড়ে দিতেন অথবা কোনো আশ্রমে যেতেন।’

জবসের মাদক গ্রহণের প্রমাণ মেলে এলএসডির উদ্ভাবক সুইস বিজ্ঞানী আলবার্ট হফম্যানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে। এই মাদক চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্য গবেষণায় অর্থ সহায়তা চেয়ে জবসকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন হফম্যান।

একটি বইয়ে জবসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মাদক নেওয়ার অভিজ্ঞতাকে তিনি তার জীবনের একটি বা দুটি সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি নিজে এলএসডির সাফাই গেয়েছেন। অ্যাপলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ডিজাইন তৈরিতে এই মাদক তার ভাবনায় ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

স্টিভ জবস চিরকালের একজন পদপ্রদর্শক হিসেবে বেঁচে থাকবেন। জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তার সফলতার পেছনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি অনেকটা আধ্যাত্মবাদী ছিলেন। জীবনের প্রথম দিকে ভারত সফরে তিনি একটি বিখ্যাত আশ্রম পরদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ফেরেন একজন জেন বৌদ্ধ হিসেবে।

জবস মাছ ছাড়া পশুর মাংস বা মাংসজাত কোনো খাবার খেতেন না। প্রাচ্যের ভেষজ বিদ্যায় তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। ২০০৪ সালে ক্যান্সার টিউমারের অপারেশন করার আগে তিনি ভিন্ন্ উপায়ে (ভেষজ ও বিশেষ খাবার) এর চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছিলেন।

তার সম্পদ

বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডের প্রধান নির্বাহী হওয়া সত্ত্বেও জবসের বাৎসরিক বেতন ছিল অবিশ্বাস্য রকম কম।  বছরে তিনি নিতেন মাত্র এক ডলার! অবশ্য এরকম ব্যাপার করপোরেট জগতে নজিরবিহীন নয়; গুগলের ল্যারি পেজ, সেরগেই ব্রিন এবং এরিক স্মিট বছরে বেতন নেন একশ’ পেনি। জবস এই বেতন নিচ্ছিলেন ১৯৯৭ সালে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী হওয়ার পর থেকেই।

এই অতিঅল্প বেতন নিয়ে ২০০৭ সালে একবার মজা করে বলেছিলেন, ‘খালি চেহারা দেখিয়ে আমি বছরে পাই ৫০ সেন্ট আর বাকি ৫০ সেন্ট পাই আমার কাজের জন্য।’

২০১১ সালের প্রথম দিকে অ্যাপল কোম্পানিতে জবসের শেয়ার দাঁড়ায় ৫৫ লাখে। তার মৃত্যুর পর অ্যাপলের শেয়ারের দাম ওঠে ৩৭৭.৬৪ ডলার। গত দশ বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম প্রায় ৪৩ গুণ বেড়েছে আর এর দাম পড়েনি কখনো।

বছরে মাত্র এক ডলার বেতন নিলেও জবস আসলে রেখে গেছেন অঢেল সম্পত্তি। ২০০৬ সালে ডিজনির কাছে এনিমেশন সফটওয়ার পিক্সার বেচে তিনি কামিয়েছেন প্রায় ৭০০ কোটি ডলার। একসাথে সবচে বেশি আয় এটি। ফোর্বস সাময়িকীর জরিপে ২০১১ সালে তার মোট সম্পদের মূল্যমান ৮৩০ কোটি ডলার। তিনি পরিণত হন বিশ্বের ১১০তম শীর্ষ ধনী।

১৯৮৫ সালে অ্যাপল ছেড়ে যাওয়ার সময় সব শেয়ার বিক্রি করে না দিলে তিনি বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষ ধনী হতে পারতেন। জবস অ্যাপলে ফিরে আসেন ১৯৯৬ সালে।

মরার আগে অবশ্য এই বিশাল সম্পত্তির ব্যাপারে কিছু বলেননি জবস। কিন্তু উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন স্ত্রী ল্যরেন, তিন সন্তান রিড, এরিন এবং ইভ। স্কুল জীবনে বান্ধবীর গর্ভে জন্ম দেওয়া প্রথম কন্যা লিসা ব্রেনান তো আছেনই।

No comments

Powered by Blogger.