সরকারকে সতর্ক করল বাংলাদেশ ব্যাংক by জাকির হোসেন

বাজেট ব্যয় মেটাতে বেশিমাত্রায় ব্যাংক ঋণনির্ভর হওয়ায় সরকারকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, সম্প্রতি ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে সরকারকে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রাপ্যতা কমে যায়। এছাড়া সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ মানে নতুন নোট ইস্যু, যা বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি উস্কে দেয়।

সরকারের ব্যাংক ঋণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে যাওয়ায় অর্থনীতিবিদরা এরই মধ্যে এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু রিপোর্ট ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ নিয়ে সতর্ক করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে চলতি অর্থবছরের আড়াই মাসে অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৪ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৬২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ১২ মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, অর্থবছরের শুরুর দিকে রাজস্ব আদায় কম থাকে। আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ সময় মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত। এ কারণে এ মুহূর্তে সরকার তার প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে বেশি বেশি ধার করছে। ব্যাংকের বাইরে অন্যান্য উৎস_ সঞ্চয়পত্র এবং বৈদেশিক উৎস থেকে তুলনামূলকভাবে কম ঋণ পাওয়ায় সরকার ব্যাংক ঋণের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে সরকার একটু বেশি ঋণ নিলেও মুদ্রা সরবরাহ কিংবা অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি যাতে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকে সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান সরকারের ঋণ গ্রহণ সম্পর্কে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি সমকালকে বলেন, বর্তমান মুদ্রানীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি দু'এক মাসের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সম্প্রতি ডেইলি স্টার আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি বর্তমান সরকারের আমলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে আগস্টে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি (গত বছরের একই মাসের তুলনায় পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি) হয়েছে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। সরকার আন্তর্জাতিক বাজারকে মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করলেও এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, বর্তমানের মূল্যস্ফীতি শুধু আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই ঘটছে না। অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাহিদা বাজারে টাকার জোগান বাড়িয়ে পণ্যের মূল্য বাড়াচ্ছে। এ কারণে তারা চাহিদা ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ মুদ্রানীতি সংকোচনের পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বর্তমানে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে মুদ্রা সরবরাহের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যে থাকা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যমতে, বর্তমানে মুদ্রা সরবরাহের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের বেশি রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.