ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে তাঁদের ছবি

ক্রীড়া প্রতিবেদক : ক্রিকেটে 'পেস ব্যাটারি' বিশেষণের উৎপত্তিস্থল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সোনালি সেই সময় পেরিয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে ধেয়ে আসা তীরের বিষভাবটা খুব নেই। তবে গতি তো আছে! তাই স্লো উইকেটেও দেবেন্দ্র বিশুকে বাদ দিয়ে কেমার রোচ, ফিদেল এডওয়ার্ডস ও রবি রামপালদের 'হোমওয়ার্ক'টা আগে এবং বেশি সময় নিয়ে করছেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা। কাজটা কঠিন, পূর্ব ধারণা ছিলই। তবে শুক্রবার ফতুল্লায় এক দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে বিসিবি একাদশের উড়ে যাওয়া হাওয়া দিচ্ছে সেই ভাবনার পালে।

এ ভাবনাকে আতঙ্ক মানতে নারাজ বাংলাদেশ দল। প্রস্তুতি ম্যাচে বিসিবি একাদশের কোচের দায়িত্ব পালন করা সারওয়ার ইমরান জাতীয় দলে স্টুয়ার্ট ল'র সহকারী। ফতুল্লা ম্যাচে ক্যারিবীয় পেস আক্রমণের মূল্যায়ন করতে গিয়ে উল্টো আশাবাদই ব্যক্ত করেছেন তিনি, 'ফতুল্লার উইকেটে সব সময়ই বাউন্স বেশি। শক্ত ঘাস আছে। যেখানে সিম হিট করাতে পারলে ভালো বাউন্স পাওয়া যায়। রবি রামপাল সেটাই করেছে। সেগুলো খেলতেই ব্যাটসম্যানদের একটু সমস্যা হয়েছে। মিরপুরের উইকেট এমন হবে না।' এ আত্মবিশ্বাসে জাতীয় দলসংশ্লিষ্ট একজনের সংযুক্তি, 'প্রস্তুতি ম্যাচ আর আসল ম্যাচের উদ্বোধনী জুটির মধ্যে পার্থক্যও আছে।' পার্থক্য আছে মিডল অর্ডারেও। দেশসেরা ব্যাটিং অর্ডার নিয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
কিন্তু মাশরাফি বিন মর্তুজার আশঙ্কা অন্যখানে। মিরপুর মাঠের কালো মাটির উইকেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা আছে। তবে দেশে জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়কের সবচেয়ে পছন্দের মাঠ মিরপুর, 'এ মাঠে নামলেই মনে হয় উইকেট পাব।' কারণ, 'একটা জায়গা পেয়ে গেলে আপনি উইকেট পাবেনই। কারণ হঠাৎ হঠাৎ বল ব্যাটসম্যানকে চমকে দেবে।' ব্যাটসম্যান চমকিত হন হঠাৎ বলের বাউন্স ওঠানামা করায়। দেখা গেল হঠাৎই গুডলেন্থ থেকে বল লাফিয়ে উঠছে। আবার শর্ট অব লেন্থ বল বাউন্সার ভেবে ব্যাটসম্যান পেছনের পায়ে গিয়ে দেখেন সেটি হাঁটুতে আঘাত করছে! মাশরাফির ভাবনা, 'বল ওঠানামা করলে পেস বোলিং খেলা কঠিন। ফাস্ট বোলিং তো অবশ্যই আরও বড় ব্যাপার।' আবার প্রতিপক্ষের কথা ভেবে আশাবাদীও মাশরাফি, 'ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলাররা প্রতি ওভারেই বাজে বল দেবে। সেগুলো কাজে লাগাতে পারলে আমি আশঙ্কার কোনো কারণ দেখছি না।'
আশা-নিরাশার এ দোলাচলে বারবার চোখ রাঙাচ্ছে অতীত। প্রতি ওভারেই না হয় কিছু বাজে বল দিলেন কেমার রোচ কিংবা ফিদেল এডওয়ার্ডস। কিন্তু সেগুলোর ফাঁকে এক-দুইটা ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতির ভালো বল সামাল দিতে পারবেন তো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা? বিশেষ করে যাঁদের বাজে বলেও উইকেট দিয়ে আসার বদভ্যাস আছে! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বের দ্রুততম বোলারদের খেলে আসার পর ঘরের মাঠে রোচ-এডওয়ার্ডসদের ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়ারও কোনো কারণ দেখছেন না মাশরাফি, 'দক্ষিণ আফ্রিকায় মুশফিক যদি স্টেইনকে খেলে আসতে পারে, তাহলে এখানে পারবে না কেন? আমি মোটেও দুশ্চিন্তা করছি না। শুধু যে ব্যাটসম্যান সেট হয়ে যাবে, সে আরো দায়িত্বশীল হলে ভালো রেজাল্ট হবে।'
নেতিবাচক আলোচনা করে হতোদ্যম হওয়ার পক্ষপাতী নয় বাংলাদেশ দল। তবু দুঃস্বপ্নের অতীত এতটাই ধারাবাহিক যে বারবার ঘুরে-ফিরে আসে নেতিবাচক দিকগুলো। মিরপুর স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের সুবিধার কথা ভেবে বরাবরই স্লো উইকেট তৈরি করা হয়েছে। তবু এ মাঠেই ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে উড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে পেসারদের জয়ধ্বনি শুনিয়েছিলেন বাংলাদেশেরই শাহাদাত হোসেন। কিন্তু স্টেইন-মরকেল-ক্যালিস মিলে ১৮ উইকেট নিয়ে জিতিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। যদিও পরবর্তী সময়ে আইসিসির রায়ে সে টেস্টের উইকেট 'অপ্রস্তুত' বিবেচিত হয়েছিল! 'প্রস্তুত' মিরপুরের উইকেটে সফরকারী দলের গতি সাফল্যের উদাহরণ আছে। এ মাঠে খেলা দুই টেস্টে ভারতের জহির খান নিয়েছেন ১৭ উইকেট! ২০১১ বিশ্বকাপে ৫৮'র ম্যাচেও পেস আক্রমণের সামনে হতবিহ্বল দেখিয়েছে বাংলাদেশকে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকার প্রাথমিক শর্ত_পেস বোলিং খেলতে জানতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা শিখছেন না কেন? উত্তরটা বহুচর্চিত। ঘরোয়া ক্রিকেটে যে উইকেটে খেলা হয়, তা একদিকে যেমন পাঁজরে আসা বল খেলার পরীক্ষায় ফেলে না ব্যাটসম্যানদের; তেমনি পাঁজরে বল তুলতে পারা বোলারেরও জন্ম দেয় না। ফতুল্লার ম্যাচ দেখার আগে থেকেই ইমরানের উপলব্ধি, 'আমাদের পেসাররা ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন উইকেট পায় না। তাই জানে না শক্ত ঘাসের উইকেটে সিম ফেলতে পারলে বাড়তি বাউন্স আদায় করা সম্ভব। অথচ রামপাল কী অনায়াসে শর্ট অব লেন্থ থেকে বল তুলে গেল!'
এ ঘাটতির কারণে নেটে আচমকা লাফিয়ে ওঠা বল খেলার সুযোগ পান না তামিম ইকবালরা। তবে বোলিং মেশিন আছে। যে মেশিনে ৮৫ মাইল গতির বাউন্সার অনুশীলন করেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা। তবে যন্ত্র তো যন্ত্রই। কোন বলটা বাউন্সার হয়ে আসছে, সেটি অফ স্টাম্পের ওপর নাকি সোজা পাঁজরে, বোলিং মেশিনে সেটি আগে নির্ধারণ করতে হয়। তাই অনুশীলনে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যান আগে থেকেই জানেন বলের গতিপথ। কিন্তু ম্যাচে কেমার রোচ কোনটা বাউন্সার দেবেন কিংবা খাটো লেন্থ থেকে লাফিয়ে ওঠা সেই বল সামনে নাকি সোজা গায়ে এসে পড়বে, তা অনুমানের জন্য সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় পান। সঙ্গে উটকো ঝামেলা হয়ে আছে উইকেটের অসমান বাউন্স।
সিরিজের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বড় হয়ে উঠছে রোচ-এডওয়ার্ডস-রামপালদের ছবি!

No comments

Powered by Blogger.