সতর্ক থাকুন সচেতন করুন by ইয়াসমিন পিউ

মুনিরা সুলতানার শ্বশুরবাড়ির পাশেই বাপের বাড়ি। তাই মুনিরার ছোট ভাইটির সঙ্গে তার বন্দুদেরও মুনিরার বাসায় অবাধ যাতায়াত। মুনিরার মেয়ে ১১ বছরের মীম। মামার বন্দু কামালের সঙ্গে সেই ছোট্টবেলা থেকেই তার ভীষণ ভাব। হঠাৎ মুনিরা খেয়াল করে, কামাল বাসায় এলে মীম আর আগের মতো তার কাছে ছুটে যায় না। কামাল বাসায় এলে মীম এক রকম লুকিয়ে থাকার চেষ্ঠা করে; কিংবা ঘুমের ভান করে চোখ বুজে শুয়ে থাকে। মীমকে কাছে নিয়ে আদর করে বুঝিয়ে তার অমন আচরণের কারণ জানতে চায় মুনিরা।

প্রথমে মীম বলে কিছু না; তবে মা যখন তাকে বুঝিয়ে বলতে সহযোগিতা করে তখন মীম তার খারাপ লাগাটা মায়ের কাছে বলে_ 'মা, মামা আমার বুকে চুমু দেয়। মামা বলে, 'মায়ের এসব তো ছেলের জন্যই, তাই না মা? এটা তোমার ছেলের আদর।' কিন্তু মা, মামার অমন আদর আমার ভালো লাগে না। মামা বাসায় এলে তাই ভয় হয়, আবার যদি আমাকে আদর করে। মুনিরা সুলতানা বলেন_ 'মেয়ে আমার তখনো বোঝে না ওটা অশোভন আচরণ। শুধু বুঝেছে, অমন আদর তার ভালো লাগে না। মুনিরা কষ্ঠ আর আশঙ্কা চেপে রেখে মেয়েকে বোঝায়, কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
ষঢাকার উত্তরার একটি ক্লিনিকের গাইনি বিভাগের ডা. আঞ্জুমান আরা আশা (ছদ্মনাম) একটি ঘটনার কথা জানান_ একদিন কামরুন্নাহার নামে এক ভদ্রমহিলা হাসপাতালে আসে ১৪-১৫ বছরের গৃহপরিচারিকাকে (নাজমা) অ্যাবরশন করাতে। গৃহপরিচারিকা নাজমা ৫ দিন হাসপাতালে থাকার পর একটু সুস্থ হলে নাজমা জানায়, গৃহকর্তা এবং তার শ্যালক দু'জনই গৃহকর্ত্রীর অগোচরে নাজমাকে যৌনকর্মে বাধ্য করত। নাজমা বাড়ির গৃহকর্ত্রীকে এসব জানাতেই তিনি রেগে আগুন হয়ে যায় নাজমার ওপর। বলে, আমার বাসায় থেকে-খেয়ে আবার আমার ভাইয়ের নামে আজেবাজে কথা বলিস! তোর সাহস তো কম নয়। এরপর নাজমা বাড়ি চলে যেতে চাইলেও সে কথা কানে তোলেন না গৃহকর্ত্রী। নাজমা ভয়ে আর মহিলার স্বামীর গোপন আচরণের কথা বলতে সাহস পায় না। এরপর নাজমা এক সময় গর্ভবতী হয়ে পড়ে। নাজমা ওসবের কিছুই তখনো বোঝে না। বাসার গৃহকর্ত্রীই প্রথম বুঝতে পারেন নাজমা অন্তঃসত্ত্বা। নাজমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন অ্যাবরশন করাতে। নাজমার সঙ্গে যে মহিলা হাসপাতালে এসেছেন সে তার গৃহকর্ত্রীর দূরসম্পর্কের আত্নীয়। টাকা দিয়ে বোরকা পরিয়ে নাজমার সঙ্গে পাঠিয়েছেন।
ডা. আঞ্জুমান আরা আশা বলেন, এমন অনেক ঘটনা হরহামেশা চোখে পড়ে। তবে ঊর্ধত্বন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সচেতন না হলে আমাদের চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
ষসপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী স্বপম্না গৃহশিক্ষকের কাছে একদম পড়তে চায় না। কারণ, গৃহশিক্ষক স্বপম্নাকে পড়াতে বসিয়ে তার বুকে-পিঠে-মুখে সঙ্র্শ করে, যা স্বপম্নার মোটেও ভালো লাগে না। যার কারণে গৃহশিক্ষকের কাছে সে অঙ্ক-ইংরেজি কিছুই ঠিকমতো শিখতে পারে না। বাসায় স্বপম্না তার মাকে বলে, 'মা ওই গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ব না।' কিন্তু মা-বাবা সে কথা শোনেন না। তারা বলেন, 'শিক্ষক ভালো ছাত্র, ওর কাছে ভালো শিখতে পারবে।' কিন্তু স্বপম্না তো গৃহশিক্ষকের অমন আচরণের কারণে কিছুই শিখতে পারছে না। স্বপম্না এদিকে গৃহশিক্ষককেও বাধা দিতে পারে না, ওদিকে বাবা-মাকেও ওসব কথা বলতে পারে না। এতে স্বপম্নার রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। এরপর স্বপম্নার মা একদিন গৃহশিক্ষকের অশোভন আচরণ দেখে ফেলেন। তারপর স্বপম্নার মা স্বপম্নার বাবাকে বলে গৃহশিক্ষককে বিদায় দেন।
ষসাবার বয়স তখন ১৪-১৫। পাশের বাসার এক অবিবাহিত আগ্ধেকল সাবাদের বাসায় আসে। প্রায়ই সাবার জন্য আগ্ধেকল কলম, প্যাড, চকোলেট, চুইংগাম নিয়ে আসে। যাওয়ার সময় সবাই সামনে থাকলে কপালে বা মাথায় চুমু দেয় আর একলা পেলে তার ঠোঁটে চুমু দেয়। সাবা কিছুই বলতে পারে না। একদিন সাবার মা মেয়ের ঠোঁটে চুমু দেওয়া দেখে ফেলে। পরে মেয়েকে বলে দেয়, 'তোমার আগ্ধেকল এলে বলে দেবে, 'আম্মু পছন্দ করে না তুমি আমাকে চুমু দাও।' তারপর যেদিন আগ্ধেকল আসে সেদিন সন্দ্যায় বাসায় কাজের বুয়া ছাড়া আর কেউ ছিল না। বুয়া রান্না করছিল। সাবা তখন তার আগ্ধেকলকে বলে, 'আম্মু বলেছে আমাকে আদর না করতে।' তখন আগ্ধেকল সাবাকে বলে, ঠিক আছে, আর আদর করব না। তবে আজকে শেষ আদর করতে দাও বলে সাবাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। এক পর্যায়ে সাবা চিৎকার দিয়ে ওঠে এবং ভয় পেয়ে কাঁদতে থাকে। তখন কাজের বুয়া দৌড়ে আসে। আগ্ধেকল বলে, একটু ব্যথা পেয়েছে, কিছু না। এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সেদিন বুয়ার জন্য সাবা রক্ষা পায়। সেই থেকে ২৪ বছর বয়সের সাবা এখনো তার চেয়ে বেশি বয়সের পুরুষদের যমদূতের মতো ভয় পায়।
এমন অনেক ঘটনা সমাজের সব স্তরেই ঘটছে। বাবা, চাচা, মামা এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্নীয়দের ্টারা নির্যাতিত হয় গ্রামের মেয়ে ৮ শতাংশ এবং শহরের ২ শতাংশ। পারিবারিক শুভাকাঙ্ক্ষী, গৃহশিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশী ও অন্যান্য ব্যক্তি ্টারা নির্যাতিত হয় গ্রামের ৪ শতাংশ আর শহরের ১০ শতাংশ মেয়ে। সমাজের পরিচিত সদস্যদের ্টারা নির্যাতিত হয় গ্রামের ২ শতাংশ আর শহরের ৩ শতাংশ মেয়ে। অপরিচিত ব্যক্তি ্টারা নির্যাতিত হয় গ্রামের ২ শতাংশ এবং শহরের ২ শতাংশ মেয়ে। মোট নির্যাতনের শিকার গ্রামের ১৬ শতাংশ এবং শহরের ১৭ শতাংশ মেয়ে। বাংলাদেশের অবাণিজি্যক শিশু নির্যাতনের ওপর ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের এক সমীক্ষায় দেখা যায় শিশু নির্যাতনের এই চিত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ফারাহ দিবা মনে করেন, আমাদের দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে যৌনশিক্ষার ওপর কোনো সিলেবাস নেই। এমনকি অভিভাবকরাও সন্তানদের এ সম্পর্কে কিছুই শেখান না। যার কারণে বাচ্চারা তাদের অজানেস্নই এসব সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বাবা-মা তার সন্তানটিকে বয়স অনুযায়ী যেমন শেখান, এটা তার হাত, এটা তার পা, ওটা তার মাথা; তেমনিভাবে বয়স অনুযায়ী গৃহেই যদি তার বাবা-মা সন্তানকে শেখান যে, এটা তার গোপন স্থান, ওটা তার সঙ্র্শকাতর অংশ এবং এর ভালো-মন্দ দিক। সেক্ষেত্রে শিশুরা একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লে প্রতিরোধ করার চেষ্ঠা করবে এবং মা-বাবার সঙ্গে এ ব্যাপারে সে অবলীলায় কথা বলতে পারবে। কারণ মেয়েরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে। আরেকটি কথা হচ্ছে, অনেক সময় দেখা যায় অভিভাবকরা শিশুদের কথা বিশ্বাস করছেন না। তখন শিশুরা হতাশ হয়।
ফারাহ দিবা আরো বলেন, যৌনতা বলতেই আমরা খারাপ কিছু ধরে নিই এবং এসব ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। কিন্তু যৌনতা অবশ্যই আমাদের জীবনের একটি অংশ। আমরা আমাদের সন্তানদের অবশ্যই সুস্থ যৌন সম্পর্ক যেমন জানাতে পারি, তেমনি অসুস্থ যৌন সম্পর্কের ব্যাপারেও বোঝাতে পারি। আমাদের দেশের দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের খাবারের তাগিদে হরহামেশা পথে নামতে হয়। সে ক্ষেত্রে তারা যেন নিজেদের রক্ষা করতে পারে। তা না হলে কন্যা শিশু নির্যাতনের হার বাড়তেই থাকবে। এর জন্য সরকারিভাবে যৌন শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এছাড়া প্রচার মাধ্যমগুলোও এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা নিতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে শিশুদের সুস্থ ও স্বাভাকিভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব সবার।

No comments

Powered by Blogger.