ঋণের বিপরীতে নগণ্য বন্ধকি by মজুমদার বাবু

নুদ্বীপ গ্রুপ অনুদ্বীপ অটোস, মটরস ও ইলেকট্রনিকের নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি থেকে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়। প্রতিষ্ঠানটি ঋণ নেওয়ার সময় মাত্র ৫৫ লাখ টাকার সম্পত্তি বন্ধকি দেয়। ডায়নামিক টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৯৯১ সালের ২৯ জুন সাবিনকো থেকে ২৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ঋণ নেয়; একপর্যায়ে তা সুদে-আসলে বেড়ে ৩৪ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় এবং খেলাপি হয়। ঋণ নেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি দেওয়া সম্পত্তির মূল্য ছিল মাত্র তিন কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

ইমাম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র আড়াই কোটি টাকা বন্ধকির বিনিময়ে ফারইস্ট লিজিং কম্পানি থেকে ১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়; একপর্যায়ে তা সুদে-আসলে ১০ কোটি ১০ লাখ টাকা হয় এবং খেলাপি হয়। ঋণ নেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য ছিল মাত্র আড়াই কোটি টাকা।
এভাবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই ঋণ নেওয়ার সময় বন্ধক দিয়েছে অতি নগণ্য মূল্যের সম্পত্তি। কেউ কেউ আবার তাও দেয়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া শীর্ষ দশ খেলাপির তালিকা থেকে দেখা যায়, তাদের মোট প্রায় ৭৬০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ২৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকাই শীর্ষ দশ খেলাপি প্রতিষ্ঠানে পড়ে আছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব খেলাপি প্রতিষ্ঠান ঋণ নেওয়ার সময় যে সম্পত্তি বন্ধক রেখেছিল, এর মূল্য ঋণের তুলনায় অতি নগণ্য। বেশির ভাগ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানই একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে এবং একাধিক জায়গায়ই খেলাপি হয়েছে। এমনকি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দৈন্যদশাও প্রতিফলিত হয়েছে কালের কণ্ঠের পর্যবেক্ষণে।
অনুদ্বীপ অটোসের বিষয়ে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও প্রাইম ফিন্যান্সের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অনুদ্বীপ নিজের ঋণ পরিশোধ ক্ষমতার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছিল। ফলে সে চেষ্টা করেও ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আর এ ক্ষেত্রে অনুদ্বীপকে ফিন্যান্স করার ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠে। এতে প্রতিষ্ঠানটির জন্য ঋণ সহজলভ্য হয় এবং সে তার পরিশোধ ক্ষমতার চেয়েও বেশি অর্থ ঋণ হিসেবে পেয়ে যায়। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিতে একপর্যায়ে অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়, যা প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি হওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এক প্রশ্নের জবাবে আসাদ খান বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে আমরা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বন্ধকির চেয়ে বেশি ঋণ দিই। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও অনেক ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এতে ঋণ সহজলভ্য হয়ে পড়ে এবং খেলাপের ঘটনা ঘটে; যেমনটি হয়েছে অনুদ্বীপের ক্ষেত্রে।'
প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান খান বলেন, 'অনুদ্বীপ মূলত বাংলাদেশে হলুদ ট্যাক্সিক্যবগুলোর প্রচলন করে। প্রতিষ্ঠানটির ট্যাক্সিক্যাবের লাইসেন্স ও নম্বর আমাদের কাছে জামানত হিসেবে রক্ষিত আছে। এখন আমরা সেগুলো বিক্রি করে ঋণের টাকা যতটুকু সম্ভব রিকভারির উদ্যোগ নেব।' অনুদ্বীপের মালিকপক্ষের ঋণ পরিশোধে আগ্রহ কম বলেও তিনি মনে করেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ দশ ঋণখেলাপির তালিকার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে টাকার অঙ্কে ঋণ খেলাপের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় ১০টি প্রতিষ্ঠানের নাম বের করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। হিসাব কষে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে অনুদ্বীপ গ্রুপ। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে হাবীব ভেজিটেবল, ডায়নামিক টেক্সটাইল, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এস. কো. স্টিল, ইয়াকুব সিনথেটিক, ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার, আলফা টোব্যাকো, ওরিয়েন্টাল অয়েল ও মিতা টেক্সটাইল।
রাজধানীর ১৬৫ কলাবাগান, মিরপুর রোডের প্রতিষ্ঠান অনুদ্বীপ মটরস এবং অটোস। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া শীর্ষ দশ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি প্রাইম ফিন্যান্সের ১৪ কোটি ১২ লাখ টাকা, জিএসপি ফিন্যান্সের আট কোটি ৩৫ লাখ টাকা, আইআইডিএফসির তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকা, আইপিডিসির ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং আইডিএলসির পাঁচ কোটি ৯০ লাখ টাকার ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে কামরুজ্জামান, মো. মোস্তফা ও শফিকুর রহমান খানের।
নোয়াখালীর আল-আমীন গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান হাবীব ভেজিটেবল। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা হিসেবে দেখানো হয়েছে মাইজদী কলেজ রোডের আল-আমীন হাউস। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৭ কোটি এক লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ইউনিয়ন ক্যাপিটালে ১৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, মাইডাসে ছয় কোটি ৭১ লাখ টাকা, জিএসপি ফিন্যান্সে সাত কোটি ১১ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার লিজিংয়ে পাঁচ কোটি টাকা, প্রাইম ফিন্যান্সে সাত কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ছয় কোটি ৬১ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে আনোয়ার মির্জা, শিবলী মির্জা, সাজেদা মির্জা ও আবদুর রহমান হাসান মির্জার।
রাজধানীর গুলশান নর্থ এভিনিউর ৯১ নম্বর সড়কের ৪০/১ নম্বরের ঠিকানার একটি প্রতিষ্ঠান ডায়নামিক টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবিনকোর ৩৪ কোটি ৩১ লাখ টাকার ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে সুলতান রশিদ, কামরুদ্দীন ওয়ালিয়ানি, মোর্শেদ আলম চৌধুরী, মোস্তাক আলম চৌধুরী, শামীম আরা চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালাম পিএসসি, সোহায়েল রশীদ ও মঞ্জুর আলমের।
শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান চতুর্থ। এর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স থেকে ২৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে দুই কোটি সাত লাখ টাকার ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে ড. এম এ হান্নান ফিরোজ, ফাতিনাজ ফিরোজ, মাহবুব আলম জাকির, মশিউর রহমান রিপন, হেলালুজ্জামান চৌধুরী, আখতার হোসাইন লিটন ও ইলিয়াস মিরনের।
কারওয়ান বাজারের ৯৯ ঢাকা ট্রেড সেন্টারের ১৪ তলার ঠিকানাধারী প্রতিষ্ঠান এস. কো. স্টিলের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্সের তিন কোটি ৮১ লাখ টাকা, প্রাইম ফিন্যান্সের তিন কোটি ৯৮ লাখ, ন্যাশনাল হাউজিংয়ের তিন কোটি ৭০ লাখ, লঙ্কাবাংলার চার কোটি দুই লাখ, আইডিএলসির তিন কোটি ১৩ লাখ, ফারইস্ট ফিন্যান্সের এক কোটি ৭৯ লাখ এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটালের দুই কোটি ৬৯ লাখ টাকার ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে মনোয়ারা হক, মোস্তাফিজুল হক, শাহজাদুল আলম, সিরাজুল হক ও সুরাইয়া আলমের।
চট্টগ্রামের ২৬০ খাতুনগঞ্জের প্রতিষ্ঠান ইয়াকুব সিনথেটিক লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৯ কোটি ১১ লাখ টাকা, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সের পাঁচ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের সাত কোটি ৬০ লাখ টাকার ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে ইয়াকুব আলী ও মোহাম্মদ আলীর।
গুলশান-১ এলাকার ১২৪ নম্বর রোডের ৭এ বাড়ির ঠিকানাযুক্ত ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি আইডিএলসি ফিন্যান্সের সাত কোটি পাঁচ লাখ টাকা, লঙ্কাবাংলার তিন কোটি ৪৫ লাখ, আইআইডিএফসির চার কোটি ৫৯ লাখ ও ফারইস্ট ফিন্যান্সের পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে তাজুল ইসলাম ফারুক, সোকারো বোলাতাও লিকার্তে, বিজয় আনন্দ ও কং চেক আহ।
পুরানা পল্টন জাতীয় স্কাউট ভবনের ১৩ তলার ঠিকানাধারী প্রতিষ্ঠান আলফা লিফ টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। উত্তরা ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের দুই কোটি ৬৬ লাখ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ও ইউনাইটেড লিজিংয়ের ৫৪ লাখ টাকার ঋণ খেলাপ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে এ আহমেদ ইউসুফ, এ আর মলি্লক ও মঞ্জুর আহমেদ।
মহাখালীর ডিওএইচএসের ২৩ নম্বন লেন, ৮১৭১ বাড়ির ঠিকানার প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল অয়েল লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি প্রিমিয়ার লিজিংয়ের দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা, ফারইস্ট ফিন্যান্সের তিন কোটি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ১৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের তিন কোটি ৫৩ লাখ টাকার ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে রয়েছে জেইদ হোসাইন, পারভীন সালাম, ওয়াহিদা হোসাইন ও মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালামের নাম।
৯২ কাকরাইলের ঠিকানাধারী প্রতিষ্ঠান মিতা টেক্সটাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ১৯ কোটি টাকার ঋণখেলাপি। এর পরিচালক হিসেবে খেলাপি তালিকায় নাম রয়েছে মোস্তাফিজুর রহমান, কমর সুলতানা, আ স ম শহীদুর রহমান ও মেহজাবিন মুস্তাফিজের।

No comments

Powered by Blogger.