তিন সেকেন্ডেই ম্যাচ শেষ! by রাহেনুর ইসলাম

বাঁশিতে ফুঁ দিলেন রেফারি মিরোস্লাভ রাদোমান। শুরু হয়ে গেল ম্যাচ। স্কটল্যান্ডের বিলি ডোডস কিক-অফের পর বল দিলেন জন কলিনসকে। তিন সেকেন্ড পর আবার বাঁশিতে রেফারির ফুঁ। ভাবছেন ফাউল করেছে কেউ? অথবা বল গেছে লাইন পেরিয়ে? মোটেও না। এ বাঁশি ম্যাচ শেষের! তাই ৯০ মিনিটের ম্যাচ তিন সেকেন্ডেই শেষ! প্রহসন কিংবা লোক হাসানো ছাড়া আর কী বলা যায় একে! হাসার মতো তেমন লোকও অবশ্য ছিল না এস্তোনিয়ার কাদরিরোগো স্টেডিয়ামে।ঘটনাটা ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগের। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এস্তোনিয়ার মুখোমুখি হওয়ার কথা স্কটল্যান্ডের।
৮ অক্টোবর রাতে ম্যাচের ভেন্যু কাদরিরোগোয় অনুশীলনও করেছিল স্কটিশরা। বিপত্তিটা বাধে তখনই। ফিনল্যান্ড থেকে আনা অস্থায়ী ফ্লাডলাইটে রাতের আঁধারই কাটছিল না ভালোভাবে। ম্যাচ হবে কিভাবে? তাই ফিফার কাছে দিনের আলোয় ম্যাচ আয়োজনের অনুরোধ করে স্কটিশরা। তাতে সায় দেয় ফিফা। সেই রাতেই জরুরি সভা ডেকে সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটের বদলে ম্যাচের সময় এগিয়ে আনা হয় বিকেল ৩টায়। এবার বেঁকে বসে স্বাগতিক এস্তোনিয়া। এত অল্প সময়ের নোটিশে খেলা সম্ভব ছিল না তাদের, কেননা দলের খেলোয়াড়রা অনুশীলন করছিলেন স্টেডিয়াম থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। তা ছাড়া দলে পার্টটাইম ফুটবলারও ছিলেন কয়েকজন, যাঁরা কেবল অফিস শেষে সন্ধ্যায়ই খেলতে পারতেন। আর টেলিভিশনের সম্প্রচার স্বত্ব্বের জটিলতা তো ছিলই। এস্তোনিয়া তাই ম্যাচ আগের সময়ে অথবা অন্য কোনো ছুটির দিনে আয়োজনের অনুরোধ জানায়।
ফিফা সেটা কানে না তোলায় ৯ অক্টোবর বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত হয়ে যায় ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ম্যাচটা। ফিফা বিশ্বকাপ আইনের ৬ নম্বর অধ্যায় অনুযায়ী কোনো দল খেলতে অস্বীকৃতি জানালে বিপক্ষ পাবে ৩-০ ব্যবধানের জয়। এটাও অবশ্য মানা হয়নি এস্তোনিয়া-স্কটল্যান্ডের বেলায়। এর বদলে ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর নিরপেক্ষ ভেন্যু মোনাকোয় ফিরতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সেই ম্যাচ শেষ হয় গোলশূন্য ড্রতে। ওই ম্যাচ থেকে পাওয়া এক পয়েন্টেই নিশ্চিত হয়ে যায় স্কটল্যান্ডের বিশ্বকাপ খেলা। ৪ নম্বর গ্রুপ থেকে ২৩ পয়েন্ট পেয়ে রানার্সআপ হয়েও তাদের খেলতে হয়নি প্লে-অফে। ৯ গ্রুপের সেরা রানার্সআপ হিসেবে সরাসরিই বিশ্বকাপ খেলার টিকিট পায় স্কটিশরা।
ফুটবলের নিয়ম অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ ম্যাচ হবে কমপক্ষে ৯০ মিনিটের। এর কমে খেলা শেষ হলে পরিত্যক্ত হয়ে যাবে সেটা। আর কোনো টুর্নামেন্টে ওরকম হলে রিপ্লে হবে ম্যাচটার। ফুটবল ইতিহাসে এ ধরনের পরিত্যক্ত ম্যাচও কম হয়নি। তুষারপাত, ভারী বর্ষণ, কুয়াশা কিংবা দর্শক হাঙ্গামায় পরিত্যক্ত হয়েছে অসংখ্য ম্যাচ। আন্তর্জাতিক ফুটবলে হয়েছে, ক্লাব ফুটবলেও দেখা গেছে এমন ম্যাচ। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ইতিহাসে যেমন তিন-তিনটি পরিত্যক্ত ম্যাচের ঘটনা আছে। ১৯৫৩ সালের ১৭ মে বুয়েনস এইরেসে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ইংল্যান্ডের প্রীতি ম্যাচটি ২৩ মিনিট পর পরিত্যক্ত হয় ভারী বর্ষণে মাঠে হাঁটুপানি জমে যাওয়ায়। ১৯৯৫ সালে ডাবলিনে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের প্রীতি ম্যাচটা ২৭ মিনিট পর পরিত্যক্ত হয় দর্শক হাঙ্গামায়। আর আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের একমাত্র পরিত্যক্ত ম্যাচ ১৯৭৫ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্বে। ২৯ অক্টোবর চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা ১৭ মিনিটে ০-০ স্কোরের সময় পরিত্যক্ত হয় কুয়াশায় মাঠ ছেয়ে যাওয়ায়। খেলোয়াড়রা ভালোভাবে কিছু দেখতেই পাচ্ছিলেন না। এরপর ফিরতি ম্যাচে ইংল্যান্ড হেরে বসে ১-২ গোলে।
ইংল্যান্ডের মতো ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি কিংবা ফ্রান্সেরও অভিজ্ঞতা আছে এ ধরনের ফিরতি ম্যাচ খেলার। ক্লাব ফুটবলে তো তা হরহামেশাই ঘটে। তবে পরিত্যক্ত হলেও (টুর্নামেন্টে) রিপ্লে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি এ ধরনের ঘটনা একেবারে হাতেগোনা।
১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপ (চ্যাম্পিয়নস লিগ) জয়ের ছয় বছর পর দ্বিতীয় বিভাগে নেমে গিয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। মৌসুমের শেষ ম্যাচে ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে জিতলেই অবশ্য রেলিগেশন এড়াতে পারত রেড ডেভিলরা। সেই ম্যাচের ৮০ মিনিট পর্যন্ত গোল পায়নি কোনো দল। কিন্তু ৮১ মিনিটে ম্যানইউ থেকে সিটিতে আসা ডেনিস ল'র ব্যাকহিলে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায় সিটিজেনরা। সাবেক ক্লাবের বিপক্ষে গোল বলে উল্লাস করেননি ল। গোলের পর আর খেলেননি তিনি। এমনকি এরপর আর ক্লাব ফুটবলেও খেলেননি! ম্যানইউ পিছিয়ে পড়ায় হতবাক দর্শকরা ৮৬ মিনিটে নেমে আসেন মাঠে। বিশৃঙ্খলার কারণে আর শুরু করা যায়নি ম্যাচটি। পরিত্যক্ত হলে আবার খেলা হবে ভেবেই হয়তো ম্যাচটা পণ্ড করে দিয়েছিল ম্যানইউ সমর্থকরা। কিন্তু ইংলিশ লিগ কর্তৃপক্ষ ১-০ ফলটা ঠিক রেখে রিপ্লে ম্যাচের আয়োজন করেনি।
পরিত্যক্ত ম্যাচেও এক দলকে জয়ী ঘোষণা করার ঘটনা প্রথম ঘটেছিল ১৯১৫ সালে। ইংলিশ লিগ চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার ওল্ডহ্যাম অ্যাথলেটিক ৩ এপ্রিল মুখোমুখি হয় মিডলসব্রোর। ৫৫ মিনিটে বিলি কুকের ফাউলের কারণে পাওয়া পেনাল্টিতে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন ওয়াল্টার টিনসলে। মিডলসব্রোও এগিয়ে যায় ৪-১ গোলে। কিছুক্ষণ পর আবার কুকের ফাউলে মিডলসব্রোকে পেনাল্টি দেন রেফারি আর লাল কার্ড পান কুক। কিন্তু বাজে রেফারিংয়ের প্রতিবাদে মাঠ ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এ কারণে একপর্যায়ে রেফারি এইচ স্মিথ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন ম্যাচ। তবে ৪-১ গোলেই জয়ী ঘোষণা করা হয় মিডলসব্রোকে। আর এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন কুক। সেবার মাত্র এক পয়েন্টের জন্য শিরোপা জেতা হয়নি ওল্ডহ্যামের!
১৯৭৬ সালে ইংলিশ চতুর্থ বিভাগে বেরো ও গিলিংহামের ম্যাচটা শুরু হওয়ার কথা ছিল ৫টা ১৫ মিনিটে। কিন্তু লন্ডনে সকাল ৯টা ৫ মিনিটের ট্রেন মিস করে বসে গিলিংহাম খেলোয়াড়রা। বিমানেও টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না সব খেলোয়াড়ের। তাই কয়েক ঘণ্টা পর নিজেদেরই চার্টার্ড বিমানে রওনা দেয় তারা। ব্ল্যাকপুল পর্যন্ত আসার পর সেখান থেকে বাকি ৭০ কিলোমিটার আসতে হয় গাড়িতে চড়ে। সব মিলিয়ে দেরি হয়ে যাওয়ায় পেছাতে হয় ম্যাচ শুরুর সময়। কিন্তু স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট না থাকায় ৭৬ মিনিট পরই খেলা বন্ধ! ওই সময় বেরো এগিয়ে ছিল ৭-০ গোলে। স্বাভাবিক কারণেই ফিরতি ম্যাচ আয়োজন না করে ৭-০ গোলে জয়ী ঘোষণা করা হয় বেরোকে।
২০০২ সালের ১৬ মার্চ 'খেলোয়াড় সংকট'-এর কারণে পরিত্যক্ত হয় ইংলিশ প্রথম বিভাগের শেফিল্ড ইউনাইটেড ও ওয়েস্টব্রমউইচের ম্যাচটা। তিন-তিনজন লাল কার্ড দেখায় ৬৫ মিনিটে আটজনের দলে পরিণত হয় শেফিল্ড। এর মধ্যে আবার নির্ধারিত তিনজন বদলি খেলোয়াড়ের সবাইকে মাঠে নামিয়ে ফেলেছিলেন শেফিল্ড ম্যানেজার নিল ওয়ারনক। তাই ৮০ মিনিটে ইনজুরিতে পড়ে মাইকেল ব্রাউন মাঠ ছাড়ায় আর কাউকে নামাতে পারেননি তিনি। দুই মিনিট পর চোট পেয়ে রবার্টও মাঠ ছাড়লে শেফিল্ড হয়ে যায় ছয়জনের দল। কিন্তু ফুটবলের নিয়ম অনুয়ায়ী দুই দলে অন্তত সাতজন করে খেলোয়াড় না থাকলে খেলা হবে না। তাই রেফারি বাধ্য হয়ে ৮২ মিনিটে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন ম্যাচটা। ওই অবস্থায় ৩-০ গোলে এগিয়ে ছিল ওয়েস্টব্রমউইচ। কিন্তু এরপরও রিপ্লে হয়নি ম্যাচটির। ৩-০ গোলেই জয় পায় ওয়েস্টব্রম। পরে জানা যায়, ম্যাচ পণ্ড করতেই ইনজুরির নাটক সাজিয়েছিল শেফিল্ড! এ কারণে ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানাও গুনতে হয় তাদের!

* ১৫ বছর আগের এই দিনে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে স্কটল্যান্ড-এস্তোনিয়া ম্যাচ। ফ্লাড লাইটে সমস্যা থাকায় সন্ধ্যার ম্যাচ দুপুরে আয়োজনের চেষ্টা। কিন্তু এস্তোনিয়ার আপত্তি এবং তিন সেকেন্ডেই ম্যাচ শেষ!
* গিলিংহাম ট্রেন মিস করে মাঠে আসে দেরিতে। ম্যাচের সময় পিছিয়ে দেওয়ায় ৭৬ মিনিট পরই মাঠে প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। খেলা আর হয় কী করে!
* ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে হার এড়াতে ৮৬ মিনিটে মাঠে নেমে পড়েছিল ম্যান ইউ সমর্থকরা। লাভ হয়নি। ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে ম্যানসিটিকেই জয়ী ঘোষণা করেন রেফারি।
* ওয়েস্টব্রমউইচের বিপক্ষে শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে মাঠে তখন মাত্র ছয়জন খেলোয়াড়। শেষে ম্যাচ তো হারতে হয়ই, খেলোয়াড়রা ইনজুরির অভিনয় করেছেন_এই অভিযোগে ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানাও গুনতে হয় শেফিল্ডকে।

No comments

Powered by Blogger.