আওয়ামী লীগের গৌরব এখন স্মৃতি by মহসীন হাবিব

অনেকেই বলেন, পোশাক নাকি মানুষের আচরণ পাল্টে দেয়। যেমন অতি সাধারণ পোশাকে যে আচরণ করা সম্ভব, কেতাদুরস্ত পোশাকে তা সম্ভব হয় না। পদমর্যাদাও নাকি মানুষকে অনেক দায়িত্বশীল করে তোলে।
অতি হালকা ধরনের মানুষ যদি ভারী দায়িত্ব পান, তাহলে সারাক্ষণ তাঁকে ভাবনায় থাকতে হয় কোনটা করা উচিত আর কোনটা উচিত নয়। গভীরভাবে লক্ষ করে দেখেছি, মানুষের এ ধারণার সত্যতা আছে। আমাদের পাড়ার মোখলেসুর রহমান যখন লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান, তখন সবার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসেন। সবাইকে ডেকে ডেকে অতি তুচ্ছ কথা বলেন। এই তিনিই যখন প্যান্ট-কোর্ট সজ্জিত হয়ে রাস্তায় বের হন, তখন গম্ভীর হয়ে যান। কথা কম বলেন। চেহারার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। আবার আমাদের আমির আলীকে সারা জীবন দেখেছি অত্যন্ত হালকা মাথার মানুষ। চিৎকার করে কথা বলেন। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করেন। কিন্তু যেদিন থেকে তিনি সরকারের নির্বাহী বিভাগে একটি নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত হলেন, ঠিক সেদিন থেকেই তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল। কথা বলা কমিয়ে দিলেন। যার তার সঙ্গে যত্রতত্র ভ্রমণ ছেড়ে দিলেন। এমন ঘটনা কম নেই। শুধু একটি ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম বা উল্টো দেখতে পাই। আর সেটা হলো ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগের সহযোগী তথা অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের আচরণের বেলায়। সরকারে নেতৃত্বদানকারী দলের কর্মী হওয়ায় প্রশাসন তাঁদের সমীহ করে চলে, সমাজের মানুষ তাঁদের ভয় পায়। এ কারণে তাঁরা দায়িত্বশীল না হয়ে সমীহ আদায় করে চলেন এবং ভয় থেকে ফায়দা লোটার এবং যাবতীয় অন্যায় কাজের সুযোগ গ্রহণ করেন। বলছি বর্তমান আওয়ামী লীগের পরিস্থিতির কথা।
আগেই একটি কথা বলে রাখা ভালো, এ লেখায় আমি ছাত্রলীগ-যুবলীগের তথা আওয়ামী লীগের কথাই বলব। ছাত্রদল, যুবদল অথবা ছাত্রশিবিরের কথা আলোচনাও করব না, তাদের সঙ্গে তুলনাও করব না। যুবদল-ছাত্রদলের কোনো ইতিহাস নেই, পরম্পরা নেই, আদর্শ নেই। ছাত্রদল, যুবদল এবং তাদের মাদার অর্গানাইজেশন ভুঁইফোড়; গঠিত হয়েছে অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং নানা প্রলোভনের মধ্য দিয়ে তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সাধারণ তরুণ সমাজের মধ্যে। সুতরাং সাময়িক প্রয়োজনে বাংলাদেশের মানুষ যতবারই তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসুক, যত বেশি জনপ্রিয়তাই তাদের দেখা যাক_একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের গণতান্ত্রিক মনে করার কোনো কারণ নেই। চণ্ডাল মন্ত্রপাঠ করলেই ব্রাহ্মণ হয় না।
কিন্তু যাদের ব্রাহ্মণ বিবেচনা করছি, তাদের কী হাল আজ দেখতে পাই আমরা? কথা ছিল ছাত্র, তরুণ, যুবসমাজ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করবে। শাসকগোষ্ঠী যখন জনমত তোয়াক্কা না করে সীমাহীন কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠবে, দেশের মানুষের জন্য নাগরিক অধিকার রহিত হয়ে যাবে, তখন ছাত্র-যুবসমাজ যৌবনোচিত বজ্রমুষ্ঠি নিয়ে জেগে উঠবে। শোষকের ক্ষমতা টেনে ধুলায় লুটিয়ে তারপর কেউ ফিরে যাবে পাঠ্য বই হাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; কেউ ফিরে যাবে কর্মোদ্যম নিয়ে কর্মস্থলে। তাদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সম্মুখে থাকবে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা, যাঁদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এসব ছাত্র-যুবক ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াবে। একজন সাহসী ছাত্র ছোটখাটো সাইজের শিক্ষককে দেখলে বিড়ালের মতো সঙ্কুচিত হয়ে যাবে; কিন্তু প্রয়োজনে বিশাল বপু স্বৈরাচারীকে গদি থেকে টেনে নামাবে। ছাত্র সংগঠনের পেছনে এই ম্যুরাল কাজ করেছিল উপমহাদেশের আধুনিককালের রাজনীতির শুরুতে। অন্তত তেমনটাই দেখা গেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণজাগরণ, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। আজ সেই ছাত্রসমাজের এমন করুণ পরিণতি, এমন বীভৎস রূপ দেখা দিয়েছে যে এসব সংগঠন সরাসরি বিলুপ্ত করার উপদেশ দেওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। ছাত্রসমাজ ও যুবসমাজে যাঁরা দায়িত্বশীল, যাঁদের দেখলে প্রশাসনের লোকরা কদর করেন, তাঁদের কী নূ্যনতম দায়িত্ববোধ থাকবে না? সম্প্রতি জামালপুরে সরিষাবাড়ি কলেজের সাবেক জিএস, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সালামকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে। তিনি ৪২ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন (অবশ্য মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাৎক্ষণিক তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে)। এই হলো মান ও মানসিকতা। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বেশ কিছুকাল ধরে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পত্রপত্রিকায় উঠে আসছে, সেসব ঘটনার মান এ রকমই। কেউ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত, কেউ জমি দখল, কেউ চাঁদাবাজি, কেউ পুরাকীর্তি ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। গভীরভাবে ভাবতে চেষ্টা করেছি, ছাত্র-যুবকদের এ ধরনের অধঃপতনের কারণ কী? একটি উত্তরই সঠিক বলে মনে হয়েছে। সেটি হলো, বর্তমানে ছাত্র-যুবকদের সম্মুখে থাকা মাঝারি স্তরের জ্ঞান ও শিক্ষাবিমুখ আদর্শহীন নেতৃত্ব। এসব নেতা-কর্মী এমন সব কাণ্ডজ্ঞানহীন, কুরুচিপূর্ণ কাজে মনোযোগী হয়ে পড়ছেন যে তাঁদের হাতে সামনের দিনের রাজনীতি শুধুই অন্ধকার বলে প্রতীয়মান হয়। কয়েক দিন আগে বগুড়ায় মহাস্থানগড়ের এক হাজার ৬০০ বছরের পুরনো নেতাই ধোপানির পাটের মাটি কেটে স্থানীয় থানা ও ইউনিয়ন পরিষদের নেতারা রাস্তা বানিয়েছেন। এ সময় খননকার্যের ফলে উঠে আসা মূল্যবান প্রত্নসম্পদ গ্রামবাসী তুচ্ছতাভরে হাতে হাতে নিয়ে যায়। কেউ যেন দেখার নেই। এ ঘটনার পেছনে ছিল আওয়ামী লীগের থানা ও ইউনিয়ন পরিষদের নেতারা। শেষ পর্যন্ত আদালতকে স্বপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্টদের তলব করতে হয়েছে। নওগাঁয় সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের স্থাপনাটি ভেঙে ফেলা হয়েছে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই। এর পেছনেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা রয়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকার লালবাগ দুর্গে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অনুমতি ছাড়া ফ্যাশন শোর আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা। এসব কর্ম স্থানীয় নেতাদের উদ্ধত আচরণ এবং শিক্ষা ও জ্ঞানবিমুখতারই পরিচায়ক। তাই যেমন নেতা, তেমন ছাত্র-যুবসমাজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত ক্ষণজন্মা-পুরুষ দেখেছি। তাঁর পেছনে হাঁটার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি ছিলেন ফরিদপুরের জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ইমামউদ্দিন আহমেদ। আর তাই বঙ্গবন্ধু তাঁকে চিনতে ভুল করেননি। স্কুলমাস্টার ইমামউদ্দিনকে ডেকে নিয়ে এমসিএ বানিয়েছেন। ইমামউদ্দিন যখন রাজনীতির মাঠে ছিলেন, তখন নানা ঘটনা ঘটাতেন, যা আমাদের রাজনীতিতে অতীতেও অস্বাভাবিক ছিল, আজও অস্বাভাবিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর তাঁর হাতে ক্ষমতা থাকতে তিনি পাগলের মতো স্কুল বানিয়েছেন। মানুষ বুঝত না। হেসে দিয়ে বলত, ইমাম সাব খালি স্কুল বানায়। তাঁর দলের সমাবেশ। চারদিক থেকে লোকজন জড়ো করার চেষ্টা চলছে। তিনি দুই-তিনটি অল্পবয়সের ছেলেকে কাছে ডাকলেন। দরাজ গলার মানুষটি আস্তে করে জানতে চাইলেন কী করো? ছেলেরা উত্তর দিল, আমরা স্কুলে পড়ি। ইমামউদ্দিন তাদের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, সোজা বাসায় যাও। মেট্রিক পাস করো, তারপর রাজনীতি করবে।
শুনেছি, মসজিদের ইমাম সাহেব আর মন্দিরের পুরোহিত মশায় সৎ মানুষ। দেখিনি। দেখেছি ইমামউদ্দিন আহমেদকে। অভাব-অনটন থাকা কোনো মানুষ যে অর্থের প্রতি এত নিরাসক্ত থেকে দেশের মানুষের চিন্তায় নিজেকে সোপর্দ করতে পারেন, আমার কাছে এর প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষ উদাহরণ ইমামউদ্দিন আহমেদ। এ কারণে শুধু যে চারদিকের নষ্ট-রাজনীতি তাঁকে ত্যাগ করেছিল তাই নয়, তাঁর নিজ সন্তানরাও তাঁকে শেষ জীবন পর্যন্ত চরম অবহেলা করেছে।
বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি-যুবরাজনীতি কিভাবে নষ্ট হলো এর একটি ব্যারোমিটার ধরা যেতে পারে ইমামউদ্দিনকে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রসমাজের কাছে ইমামউদ্দিনের কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি ছিলেন আদর্শ। কিন্তু ৭৫-পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের কাছে রাজনীতি দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে অর্থ আসতে শুরু করল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় পরিস্থিতির একেবারে নগ্ন অবস্থা সৃষ্টি হলো। তখন হাতেগোনা দু-চারটি ছেলে ছাড়া বেচারা ছাত্রসমাজকে বিক্রি হতে হলো অর্থ, অস্ত্র ও ক্ষমতার কাছে। চোখের সামনে দেখলাম, আদর্শ যেন পোড়াঘরের ছাইয়ের মতো উড়ে গেল। আজ পাপ স্বীকার করে বলতে হয়, অল্প সময়ের জন্য হলেও আমরা অনেকেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলাম। এরশাদের শাসনের সময় কৈশরোত্তীর্ণ। হঠাৎ করে এক নেতার আবির্ভাব হলো, যাঁকে পেছন থেকে মানুষ ডাকত তৈমুর লং। সন্ধ্যার সময় তাঁর বাসায় ছাত্র-যুবকদের ভিড় লেগে যেত। মদ্যপানের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বের হয়ে এসে টাকা বিলি করতেন। অধিকাংশ সময় রাত ১০টার পর গেলে দেখা যেত, তাঁর খাস কামরায় নতুন নতুন নারী। এ নিয়ে এই 'নেতা'র কোনো লাজলজ্জা ছিল না। অল্পবয়সী কর্মীরা কেউ সেই মেয়েটিকে দামি গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে আসত, কেউ আবার ভোরবেলা মেয়েটিকে পেঁৗছে দিত! এই হলো রাজনীতিতে ফরিদপুর জেলায় ইমামউদ্দিনের রিপ্লেসমেন্ট! খোঁজ নিয়ে দেখেছি, দেশের সর্বত্র কম-বেশি এমন রিপ্লেসমেন্টই হয়েছে। আর এ ধারার মধ্যেই নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়েছে আওয়ামী লীগও।
বলতে দ্বিধা নেই, ইমামউদ্দিনের মতো নেতা খুব বেশি জাতির কপালে জোটেনি। এমন নেতা প্রতি পাঁচ জেলায় একজন থাকলে আদর্শের রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে দৌড়ে পালাত না। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, আপনার পিতার মতো গুণীজনদের, আদর্শ মানুষদের জেলায় জেলায় শক্তিশালী করে তুলুন। তাহলেই আওয়ামী লীগ তার গৌরব ফিরে পাবে। নচেৎ গা ভাসিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকেও ভুঁইফোড় দলগুলোর সঙ্গে ঝগড়া করে কাটাতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.