১০০ বিজ্ঞানীর সতর্কবার্তা এবং খাদ্যাভাবের শঙ্কা by শহিদুল ইসলাম

সম্প্রতি কালের কণ্ঠে পৃথিবীর ১০০ বিজ্ঞানীর একটি সতর্কবার্তা প্রকাশিত হয়েছে। বহুমাত্রিক সে সতর্কবার্তাটি চুলচেরা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আজকের দিনেও যখন আমরা বর্তমান সভ্যতার জয়গানে মাতাল, বিশ্বকে ২০২৫ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্বে পরিণত করব বলে বড় বড় বই লিখে নোবেল পুরস্কার
পাচ্ছি, ২০২৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাব বলে বিশ্বের বড় বড় খেতাব অর্জন করছি, তখন বিশ্বের ১০০ বিজ্ঞানীর ওই সতর্কবার্তাটি আমাদের মুখে যে কত বড় চপেটাঘাত, আমরা কি তা উপলব্ধি করতে পারছি? তাঁদের সে সতর্কবার্তার পরও যাঁরা সেসব অলীক ইউটোপিয়ান দাবি করবেন, বুঝতে হবে তাঁদের লজ্জা-শরমের বালাই নেই। সতর্কবার্তায় তাঁরা বলেছেন, 'বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ আজও অনাহারে বাস করছে এবং আরো ১০০ কোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার।' বিশ্বের মোট মানুষের সংখ্যা যদি ৬০০ কোটি হয়, তাহলে এ সংখ্যা এর এক-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে অনাহারে ও অপুষ্টিতে বসবাস করতে বাধ্য করে এখনো আমরা মুখে 'উন্নয়নের' কথা বলতে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হই না। বর্তমান করপোরেট সভ্যতা আমাদের এতটাই বেহায়ায় পরিণত করেছে। বিজ্ঞানীরা আরো বলেছেন, 'বর্তমানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হার অব্যাহত থাকলে বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পৃথিবীর লোকসংখ্যা দাঁড়াবে ৯০০ কোটি।' তখন কী ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে সে কথা চিন্তা করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর শাসকশ্রেণীর কাছে এ বার্তাটি পাঠিয়েছেন_শাসকশ্রেণীকে সতর্ক করেছেন। তাঁরা আরো বলেছেন, '২০০৬ সাল থেকে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে। ২০০৭ সালে গমের দাম বাড়ে ৯২ শতাংশ এবং ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ববাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে। তাই সৌদি আরব, চীন, অর্থাৎ যাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, যারা ধনী, তারা ইতিমধ্যে বিশ্বের কৃষিজমি কিনতে শুরু করেছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান (করপোরেট) কৃষিজমিতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে।' যে কথা তাঁরা বলেননি, তা হলো ধনীকশ্রেণী শুধু পৃথিবীর কৃষিজমি কিনতে শুরু করেছে তা-ই নয়, মঙ্গলগ্রহ, চাঁদসহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জমিও বিক্রি করতে শুরু করেছে, যেন ওগুলোর মালিকানা তারা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। ১০০ জন বিজ্ঞানী সতর্কবার্তাটির খবর পেয়ে আমার আর একটি ঘটনার কথা এখন মনে পড়ল। নাজি-জার্মানির ইহুদি নিধন পর্বে ১০০ জন লেখক আইনস্টাইন ও তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে একটি বই লিখেছিলেন। সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে আইনস্টাইন জবাব দিয়েছিলেন, '১০০ জন কেন? আমরা যদি ভুল করে থাকি, তাহলে একজনই যথেষ্ট।' ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া এ সতর্কবার্তাটি যদি মিথ্যায় পর্যবসিত হয়, তাহলে আমার মনে হয় পৃথিবীর সবাই খুশি হবে। সত্যি কি তাই? সবাই খুশি হবে? ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা আগে থেকে বলা যায় না। কিন্তু অতীতে কী ঘটেছে, তা তো আমরা জানি। অতীতের সেই ইতিহাস পাঠে বলে দেওয়া যায় ভবিষ্যতে কী ঘটবে? ১০০ বিজ্ঞানী সেই সতর্কবার্তাই জানিয়েছেন, যেন অতীতের সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
দুই. কিন্তু অতীতে যা ঘটেছে তা পাঠে কোনোভাবেই বিশ্বাস হয় না যে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর হবে। সম্পদ বাড়বে, এতে ভুল নেই। লোকসংখ্যার সঙ্গে খাদ্যশস্যের উৎপাদনও বাড়বে, কিন্তু সে সম্পদ আজ মিলিয়নিয়ারকে বিলিয়নিয়ারে, বিলিয়নিয়ারকে ট্রিলিয়নিয়ার বানাবে। অনাহারী মানুষ অনাহারেই থাকবে। অপুষ্টিজনিত মানুষের সংখ্যা বাড়বে; তাদের অপুষ্টি দূর হবে না। পৃথিবীর ইতিহাস, বিশেষ করে, পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরের ইতিহাস আমাদের সে কথাই বলে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছাড়ার মাত্র চার বছর আগে বাংলার তেতালি্লশের দুর্ভিক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের স্কেচে এর কিছু চিত্র ধরা আছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি, ঈশ্বর-জীব ধনীকশ্রেণীর জন্য ওই তেতালি্লশের দুর্ভিক্ষ ছিল এক মহা সুযোগ। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'খাদ্য রাজনীতি' ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। আর আমরা বাসন্তীর 'গামছা পরা' ছবি দেখে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আনন্দে উল্লসিত হয়েছি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পুরো দায়দায়িত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির, সে বিষয়ে আজ আর কারো সন্দেহ নেই। সেই দুর্ভিক্ষের জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজি ইয়ং-হাসব্যান্ড ১৭৮৬ সালে 'ঞৎধহংধপঃরড়হ রহ ওহফরধ' গ্রন্থে সে দুর্ভিক্ষের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সব দোষ ইংরেজ লুটেরা শ্রেণীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। 'চরম খাদ্যাভাবের এক বিভীষিকাময় ইঙ্গিত সহসা দেখা দিল ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা-বিহারের সমস্ত ইংরেজি বণিক, তাহাদের সকল আমলা-গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া ধান-চাউল ক্রয় করিতে লাগিল। এই জঘন্যতম ব্যবসায়ে মুনাফা হইল এত শীঘ্র ও এরূপ বিপুল পরিমাণে যে মুর্শিদাবাদের নবাব-দরবারে নিযুক্ত জনৈক কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এই ব্যবসা করিয়া দুর্ভিক্ষ শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার পাউন্ড ইউরোপে পাঠাইয়াছিল।' সরকারি হিসাব মতে, ওই দুর্ভিক্ষে বাংলা-বিহারের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। অথচ সে বছরের রাজস্ব আদায় পূর্ববর্তী সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিগত সোয়া দুই বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের বলে দেয়, আজও যখন বাংলাদেশের কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, সেখানেই কিছু বড়লোকের জন্ম হয় এবং ধনীকশ্রেণীর হাতে আরো বেশি সম্পদ জমা হয়। ভবিষ্যতেও যে এ ধারা অব্যাহত থাকবে, তা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।
তিন. সতর্কবার্তাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁরা গম বা খাদ্যদ্রব্যের দামবৃদ্ধির কথা বলেছেন, খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণের কথা বলেননি। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের মানুষ যখন চার-পাঁচ কোটি ছিল, তখনই আমরা ভাবতাম লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হলে অবস্থা কী হবে? সেখানে আজ সেই একই ভূখণ্ডে ১৬ কোটি মানুষ জীবনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। এর পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক বিরাট ভূমিকা আছে। এ প্রসঙ্গে অনেক কিছুই শেখার আছে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলব, সভ্যতার শুরু থেকে রাজনীতি ও জ্ঞানচর্চা দুই পরস্পরবিরোধী রাস্তায় চলছে। অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সে রাস্তার অনেক হেরফের হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে যেমন ধর্মের বিরোধের বিষয়টি আজ আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না, তেমনি একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে প্লেটোর সঙ্গে ডেমোক্রিটাসের বিরোধটা কোথায়? বিজ্ঞানীরা যা-ই আবিষ্কার করুন না কেন, তা প্লেটোর শ্রেণীবিভক্ত 'রিপাবলিক' তা দখল করবেই। বিজ্ঞানীরা রাজনীতি নয়, প্রকৃতির অজানা সত্যগুলো আবিষ্কারে আগ্রহী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞানের শক্তিতে ১৯৪৮ সালে 'ইসরায়েল' রাষ্ট্র সৃষ্টি করে, তখন আইনস্টাইনকে এর প্রেসিডেন্ট হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আইনস্টাইন তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'রাজনীতি ক্ষণিকের, কিন্তু একটি সমীকরণ (বয়ঁধঃরড়হ) শাশ্বত।' কিন্তু আইনস্টাইনের আবিষ্কারই আমেরিকার হাতে ভয়ংকর এক শক্তি তুলে দেয়। এর সফল প্রয়োগে আমেরিকা আজ ভয়ংকর। হিটলার বোকা ছিলেন। তিনি আইনস্টাইনের গুরুত্ব বোঝেননি। তাঁকে যদি দুধে-ভাতে রাখা হতো তাহলে এটম বোমা জার্মানির হাতেই থাকত। আজ পারমাণবিক শক্তির বিগ বলা যায়, একচ্ছত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আইনস্টাইনের কোনো মূল্য নেই_আছে তাঁর আবিষ্কারের। বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীরাও আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। এটাই মারাত্মক। পুঁজিবাদ সব কিছুই পণ্যে পরিণত করে। বিজ্ঞান আজ মহা মূল্যবান পণ্য। আজ জীববিজ্ঞান যেখানে পেঁৗছেছে, তাতে প্রায় ১৮০০ কোটি মানুষের খাদ্যোৎপাদন করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সে খাদ্য অনাহারী ও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষগুলোর কাছে পেঁৗছবে, এর কোনো গ্যারান্টি বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। আছে রাজনীতির। তাই বিশ্বকে আজ দুই অংশে ভাগ করা যায়। রাজনৈতিক পৃথিবী ও বিজ্ঞানের পৃথিবী। ডেমোক্রিটাসের পৃথিবী আর প্লেটোর পৃথিবী। বিজ্ঞানী সৃজনশীল আর রাজনীতি ধ্বংসাত্মক। প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা দূর করে বিজ্ঞান একটি সুন্দর মুক্ত পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেখানে কোনো অন্ধত্ব থাকবে না। আর রাজনীতি ব্যক্তি বা শ্রেণীর উন্নয়নের স্বার্থে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হরণ করে, অন্ধত্ব জিইয়ে রাখতে চায়। বিজ্ঞান আজ সম্পূর্ণ রাজনীতির অধিকারে। বিজ্ঞানের আরো উন্নতি হবে। পৃথিবীটাকেই একটা স্বর্গে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে বিজ্ঞান। কিন্তু পুঁজিবাদের দখলে থাকা বিজ্ঞানের সে শক্তি নেই। সে শক্তি ফিরে পেতে হলে বিজ্ঞানকে অবশ্যই পুঁজিবাদের অমানবিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে। মৃত্যুর মাত্র ১৮ দিন আগে ১৯৫৫ সালে বিংশ শতকে দুই দিকপাল বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও দার্শনিক বিজ্ঞানী বার্ট্রান্ড রাসেল বেশ কয়েকজন নোবেল লরিয়েটসহ যুদ্ধবিরোধী বিবৃতি বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছিলেন। সেখানে তাঁরা আজকে ১০০ জন বিজ্ঞানীর মতো শান্তির সপক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের কথায় কোনো কাজ হয়নি। সারা বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসকরা সারা বছর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রিয় সরকারগুলোর পতনের জন্য মিলিয়নস অব ডলার খরচ করেছে। আজও সে ১০০ জন বিজ্ঞানী সতর্কবার্তা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে সংযত রাখবে, এর আশা করা যায় না। রাজনীতি তার ক্ষমতা ছাড়বে না। বিজ্ঞানও মুক্ত হবে না। ১০০ জন বিজ্ঞানীর সতর্কবার্তাটি কাজে লাগলে সারা বিশ্বের মানতাবাদী ও গণতন্ত্রকামী মানুষের ঐক্যবদ্ধভাবে বিজ্ঞানকে পুঁজিবাদের খপ্পর থেকে মুক্ত করার শপথগ্রহণ করতে হবে।
চার. আমরা সাধারণত বলে থাকি, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ শেষ হয়েছে। কথাটা সত্যি নয়। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ আগের চেয়ে ভয়ানকভাবে সারা বিশ্বকে গ্রাস করেছে। তাই ফ্রান্টজ ফ্যানন বলেন, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ যখন তাদের পতাকা ও সৈন্য সরিয়ে নেয়, তখন যে ক্ষত তারা সৃষ্টি করেছিল, তার জন্য উপনিবেশগুলোকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি এবং তারা এখন উপনিবেশগুলোর বিরুদ্ধে ক্রিমিনালের মতো আচরণ করেছে। ১০০ জন বিজ্ঞানীর সতর্কবার্তা আমাদের তাঁদের সম্পর্কেও সতর্কবার্তা দেয়। এডওয়ার্ড সাইদের ভাষায় যারা সাম্রাজ্যবাদের বেতনভুক 'বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞ'। নয়া সাম্রাজ্যবাদের কাছে তারা খুবই প্রিয়।
পার্থ, অস্ট্রেলিয়া, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১১
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.