বন্ধ করো ক্ষমতার ঢেঁকিখেলা by বেলাল বেগ

মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটা থাপ্পড় খেয়েছে। সবাই বলল, থাপ্পড়টি অপমানজনক হলেও বেশি জোরে লাগেনি। কারণ ওটা ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন; যেখানে রাজনীতির সম্পর্ক নেই বলে মনে করা হতো।
ক্ষমতা-মদের গ্লাস হাতে নিয়ে আওয়ামী লীগ সেখানে রাজনৈতিক জালের একটা খেপ দিয়ে দেখল কিছু ওঠে কি না। সবাই আশা করল অল্প কাদায় আছাড় খেয়ে ভবিষ্যতে সাবধান হয়ে আওয়ামী লীগ ঠিকমতো হাঁটবে। হবিগঞ্জে জাতীয় রাজনীতির অনুষ্ঠানে নিজেদের ঘরে বসেই জুতাপেটা হয়েছে আওয়ামী লীগ। জনগণ জানল আওয়ামী লীগের ক্ষমতার নেশাটা বেশি চড়ে গেছে। হবিগঞ্জের হিসাবে বেরিয়ে এল, দুটি কারণে আওয়ামী লীগ ইলেকট্রিক শক্ খেয়েছে। প্রথমত, প্রার্থী নির্বাচনে স্থানীয় জনগণের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ রাজনীতির অন্যতম খলনায়ক জেনারেল এরশাদের রহস্যজনক খেলা। মহাজোটে থেকেও তাঁর প্রার্থী আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। আ. লীগ, জাপার প্রাপ্ত ভোটের যোগফল থেকে দেখা যায়, এটিই আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের মূল কারণ।
হবিগঞ্জে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হারিকিরি না হত্যা? এখানে আওয়ামী লীগের হারার কোনোই যুক্তিসংগত কারণ নেই। আসনটি সিলেটবাসীর একান্ত শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন ফরিদ গাজীর। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জেনেশুনে আত্মহত্যা করবে, তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসল কথা আওয়ামী লীগকে হত্যার জন্য এটি হচ্ছে প্রথম আঘাত। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মুখে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে এবং উলঙ্গ বাসন্তীকে জাল পরিয়ে উপস্থাপন করে ওরা একইভাবে প্রথম আঘাত হেনেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করা, নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতাসীন করা, ইসলামের নামে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে মুসলিম লীগের স্থলাভিষিক্ত বিএনপি তৈরি, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দখল ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ যুগে ফেরত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা। পরিত্যক্ত হয়েছে জাতীয়করণ, মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে ঢুকেছে ধনতন্ত্র। সংবিধানের সংশোধন, ইসলামীকরণ, জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র-খেলা ইত্যাদি সুবোধ বালকের মতো মেনে নেওয়ায় বাংলাদেশের অদৃশ্য প্রভুরা ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে বিএনপির সঙ্গে ঢেঁকিখেলার (সী-স) সাথি করে নিয়েছিল। সব কিছু ভালো ভালোই চলছিল। ১/১১-র আগে যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তাতে বিএনপি ঢেঁকিখেলার নিয়ম ভেঙে হাসিনাকে তাঁর প্রাপ্য দান দিতে রাজি হচ্ছিল না। উভয় দলের মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়া এবং আবদুল জলিলের গোপন সমঝোতা প্রচেষ্টা নিষ্ফল হলো। ফলে এসেছিল এক-এগারোর না-ঘরকা না-ঘাটকা 'সামরিক গণতন্ত্র'।
গত নির্বাচনের ফলাফলকে আওয়ামী লীগ বিশেষ করে জননেত্রী শেখ হাসিনা একাত্তরের চেতনায় ফেরার রায় মনে করেছিলেন। মনে করাটা যথার্থই ছিল। তার বাস্তবায়নে বিনা প্রস্তুতিতে সঙ্গে সঙ্গে কাজে নেমে পড়াটা হয়ে গেল বিপজ্জনক পদক্ষেপ। প্রভুদের ইচ্ছা ছিল একাত্তরের চেতনা ইসলামী জঙ্গি দমন ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এখন তা একাত্তরের সংবিধান পুনরুদ্ধার ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের পর্যায়ে চলে যাওয়ায় প্রভুদের মেজাজ বিগড়ে গেছে বলে মনে করা যায়। এটির আঁচ পাওয়া যায় উপনির্বাচন-পরবর্তী বিএনপি নেতৃত্বের বিবৃতি-বক্তব্য থেকে। মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় সমকক্ষতা অর্জন করে বিএনপির কোনো কোনো নেতা মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করেছিল। উপনির্বাচনেও সমকক্ষতা অর্জন করেছে। মজার কথা, এখন তারা ওই দাবির পুনরাবৃত্তি করে না। নতুন কৌশল হিসেবে তারা উভয়ের প্রভু প্রবর্তিত পুরনো হাসিনা-খালেদা খেলায় ফিরে যেতে চায়। আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ নগর নির্মাণে শেখ হাসিনার ঘোষণাকে খালেদা টাকা চুরির ফন্দি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং এটা হতে দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই সেখানে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেছে। পার্লামেন্টে না গিয়ে বিএনপির ওভাবে ময়দানে নেমে পড়ার অর্থ জনগণ বোঝে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত কুখ্যাত সালাহউদ্দীন কাদের ছাড়া সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা স্পষ্টই বলে দিচ্ছে, ওরা আর কখনোই মুক্তিযুদ্ধকে গ্রহণ করবে না। ঠিক সময়ে এরশাদও যেন ভোল পাল্টাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতির কালো সময়ের রহস্যজনক কালো ঘোড়া। মুজিব, জিয়া, মঞ্জুর হত্যার বিচার না করে, ঘরে ঘরে দুর্নীতি পেঁৗছে, ঘন ঘন আমেরিকায় যাওয়া-আসা করা এই এরশাদ কিন্তু বাংলাদেশে সর্বোচ্চকাল রাজত্ব ভোগ করেছেন। রহস্যটা কি একমাত্র সিআইএ জানে। সিআইএ যেমন জানত বাংলাদেশে গণহত্যা হবে, শেখ মুজিব নিহত হবেন, শেখ মুজিবই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন; কিন্তু আমেরিকান স্বার্থে যথাসময়ে সবই গোপন রেখেছে।
এ কথা এখন ক্রমেই বেশি সোচ্চার হচ্ছে যে এযাবৎকালের উল্লেখযোগ্য সৎ মন্ত্রিসভা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার দুই বছরমেয়াদি সরকার যেন থিতিয়ে পড়ছে। কৃষি, শিক্ষা, ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল-ব্যবস্থাপনায় উজ্জ্বল অগ্রগতির আভা অন্য ক্ষেত্রগুলোতে আশানুরূপ ছড়াচ্ছে না। অন্যদিকে দুদক সংস্কার, উপজেলা চেয়ারম্যানদের পদানত রাখার নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হ্রাসে সরকারের সাফল্যহীনতা, দলীয় স্বেচ্ছাচারিতা ও সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতা সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করে চলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ভিশন টোয়েন্টি-টোয়েন্টিওয়ান-এর কথা যেন আর শোনাই যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কাপ-ভাঙা ছিটানো চায়ের মতো বরবাদ বিএনপি আবার গলার জোর বাড়িয়ে বড় বড় কথা বলতে আরম্ভ করেছে। স্পষ্টত হাসিনা-খালেদা খেলা শুরু হয়ে হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে প্রয়াত মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিল এ খেলার উপযুক্ত মাঠ তৈরি করতে পারেননি বলেই ওই রাহুটির আগমন ঘটেছিল বাংলাদেশে।
শোনা যাচ্ছে, সরকার ও দলকে কেঁচে গণ্ডূস করবেন শেখ হাসিনা নিজেই। তিনি প্রায় তিন যুগ ধরে আওয়ামী লীগের দণ্ডমুণ্ডের মালিক এবং দুইবারে ১০ বছর সরকারপ্রধান ছিলেন। অথচ দেখা যাচ্ছে বর্তমান সরকার লেজেগোবরে এবং নিজের দল লুটেরা বাহিনী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দল ও সরকার সুসংগঠনের দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করার তাঁর ঘোষণা জনমনে কতটুকু আশার উদ্দীপন ঘটায়, তা দেখার বিষয়। তবে লুঙ্গি পরা গ্রামের সাধারণ মানুষটির মতো করে বলা যায়, তাঁকে নতুন এমন কিছু করতে হবে, যা সম্পূর্ণ যুগান্তকারী। আমেরিকান বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বাকাশব্যাপী ছায়ার নিচে যুগান্তকারী কিছু করতে হলে তার জন্য একটি 'একাত্তর লাগে' এবং একাত্তরের মতোই একজন নন, ঘরে-বাইরে, হাটে-মাঠে, শহরে-বন্দরে সবাইকেই লাগে। নতুন রাজনৈতিক উপলব্ধি না হলে এবং রাজনৈতিক সার্জারির সাহস না থাকলে প্রধানমন্ত্রীকে হাসিনা-খালেদা খেলা খেলে বাকি তিন বছর কাটিয়ে দেওয়া উচিত; এতে জিয়া প্রবর্তিত আমেরিকান গণতন্ত্র যেমন টিকবে, তাঁরও সময়টা নির্বিঘ্ন কোলাহলে কাটবে। অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা বাকি জীবন একাত্তরের অপমান হজম করে চোখ বন্ধ করবেন। মহাকালের অথৈ জলে মুক্তিযুদ্ধের আলোড়ন মিলিয়ে গেলে বাঙালি আবার স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমানের কণ্ঠ শুনবে, 'মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ'।

লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক
belalbeg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.