নরসিংদীতে গুলি-রহস্য-* লোকমানের ঘনিষ্ঠ এস এম কাইয়ুমকে হত্যার চেষ্টা * এসপি বলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি by হায়দার আলী ও সুমন বর্মণ,

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এস এম কাইয়ুম সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত নরসিংদীর পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। গত রবিবার সারা দিন তিনি শহরের বাসাইলে লোকমানের বাসায় তাঁর শোকার্ত পরিবারের সঙ্গেই কাটান। রাত সোয়া ১১টার দিকে শহরের রাঙ্গামাইট্যার নিজ বাসায় ফেরার জন্য রিকশায় চড়ে বের হন। সঙ্গে ছিলেন নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সিহাব, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সোহেল, বাবলুসহ ৮-৯ জন বন্ধু। লোকমানের বাসভবন থেকে ১০০ গজ দূরে দস্তগীর মেডিক্যাল গেটে পেঁৗছার পর তাঁদের গতিরোধ করে অস্ত্রধারী সাত-আটজন।


আগে থেকে দাঁড় করিয়ে রাখা দুটি মাইক্রোবাসের একটিতে উঠতে বলে তাঁদের। কারণ জিজ্ঞাসা করলে এক সন্ত্রাসী
এসে কাইয়ুমের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপতে থাকে, কিন্তু গুলি বের না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
ওই সময় সামনে থাকা একজনকে জাপটে ধরেন কাইয়ুম, আরেকজন এসে কাইয়ুমকে গুলি করতে উদ্যত হলে লোকমানের বাড়ির এক নিরাপত্তাকর্মী লোহার রড দিয়ে অস্ত্রধারী ব্যক্তিটির হাতে আঘাত করেন। এতে অস্ত্রটির ম্যাগাজিন খুলে পড়ে যায়। ওই সময় অস্ত্রধারীরা কাইয়ুমের বন্ধুদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সিহাব ও বাবলুকে অস্ত্রের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এতে তাঁরা আহত হন। কাইয়ুম ও তাঁর বন্ধুদের চিৎকার শুনে লোকমানের বাড়িসহ আশপাশের লোকজন ছুটে এলে অবস্থা বেগতিক দেখে অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যায়। কাইয়ুমের এক বন্ধু এক অস্ত্রধারীর গায়ের গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে রাখায় সেটি খুলে যায়। তা ফেলে রেখেই অস্ত্রধারীরা সাহেপ্রতাবের দিকে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। কাইয়ুম ও তাঁর বন্ধুরা এই রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন।
এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পরপরই শত শত মানুষ মেয়র লোকমানের বাড়ির সামনে ভিড় করে। খবর পেয়ে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, নরসিংদী মডেল থানার ওসিসহ পুলিশের কর্মকর্তারা লোকমানের বাড়িতে ছুটে যান। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় ঈদুল আজহার আগের রাতে পুরো শহরে আতঙ্ক নেমে আসে। নিহতের পরিবারসহ নরসিংদীবাসীর মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। লোকমান হত্যার চার দিনের মাথায় তাঁর ঘনিষ্ঠ কাইয়ুমকে কেন হত্যার চেষ্টা, কারা এ হামলা চালিয়েছে সেসব জানতে চায় লোকমানের পরিবার ও নরসিংদীবাসী। ঘটনার পর থেকেই লোকমানের পরিবারে আরো আতঙ্ক ভর করেছে। সন্ধ্যার পর পরিবারের কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না।
এই ঘটনায় এস এম কাইয়ুম বাদী হয়ে নরসিংদী মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় লোকদের আসামি করে একটি মামলা করেন। এলাকাবাসীর ধারণা, ক্ষমতাধরদের নির্দেশ ছাড়া এই ঘটনা কখনোই ঘটতে পারে না। লোকমানের পর কাইয়ুমকে হত্যা করে তারা মুখ বন্ধ করে দিতে চায় নরসিংদীবাসীর। কিন্তু যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
ঘটনার পরপরই সংবাদ সম্মেলনে কাইয়ুম অভিযোগ করেন, 'আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে অস্ত্রধারীরা। কিন্তু বন্ধুদের সাহসীকতার কারণে প্রাণে বেঁচে যাই, অস্ত্রধারীদের আঘাতে দুজনের মাথা ফেটে যায়।' তিনি অভিযোগ করেন, মেয়রের বাড়ির সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ঘটনাটি তাকিয়ে দেখেছে, কিন্তু তাঁদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। কাইয়ুম বলেন, 'আমি বলছি, সন্ত্রাসীরা আমাকে হত্যার জন্য হামলা চালিয়েছিল, কিন্তু পুলিশ বলছে, তারা (হামলাকারীরা) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। তারা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনই হয়, তাহলে আমার ওপর হামলা চালাবে কেন?'
কাইয়ুম বলেন, 'আর তারা যদি আমাকে কোনো কারণে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই চায়, তাহলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে কথা বলবে, বাসায় গিয়ে কথা বলতে পারে কিংবা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু রাতের বেলায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করতে চায়, পিস্তলের বাঁট দিয়ে বন্ধুদের আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেয়। পরিহিত গেঞ্জি রেখে কেন পালিয়ে যাবে তারা? তারা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হয়, তাহলে কেন আমাকে হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নামবে? এসব ঘটনা কিসের আলামত বহন করে?'
লোকমানের পরিবারের সদস্যসহ এলাকাবাসী জানায়, সাদা পোশাকে র‌্যাব সদস্যরা সেই দিন (কাইয়ুমের ওপর হামলার দিন) বিকেল থেকে একটি মাইক্রোবাস ও একটি মিতৎসুবিশি লেন্সার গাড়িতে মেয়রের বাড়ির আশপাশে টহল দিচ্ছিলেন।
হামলার ঘটনা সম্পর্কে নরসিংদীর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হাওলাদার বলেন, 'প্রকৃতপক্ষে এটা সন্ত্রাসী কোনো ঘটনা নয়, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন নরসিংদীতে কাজ করছে। বাইরের লোকজন মনে করে, একজনকে থামাতে চেষ্টা করছিলেন তাঁরা, সেটা নিয়ে উনারা আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন, এই হলো মূল ঘটনা। পরবর্তী সময়ে এটার সমঝোতা হয়ে গেছে।'
তবে কাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, কোন বাহিনীর সদস্যরা এটা করেছেন_জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার বলেন, 'বিভিন্ন সংস্থা এখানে কাজ করছে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলে কেউ দায়ভার নিতে চায় না। এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দোষারোপ করলে আমাদের উদ্দেশ্য নষ্ট হবে, বেনিফিট পাবে তৃতীয় পক্ষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মূলত এটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা নয়।'
এস এম কাইয়ুম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন, লোকমান হোসেনকে হত্যা করা হলো, চার দিন না পেরুতেই আমাকে হত্যার চেষ্টা চেষ্টা করা হলো_এটা কিসের আলামত? আমরা তো আওয়ামী লীগ করি, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করি। আমাদের এতটুকু যদি জীবনের নিরাপত্তা না থাকে, যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হই, সেটা কিসের আলামত আমি বুঝতে পারছি না।'
কাইয়ুম বলেন, 'রাজনৈতিক কারণে, আমার জনপ্রিয়তার কারণে এবং মেয়র লোকমান হোসেনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ও হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমি সরব থাকায় কোনো মহল ক্ষুব্ধ হয়ে এটা করাতে পারে। লোকমান হত্যার মোটিভ উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে, কিন্তু প্রশাসন এখন পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো উল্লেখযোগ্য সফলতা পায়নি, কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।'
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল ভূঁইয়া ঘটনার বর্ণনায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি ও কাইয়ুম মেয়রের বাসায় কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে রিকশায় ফিরছিলাম। আমার সামনেই ছিল কাইয়ুমের রিকশা। হঠাৎ কাইয়ুমের চিৎকার শুনে আমি রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে এগিয়ে যাই। এ সময় আমাকে তিন ব্যক্তি ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। এদের মধ্যে এক ব্যক্তি আমার বুকে পাড়া দিয়ে পিস্তলের ট্রিগার চাপছিল। কিন্তু পিস্তল থেকে গুলি বের হচ্ছিল না। তা দেখে আমার এক বন্ধু তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরপর আমি উঠে দৌড়ে মেয়রের বাসায় ঢুকে পড়ি।'
নিহত মেয়রের ভাই ও মামলার বাদী কামরুজ্জামান বলেন, লোকমান হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি করা হয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে। এখনো তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এমনকি মামলার এজাহারভুক্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। এ কারণেই তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্র করছে। তাঁরা আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করার পরিকল্পনা করছে বলে আমাদের ধারণা।'
কামরুজ্জামান বলেন, 'আমাদের বাসার কাছে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকে হত্যার চেষ্টা, বাড়ির পাশে বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধার_সব মিলিয়ে আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। প্রভাবশালী আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্র করছে।'
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার রাতে নরসিংদী আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে মুখোশধারীদের গুলিতে নিহত হন পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান। লোকমানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদের ভাই সালাউদ্দিন আহমেদসহ ১৪ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। আসামিদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। লোকমানকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার জেলার পুলিশ সুপার আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়াকে প্রত্যাহার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বিজয় বসাক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) এনামুল কবীরকে বদলির আদেশ দেওয়া হয়।
অব্যাহতি পেলেও খোকন অন্য মামলায় জেলে

No comments

Powered by Blogger.