শেবাচিম হাসপাতাল : ঈদের ছুটিতে চিকিত্সক নার্সের অনুপস্থিতিতে ৩০ রোগীর মৃত্যু by জি. এম. বাবর আলী,

দের ছুটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পাশাপাশি অন্যান্য চিকিত্সক এবং নার্স না থাকায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপর্যস্ত চিকিত্সা সেবার মারাত্মক বিপর্যয় দেখা গেছে। এ সময় চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হন সহস্রাধিক রোগী। ঈদের ৩ দিনে এ হাসপাতালে ৩০ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রেফার্ড করা হয় ৪৩ জনকে। যার একজন পথিমধ্যে ইন্তেকাল করেন। চিকিত্সাবঞ্চিত ৩৫ রোগী স্বেচ্ছায় হাসপাতাল ত্যাগ করেন। চিকিত্সক-নার্সরা ছুটিতে থাকায় হাসপাতালের এ অবস্থায় রোগী ও স্বজনদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়।


ঈদের ছুটি শেষ হলেও গতকাল একই অবস্থা বিরাজ করে হাসপাতালজুড়ে। শনি ও রোববারের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র শেবাচিম হাসপাতালে কর্মরত অধিকাংশ চিকিত্সক ও নার্স ঈদের আগে থেকেই ছুটিতে থাকায় হাসপাতালটিতে চিকিত্সা সেবা ভেঙে পড়েছেন। ঈদের ছুটি শেষে গতকালও যোগদান করেননি চিকিত্সক-নার্সের বৃহত্ অংশ। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত এ বেহাল দশা অব্যাহত থাকবে বলে জানা যায়। এ অবস্থায় চিকিত্সা না পেয়ে এরই মধ্যে প্রায় অর্ধশত ক্ষুব্ধ রোগী নিজ উদ্যোগে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। ৩ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৩০ রোগীর।
হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, ঈদের আগের দিন ৬ নভেম্বর ১৩১ জন নতুন রোগী ভর্তি হন এ হাসপাতালে। ওই দিনই ১০ রোগীর মৃত্যু হয়। উন্নত চিকিত্সার নামে বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার্ড করা হয় ১১ রোগীকে। চিকিত্সাবঞ্চিত ১০ ক্ষুব্ধ রোগী হাসপাতাল ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। পর দিন ১৪৩ জন রোগী ভর্তি হন। মারা যান ৯ জন। ১৪ জনকে রেফার্ড করা হয় এবং স্বেচ্ছায় হাসপাতাল ত্যাগ করেন ১৩ জন। ঈদের পর দিন ১২০ জন রোগী ভর্তি হন। মারা যান ১০ জন। ১৮ জনকে রেফার্ড করার পাশাপাশি ১২ রোগী স্বেচ্ছায় হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এছাড়া ৭ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি থাকা একটি হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি সাত্তার মোল্লাকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। দুপুর ১২টায় হাসপাতাল ত্যাগের পর গৌরনদীর কাছাকাছি পৌঁছলে মৃত্যু হয় সাত্তার মোল্লার।
ঈদের দিন রাজাপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় আমির হোসেন এবং তার দুই ছেলে তানজিল ও প্রিন্স। তাদেরকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তির পর আমির হোসেনের মৃত্যু হয়। ২ ছেলের বিভিন্ন অঙ্গ ভেঙে গেলেও কোনো চিকিত্সা দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের মায়ের। ফলে হাসপাতালের কাউকে কোনো কিছু না বলে পরদিন মঙ্গলবার হাসপাতাল ছেড়ে যায় তারা। একইভাবে চিকিত্সা না পাওয়ার অভিযোগ নলছিটি উপজেলার তিমিরকাঠী গ্রামের তাসলিমা বেগমের। সার্জারি ইউনিটে ৬ তারিখে ভর্তি হওয়া তাসলিমা জানান, ওই দিন রাত ১২টায় এবং ঈদের দিন দুুপুরে একজন ইন্টার্নি ডাক্তার তাকে দেখেছেন। এছাড়া আর কোনো চিকিত্সক তাকে দেখতে আসেনি। সদর উপজেলার দুর্গাপুরের খলিল রাঢ়ী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঈদের দিন সকাল ১০টায় ভর্তি হন। ১২টায় ১ জন ইন্টার্নি ডাক্তার ওষুধ ও অন্যান্য চিকিত্সা সরঞ্জাম ক্রয় করে ওটিতে যেতে বলেন। ১২টা থেকে ওটির সামনে রক্তাক্ত খলিল রাঢ়ী বসে থাকলেও বিকেল ৪টায় শুধু মাত্র ড্রেসিং করে বিদায় দেয়া হয়। গতকাল পর্যন্ত তার ড্রেসিং পরিবর্তন বা অন্য কোনো চিকিত্সা দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ তার।
এখানকার স্বাস্থ্যসেবায় মূল ভূমিকা পালনকারী ১৫৯ ইন্টার্নি ডাক্তারের ৮৯ জনই রয়েছেন ছুটিতে। অনুপস্থিত ইন্টার্নি ডাক্তাররা স্ব স্ব বিভাগীয় প্রধানদের কাছ থেকে মৌখিকভাবে ছুটি নিলেও হাসপাতালের পরিচালক জানেন না কিছুই। ১৯ জন রেজিস্ট্রার চিকিত্সকের ১৬ জনই রয়েছেন অনুপস্থিত। গতকাল সার্জারি ইউনিটে ১ জন এবং মেডিসিন ইউনিটে ২ জন রেজিস্ট্রার দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী রেজিস্ট্রার রয়েছেন ৩০ জন। কিন্তু গতকাল সার্জারি, মেডিসিন ও গাইনি বিভাগে ৬ জন দায়িত্ব পালন করেন। বাকি ২৪ জন অনুপস্থিত বা ছুটিতে। ৩৫ আইএমও থাকলেও গতকাল দায়িত্ব পালন করেন মাত্র ৭ জন। এর মধ্যে গাইনি বিভাগে ৩ জন, শিশু বিভাগে ৩ জন ও সার্জারি বিভাগে ১ জন উপস্থিত ছিলেন। বাকি ২৮ জনই আসেননি। জরুরি বিভাগের ৬ চিকিত্সকের ৩ জনই ছিলেন গতকাল অনুপস্থিত। বহির্বিভাগে কর্মরত ২৩ চিকিত্সকের মধ্যে গতকাল মাত্র ১৪ জন উপস্থিত ছিলেন। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক গতকাল দায়িত্ব পালন করেন বলে দাবি শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের। তবে ৩/৪ দিন ধরে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের সেবা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন ইউনিটের একাধিক রোগী।
চিকিত্সকের পাশাপাশি নার্সের ভয়াবহ সঙ্কট বিরাজ করছে হাসপাতালে। এখানে ৩০৩ জন নার্স কর্মরত থাকলেও ছুটিতে আছেন ২০৭ জন। ৬ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত অধিকাংশ নার্স ৬ দিনের লম্বা ছুটিতে থাকায় চিকিত্সা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. আব্দুর রশিদের মতে, চিকিত্সক-নার্স সঙ্কট থাকলেও রোগীদের কোনো দুর্ভোগ হয়নি। তিনি বরিশালে অবস্থান করে সব কিছু তদারক করেছেন বলে দাবি করেন। পরিচালক বলেন, ছুটি নেয়া সব নার্স মুসলমান। ঈদের সঙ্গে তারা ঐচ্ছিক ছুটি নিয়েছে। তাদের অনুপস্থিতিতে বেশ কিছু সিনিয়র হিন্দু ধর্মের ছাত্রীকে (নার্স) দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়েছে। ইন্টার্নি ডাক্তারের অনুপস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, অনুপস্থিত চিকিত্সকরা তার কাছ থেকে ছুটি নেননি। তবে স্ব স্ব বিভাগীয় প্রধানদের কাছ থেকে তারা মৌখিকভাবে ছুটি নিয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন।

No comments

Powered by Blogger.