মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র কাটছে উইপোকায় by ওয়াকিল আহমেদ হিরন

রাজধানীর আবদুল গনি রোডে শিক্ষা ভবনের ঠিক বিপরীতে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র কাটছে উইপোকায়। প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোনো রেকর্ড রুম না থাকায় জরুরি এ কাগজপত্র রাখা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কক্ষে।সরেজমিন দেখা গেছে, সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে জায়গার অভাবে বিভিন্ন মামলার রায়সহ জরুরি নথিপত্র দীর্ঘদিন ধরে রেজিস্ট্রারের কক্ষে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এর ফলে এসব কাগজপত্রে উইপোকা বাসা বেঁধেছে। এরই মধ্যে অনেক জরুরি কাগজপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।


এদিকে ট্রাইব্যুনাল ভবনের ভেতরে অবৈধভাবে ক্যান্টিন, চায়ের দোকান ও ফটোস্ট্যাট মেশিন স্থাপন এবং রাতে গাড়ি পার্কিং করে প্রতিষ্ঠানের কয়েক অসাধু কর্মচারী টুপাইস কামিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে সরকারি অর্থের বিদ্যুৎ ও পানি অপচয় করা হচ্ছে। এসব অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিশ জারির পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বহাল তবিয়তে চলছে অবৈধ ব্যবসা।
ট্রাইব্যুনালের পেছনে একটি ক্যান্টিন রয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করছে আইন মন্ত্রণালয়ের দু'তিন কর্মচারী। তারা প্রতি মাসে ক্যান্টিন থেকে ভাড়া নিচ্ছে ৩ হাজার টাকা। ট্রাইব্যুনালে ঢুকতেই হাতের ডানে মসজিদের বারান্দায় বসানো হয়েছে ফটোস্ট্যাট মেশিন। নিবন্ধন পরিদফতরের মহাপরিদর্শক মুন্সী নজরুল ইসলামের গাড়ির ড্রাইভার মনির লোক বসিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ট্রাইব্যুনালের খোলা জায়গায় সন্ধ্যার পর কয়েকটি প্রাইভেটকার রাখা হচ্ছে। কে বা কারা এসব গাড়ি রাখছেন, কেউ বলতে পারেন না। জানা গেছে, নাইট গার্ডের সহায়তায় এসব গাড়ি রাখা হচ্ছে। বহিরাগত আওলাদ হোসেন ট্রাইব্যুনালের ভেতরে চা-বিস্কুটের দোকান দিয়েছেন। এই দোকানটি কে নিয়ন্ত্রণ করছে কেউ জানে না। তাছাড়া ট্রাইব্যুনালের পেছনে একতলা ভবনে কয়েকজন বহিরাগত মেস করে থাকছেন বছরের পর বছর। এভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের সম্পত্তি।
১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল। রাজধানীর আবদুল গনি রোডে আদালতটি অবস্থিত। একজন চেয়ারম্যান ও দু'জন সদস্যসহ মোট তিনজনের সমন্বয়ে গঠিত এ আদালত। চেয়ারম্যান ও
অন্য দুই সদস্যসহ মোট ১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু। এ আদালতে রয়েছেন চার কর্মকর্তা ও ১২ জন কর্মচারী। এখানে নেই বর্তমানে টাইপিস্ট, প্রসেস সার্ভার, ঝাড়ূদার ও মালি।
৭৫০ চাকরিজীবীর ভাগ্য এই ট্রাইব্যুনালের কাঁধে। অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের তুলনায় এখানে বিচারের গতি অনেক শ্লথ। ঢিলেঢালাভাবে নিষ্পত্তি হয় মামলা। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।
ট্রাইব্যুনালের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এখানে জনবলের অভাব। তিনি বলেন, স্টোর রুমের অভাবে রেজিস্ট্রারের কক্ষে ট্রাইব্যুনালের নথিপত্র, রায়ের কপিসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রাখা হয়েছে। সেখানে উইপোকায় কাটছে মূল্যবান নথিপত্র। জনবল চেয়ে অনেকবার মন্ত্রণালয়কে লেখা হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
সরকারি চাকরীজীবীদের চাকরি, পদোন্নতি, অপসারণ ও অব্যহতিসহ বিভিন্ন ধরনের মামলার বিচার হয় দেশের মোট সাতটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে। এসব ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য একমাত্র প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল এটি। পিয়ন থেকে সচিব পর্যন্ত সরকারি যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের চাকরি নিয়ে সংকটে পড়লে এই ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হন। একজন বিচারপ্রার্থী দুই থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারেন। এই ট্রাইব্যুনালের কোনো বিচারক অনুপস্থিত থাকলে বিচারকাজ বন্ধ থাকে।
একজন বিচারপতি এবং একজন প্রশাসনিক ক্যাডার ও একজন জুডিসিয়াল ক্যাডার সদস্যের সমন্বয়ে চলছে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোঃ আবদুল মতিন ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চেয়ারম্যান। অপর দুই সদস্য হলেন নরেশ চন্দ্র ঘোষ ও মোঃ আবদুল গফুর। সারাদেশে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালগুলোকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ঢাকায় তিনটিসহ বরিশাল, চট্টগ্রাম, বগুড়া, খুলনায় প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল রয়েছে। ঢাকার বাইরে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালগুলোর জেলা ও দায়রা জজরা এটি পরিচালনা করেন।
জানা যায়, বর্তমানে এই ট্রাইব্যুনালে ৭৫২টি মামলা বিচারাধীন। প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫টি মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে এখানে। একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে কমপক্ষে তিন-চার বছর সময় লাগে। ততদিনে বিচারপ্রার্থীর বেহাল দশা।

No comments

Powered by Blogger.