মালদ্বীপে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আজ : জলবায়ু পরিবর্তনে আঞ্চলিক ঐক্য চায় বাংলাদেশ by বশীর আহমেদ,

ক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন সার্কের ১৭তম শীর্ষ সম্মেলন আজ শুরু হচ্ছে মালদ্বীপের আদ্দু দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী হিথাধুর কনভেনশন সেন্টারে। দু’দিনের এই সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বিল্ডিং ব্রিজেস’ বা সেতুবন্ধন। সার্কের সদস্য আটটি দেশের ১৬০ কোটি মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা সম্মেলনে নিজেদের মধ্যে বন্ধন জোরদার করে আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করবেন। শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলাসহ বিভিন্ন বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পাবে।


বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস আমার দেশকে বলেছেন, বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে জোটগত অভিন্ন অবস্থান নেয়ার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থাত্ জলবায়ু পরিবর্তনে আঞ্চলিক ঐক্য চায় ঢাকা। এবারের শীর্ষ সম্মেলনে চারটা চুক্তি সই হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিসহ দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতারা এরই মধ্যে আদ্দু সিটিতে এসে পৌঁছেছেন। গতকাল বুধবার বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানান মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। গ্যান বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে এ অঞ্চলের শীর্ষ নেতারা গেছেন ভিলিনগিলি দ্বীপের সাংরিলা রিসোর্টে। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবেন তারা।
আজ বৃহষ্পতিবার স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটায় আদ্দু সিটির ইকুইটেরিয়াল কনভেনশন সেন্টারে শুরু হবে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন। এবারের শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ডারবানের জলবায়ু সম্মেলনে অভিন্ন অবস্থান নেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। সেই সঙ্গে অগ্রাধিকার পাবে দেশগুলোর মানুষের ও অবকাঠামোর যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়টি। বিশেষ করে সড়ক, রেল ও নৌপথের যোগাযোগ কীভাবে বাড়ানো যায় সেটি নিয়ে নেতারা আলোচনা করবেন। তাছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ও গুরুত্ব পাবে নেতাদের আলোচনায়। এছাড়া আলোচনা হবে পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়টি। আগামীকাল শুক্রবার শীর্ষ সম্মেলন শেষে দেয়া ঘোষণায় এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস গতকাল আমার দেশকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, খাদ্য নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়গুলো শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। বিশেষ করে এ মাসের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে একটি অভিন্ন অবস্থান নেবে সার্ক। এ বিষয়ে একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে গত সোম ও মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত সার্ক পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে। শীর্ষ সম্মেলন শেষে এ ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা একটি ঘোষণা দেবেন।’
এদিকে গত মঙ্গলবার বিকালে সার্ক পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক শেষে মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মোহাম্মদ নাসের সাংবাদিকদের বলেন, শীর্ষ সম্মেলনে ৪টি চুক্তি সই হবে। এগুলো হচ্ছে বীজ ভাণ্ডার গঠন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে দ্রুত সাড়া বিষয়ে দু’টি এবং পণ্যের মানের সমতা-বিষয়ক পারষ্পরিক সনদ ও মান নিশ্চিত বিষয়ে চুক্তি। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রক বিষয়ক চুক্তি হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে বলে তিনি জানান।
নিরাপত্তা বেষ্টনি : আদ্দু দ্বীপপুঞ্জের আকাশ, স্থল আর জলসীমাজুড়ে এক সমন্বিত নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তুলেছে প্রায় চার হাজার নিরাপত্তা কর্মী। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার পুরোভাগে আছে মালদ্বীপের ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (এমএনডিএফ)। গ্যান বিমানবন্দর থেকে হিথাধুর কনভেনশন পর্যন্ত লিংক রোডজুড়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। সেই সঙ্গে নিয়মিত টহল দিচ্ছে এমএনডিএফের সদস্যরা। নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলার অংশ হিসেবে গত ৭ নভেম্বর থেকে আকাশজুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে হেলিকপ্টার। আর সাগর ও তার তলদেশ চষে বেড়াচ্ছে কোস্ট গার্ড এবং এমএনডিএফ সদস্যরা।
সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে এমএনডিএফের দক্ষিণাঞ্চলের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহমেদ মুজতবা মোহাম্মেদ সাংবাদিকদের গত ৭ নভেম্বর বলেন, নিরাপত্তার বিষয়ে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে ভারত। ৩০টি নৌযান, ২টি হেলিকপ্টার ও ১টি ডোনিয়ার বিমান মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২টি হেলিকপ্টার দিয়েছে ভারত। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন সাড়ে চার হাজার নিরাপত্তা কর্মী।
এক স্বপ্ননগরী : ভারত মহাসাগরের বুকে এ যেন এক স্বপ্নপুরী। চোখ জুড়ানো নীল জলের মাঝে বুক চিতিয়ে জেগে আছে এ দ্বীপ। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে উত্সবের নগরীতে সেজেছে আদ্দু। ভিলিনগিলি, ফেদু, গ্যানসহ কয়েকটি রাস্তার দুপাশে উড়ছে আট দেশের পতাকা, রঙ লেগেছে রাস্তার দুপাশের বিভিন্ন ভবন ও বাড়িঘরে। আলোকসজ্জা, মোড়ে মোড়ে রাখা হয়েছে অতিথিদের সম্ভাষণ জানিয়ে তৈরি করা ইলেক্ট্রনিক প্ল্যাকার্ড। ঝকঝকে এক শহরে পরিণত এখন আদ্দু সিটি।
রীতিমত আলোড়িত এখানকার মানুষ। স্বেচ্ছাসেবক তাসমিনা বলেন, ‘সত্যি আমাদের জন্য এক দারুণ পাওয়া। দুই বছর আগেও কেউ ভাবিনি এখানে সার্ক সম্মেলন হবে। আদ্দুর নাম এখন ছড়িয়ে পড়বে। কেউ ভুলতে পারবে না আদ্দুর এ সৌন্দর্য।’
প্রস্তুতি সম্পর্কে আদ্দু সিটি কাউন্সিলের মেয়র আবদুল্লাহ সাদিক বলেন, সার্ক উপলক্ষে এ শহরে প্রায় পাঁচ হাজার অতিথি আসছেন। অতিথির আবাসন নিয়ে শুরুতে চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। শহরবাসীর অনেকেই অতিথির থাকার সুযোগ করে দিতে বাড়িঘর খালি করে অন্য দ্বীপে গেছেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, সরকারি কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম সবার থাকার জন্যই আলাদা-আলাদা দ্বীপে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যারা বক্তৃতা করবেন : দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতারা ছাড়াও পর্যবেক্ষকদের পক্ষ থেকে শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতা করবেন পর্যবেক্ষকদের প্রতিনিধি দলের নেতারা। চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝ্যাং জিজুন, জাপানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়ে নাকানো, দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিম জায়ে-শিন এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, ইরান ও মিয়ানমারের প্রতিনিধি বক্তব্য রাখবেন। তবে পর্যবেক্ষকদের প্রতিনিধিরা মঞ্চে গিয়ে নয়, তাদের আসন থেকে বক্তৃতা করবেন।
সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের কর্মসূচি : সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটায় শুরু হবে ইকুইটেরিয়াল কনভেনশন সেন্টারে। শীর্ষ ৮ নেতার বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে উদ্বোধনী অধিবেশন। রাতে আদ্দু সিটির হুলহু মিধুতে নৈশভোজে যোগ দেবেন নেতারা। কাল শুক্রবার সকালে ভিলা লালুতে অবকাশে মিলিত হবেন তারা। বিকালে আদ্দু ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হবে দু’দিনের শীর্ষ সম্মেলন।
১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নেপালে : সার্কের ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন হবে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ২০১৩ সালের প্রথমার্ধে। মালদ্বীপে সার্ক সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, এরই মধ্যে পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের বিষয়টা চূড়ান্ত হয়েছে।
ভারত বা পাকিস্তান কতটা আন্তরিক : তবে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন, তাদের অনেকেই বলেছেন, সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নিজেদের বিষয়কে যতটা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করতে চাইছে, তাতে ভারত বা পাকিস্তান কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমাদ বিবিসিকে বলেন, এর আগেও সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ঐকমত্য হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশের মতো দেশের তুলনায় ভারত অনেক বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছে। সেখানে ভারসাম্য আনার ক্ষেত্রে কোনো ঐকমত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস অবশ্য বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে গত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যা আলোচনা হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই এবার আরও কাছাকাছি অবস্থানে আসার চেষ্টা থাকবে বলে তারা আশা করছেন।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সার্ক সম্মেলনে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে কোনো সমাধান খুঁজছে না।
বরঞ্চ সমাধানের পথ খুঁজতে উন্নত দেশগুলোর ওপর যাতে একটা চাপ তৈরি করা যায়, সেজন্য বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে সবধরনের ফোরামকে ব্যবহার করে একটা বার্তা তুলে ধরতে চায়। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনেও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে অভিন্ন অবস্থান বেরিয়ে আসবে। সেটাই এখন বাংলাদেশের টার্গেট।

No comments

Powered by Blogger.