৩০ লাখ টাকা না পেয়ে নারী উদ্যোক্তাকে বৈদ্যুতিক শক

রিমান্ডের নামে থানা হাজতে এনে দাবি করেছিলেন ৩০ লাখ টাকা। আর তা দিতে অস্বীকার করায় বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় স্তন ও গোপনাঙ্গে। এতে অজ্ঞান হলেও দেয়া হয় শরীরের আরও কয়েক স্থানে গরম তারের ছ্যাঁকা। এসব অভিযোগ কক্সবাজার থানার এসআই মানস বড়ুয়ার বিরুদ্ধে। নিজের ওপর ঘটে যাওয়া দুঃসহ স্মৃতি উল্লেখ করতে গিয়ে কক্সবাজারের নারী উদ্যোক্তা জীবন আরা কেঁদে ফেলেন। কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে মঙ্গলবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসআই মানস বড়ুয়াকে পুলিশের কলঙ্ক উল্লেখ করে জীবন আরা বলেন, কক্সবাজার শহরতলির লিংক রোডে নিজস্ব পাকা ভবনের দ্বিতীয়তলায় অন্য দিনের মতো ২ মার্চ ব্যবসায়ী স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। মাঝ রাতে পুলিশ তাদের ডেকে বাড়িতে ঢোকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়ি তল্লাশির কথা বলে সবাইকে চোখ বেঁধে এক কোনায় বসিয়ে রাখে। এরপর এক পুলিশ সদস্য বলে ওঠেন, স্যার ইয়াবা পাওয়া গেছে। বাড়িতে ইয়াবা পাওয়ার কথা বলে রাতেই স্বামী আলী আহমদ সওদাগর ও তাকে থানায় এনে হাজতে রাখা হয়। তাদের আনার সময় পুলিশ তার বাসা থেকে ব্যাংক চেক, স্বর্ণালঙ্কার ও একটি প্রাইভেট কারও নিয়ে যায়। কিন্তু সিজার লিস্টে গাড়িটি জব্দের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। স্বামী-স্ত্রীকে তিন দিন থানা হাজতে রেখে মাদক মামলায় জীবন আরাকে এক নম্বর আসামি করে চালান দেয়া হয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, কারাগারে নেয়ার ১০ দিন পর রিমান্ডের নামে জীবন আরাকে ১৩ মার্চ থানায় এনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মানস বড়ুয়া প্রথমে তার স্বজনদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন। সেই টাকা দিতে না চাওয়ায় তার স্তন ও গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন শরীরের আরও কয়েক স্থানে গরম ছ্যাঁকার ফোসকা পড়েছে। এ অবস্থায় তাকে কারাগারে আনা হয়। বিনা চিকিৎসায় থাকায় বৈদ্যুতিক শকের ক্ষতস্থান থেকে পচা গন্ধ বের হলে কারা কর্তৃপক্ষ পরে সদর হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নথিতে বৈদ্যুতিক শকের কথা উল্লেখ করেছেন। এসব কথা উল্লেখ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য আদালতে জামিন চাওয়া হয়। আদালত নারী কর্মকর্তা দিয়ে চেকআপ করার পর তথ্যের সত্যতা পেয়ে ২৩ মার্চ জামিন দেন। ঘটনার খবর পেয়ে নারী কল্যাণ সমিতি তার পক্ষে কাজ করছে দেখে তার পরিবারের ওপর নেমে আসে পুলিশি হয়রানির খড়গ। কোথাও কোনো অভিযোগ কিংবা কিছু করা হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি বসায় পুলিশ। কক্সবাজার হাসপাতালে পুলিশ বারবার ডিস্টার্ব করছে দেখে জীবন আরাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রেফার করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চমেকে তার শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, যথাযথ চিকিৎসা না পেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন জীবন আরা। কেন এ পুলিশি হয়রানি- এমন প্রশ্ন করা হলে জীবন আরা বলেন, তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা। নিজ ভবনে তার একটি বিউটি পার্লার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে প্রতি তিন মাস অন্তর এক ব্যাচে ১৫ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন। পেয়েছেন সরকারি উদ্যোক্তা ঋণও। এ সুবাদে পরিচয় হয় ঢাকার পশ্চিম উত্তরার কামালপাড়ার সিরাজুল হকের স্ত্রী সীমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি কক্সবাজার এসে ঢাকায় যৌথ মূলধনে একটি পার্লার করার প্রস্তাব দেন। তার কথায় বিশ্বাস এনে রাজি হয়ে চুক্তির পর চলতি বছরের শুরুর দিকে ২৩ লাখ টাকাও দেন তিনি। এটিই কাল হয়েছে তার। সীমা ব্যবসা খোলার পরিবর্তে সে টাকায় ঢাকায় বাড়ি নির্মাণ করছেন। জানতে পেরে ঢাকায় গিয়ে তিনি নোটারির মাধ্যমে ২৩ লাখ টাকার পরিবর্তে তার ব্যবহৃত একটি কার বন্ধক দেন। কথা ছিল টাকা পরিশোধ করে গাড়ি নিয়ে যাবেন। কিন্তু তা না করে ১০ লাখ টাকায় কক্সবাজার সদর থানার ওসিসহ কয়েক অফিসারের সঙ্গে চুক্তি করে জীবন আরাকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করেন।
এ পরিকল্পনাস্বরূপ তাকে এবং তার স্বামীকে ইয়াবা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে সীমার কারটি তাকে ফেরত দিয়েছে পুলিশ। অথচ তার সঙ্গে করা ডিট ও গাড়ির সব কাগজপত্র এখনও তার হেফাজতে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। আদালতের মাধ্যমে জামিনে এলেও আটকের দিন বাড়ি থেকে নিয়ে আসা জিনিসের হদিসও দিচ্ছে না পুলিশ। সীমার দেয়া টাকা হজমের পর ব্যবসায়ী স্বামীর কাছ থেকে টাকা আদায়ে ওসিসহ অন্যরা পরিকল্পনা করে তার ওপর বর্বরতা চালান বলে উল্লেখ করেন জীবন আরা। কারাগার থেকে বের হয়ে নির্যাতনের সঠিক বিচার পেতে সহায়তার জন্য ২৬ মার্চ শহরের ঝাউতলা নারী কল্যাণ সমিতিতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে পুলিশ আবার তার ওপর হামলা চালায়। ওই সময় নুনিয়ারছড়ায় ইট দিয়ে পিটিয়ে তার দেবর জাহাঙ্গীরের পা ভেঙে দেন এসআই মানস। জীবন আরা আরও জানান, সদর থানা পুলিশের পরিকল্পনায় এসআই মানস বড়ুয়ার অমানবিক নির্যাতনের বিষয় উল্লেখ করে ২৬ মার্চ কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ পুলিশ সদর দফতরে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়েছে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকেও। এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী জীবন আরা। সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার নারী কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফাতেমা নার্গিস ডেজি, সাধারণ সম্পাদক হোসনে আরা ও অর্থ সম্পাদক রেহেনা আক্তার পাখিসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। নির্যাতনের ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন বলে জানান নারী নেতারা। অভিযোগের বিষয়ে জানতে এসআই মানস বড়ুয়ার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অভিযোগকারী আমার তদন্তাধীন মামলার আসামি। তাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতেই পারেন। এতে আমার কিছুই হবে না। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, একজন নারীকে আমার এক এসআই নির্যাতন করেছে বলে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তদন্ত করছেন। উভয়ের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.