তবুও কোরাম সংকট!

গত ৯ এপ্রিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের ‘পার্লামেন্টওয়াচ- দশম জাতীয় সংসদ : সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির কার্যালয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে, অন্যান্যের মধ্যে, দশম জাতীয় সংসদের সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ পর্যন্ত ৭টি অধিবেশনে কোরাম সংকটে মোট সময়ের অপচয়, এর অর্থমূল্য, আইন প্রণয়নে ব্যয়িত সময়ের তথ্য প্রদান করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অষ্টম ও নবম সংসদের তুলনায় দশম সংসদে কোরাম সংকট কিছুটা কমেছে। তবে এখানে যে প্রশ্নটি উঠতে পারে তা হল, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত না হয়ে প্রায় একদলীয়ভাবে গঠিত দশম সংসদে কোরাম সংকট হবে কেন? টিআইবি প্রণীত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোরাম সংকটের কারণে প্রশ্নোত্তর, আইন প্রণয়ন, জনগুরুত্বসম্পন্ন নোটিশের আলোচনা ইত্যাদি সংসদীয় কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি হয়। সার্বিকভাবে সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশনে মোট ৪৮ ঘণ্টা ২৬ মিনিট অপচয় হয় কোরাম সংকটের কারণে, যা ৭টি অধিবেশনের প্রকৃত মোট ব্যয়িত সময় ৩৯৪ ঘণ্টা ২১ মিনিটের ১২ শতাংশ। সাতটি অধিবেশনে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকটের কারণে অপচয় হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংসদের বাজেটের ভিত্তিতে সংসদ পরিচালনা ব্যয়ের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী সংসদ পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটে গড়ে ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৩৪ টাকা খরচ হয়। এ হিসাবে সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ পর্যন্ত ৭টি অধিবেশনে কোরাম সংকটে ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য ৪৭ কোটি ২০ লাখ ৩৩ হাজার ২০৪ টাকা এবং প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটের সময়ের অর্থমূল্য ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ১৫২ টাকা। আগেই বলেছি, অষ্টম ও নবম সংসদের তুলনায় দশম সংসদে কোরাম সংকট কিছুটা কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অষ্টম (২০০১-২০০৫), নবম (২০০৯-২০১৩) ও দশম (২০১৪-চলমান) সংসদে গড় কোরাম সংকট ছিল যথাক্রমে ৩৩ মিনিট, ৩০ মিনিট ও ২৯ মিনিট। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদের পরিস্থিতি এবং দশম সংসদের পরিস্থিতি এক নয়।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতায় ও বিরোধী দলে ছিল এবং এ দুটি দলের কোনো একটি বিরোধী দলে থাকাকালে বিভিন্ন ইস্যুতে হরহামেশা কার্যদিবসে সংসদে অনুপস্থিত থেকেছে এবং একনাগাড়ে দীর্ঘদিন সংসদ অধিবেশন বর্জনও করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোতে বিরোধী দলকে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব প্রদানে ক্ষমতাসীন দলের অনীহা, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে সরকারি দলের প্রচারণায় ব্যবহার, মৌলিক মানবাধিকার লংঘন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ইত্যাদি অভিযোগ এনে সপ্তম সংসদের মোট ৩৮২ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ বর্জন করে ১৬৩ কার্যদিবস। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অষ্টম জাতীয় সংসদের (২০০১-০৬) মোট ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২২৩ কার্যদিবস বা প্রায় ৬০ শতাংশ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ১৩০ দিন হরতাল পালন করে। নবম জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ৪১৮ কার্যদিবসের মধ্যে ৩৪২ কার্যদিবস সংসদ বর্জন করে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এ ধরনের কার্যকলাপের ফলে শুধু কোরাম সংকটই দেখা দেয়নি, বরং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় গণপ্রত্যাশার কেন্দ্রস্থল জাতীয় সংসদ প্রায় অকার্যকর থেকে যায়। আর দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয় প্রায় একদলীয়ভাবে। নবম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের কিছুদিন পর সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। এ ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে সরকারকে দাবি মানাতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট এবং জোটের বাইরে ৯টি সমমনা দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের ১৫৩টি আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী কয়েকটি দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্যপদ লাভ করেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। অন্য যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, দশম সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি একইসঙ্গে সরকারের অংশীদার। তাই সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত সরকারে জাতীয় সংসদে কোরাম সংকট হওয়ার কথা নয়। স্বভাবতই এ সংসদে কোরাম সংকট প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। জাতীয় সংসদে কোরাম সংকটের একটি বড় কারণ হল সদস্যদের একাদিক্রমে ৮৯ বৈঠক-দিবসে বিনা অনুমতিতে সংসদে অনুপস্থিত থাকতে পারা। সংবিধানের ৬৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে যদি সংসদের অনুমতি না নিয়ে তিনি একাদিক্রমে ৯০ বৈঠক-দিবসে অনুপস্থিত থাকেন। এই ৮৯ বৈঠক-দিবসের ব্যাপ্তি অনেক সময় একাধিক অধিবেশন পর্যন্ত ঘটে। ভারতে এ সময়কাল একাদিক্রমে ৬০ বৈঠক-দিবস এবং পাকিস্তানে একাদিক্রমে ৪০ বৈঠক-দিবস। বাংলাদেশে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু থাকায় এখানে সংসদ সদস্যদের বিনা অনুমতিতে সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকার সময়কাল একাদিক্রমে ৩০ দিনের বেশি হওয়া উচিত নয়। ২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী এবং দলটির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সংসদ সদস্যদের বিনা অনুমতিতে সংসদে অনুপস্থিতির সময়কাল একাদিক্রমে ১০ কার্যদিবস করার প্রস্তাব করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, আইন প্রণয়ন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ সম্পাদন সংসদ সদস্যের মূল দায়িত্ব হলেও সংসদ অধিবেশন বা সংসদ চত্বরে অন্য কোনো কাজে অংশগ্রহণের চেয়ে অনেকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়ন ও অনুন্নয়মূলক কাজের খবরদারিতে বেশি আগ্রহী। তাছাড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আইন প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর উপজেলা পরিষদ পরিচালনায় সংসদ সদস্যদের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রণীত উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮-এ স্থানীয় সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখার বিধান করা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ আইনটি বাতিল করে উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ ২০০৮ চালু করেছিল। এতে উপজেলা পরিষদে সংসদ সদস্যকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের বিধান বাতিল করা হয়। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তিত উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ ২০০৮ বাতিল করে কিছু সংশোধনীসহ ১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইনটি পুনঃপ্রচলন করে। এতে সংসদ সদস্যকে পরিষদে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ প্রদানের বিধান পুনর্বহাল এবং তার সুপারিশ মানা বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে পরিষদ কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। পরিষদের উন্নয়ন ও অনুন্নয়নমূলক যে কোনো কাজে সংসদ সদস্যের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে পরিগণিত হয়। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকার পদ্ধতির সর্বোচ্চ স্তর জেলা পরিষদে উপদেষ্টা পদে নিয়োজিত থেকে জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করছেন। এসব কারণে সংসদ সদস্যরা সময়মতো এবং নিয়মিত সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণে আগ্রহী হন না, যা শেষ পর্যন্ত কোরাম সংকটের সৃষ্টি করে। সবশেষে যা বলতে চাই তা হল, বর্তমান সংসদে কোরাম সংকট কিছুটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। অধিবেশনে যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে আইন প্রণয়নসহ সংসদের অন্যান্য কাজে অংশগ্রহণে সংসদ সদস্যদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে, এটিই তাদের মূল দায়িত্ব। তাছাড়া সংসদে কোরাম সংকট এড়াতে এবং সংসদকে পুরোপুরি কার্যকর করতে সংসদ সদস্যদের ওপর কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.