প্রধানমন্ত্রী ভুটানে বাণিজ্য প্রসারে চুক্তি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে যোগাযোগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণে কয়েকটি চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের। সহযোগিতার নতুন পথ খুঁজতে মঙ্গলবার থিম্পুর রয়াল ব্যাংকুয়েট হলে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তেসারিং তোবগের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শীর্ষ বৈঠকের পর দ্বৈত কর প্রত্যাহার, বাংলাদেশের নৌপথ ভুটানকে ব্যবহার করতে দেয়া, কৃষি, সংস্কৃতি ও পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনটি চুক্তি ও দুটি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করে প্রতিবেশী দু’দেশ। বাংলাদেশের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে সই করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ডিজি মনোয়ার হোসেন। অন্যদিকে ভুটান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা চুক্তি ও স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এর আগে তিন দিনের সরকারি সফরে মঙ্গলবার সকালে ভুটান যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্যারো বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান দেশটির প্রধানমন্ত্রী তোবগে এবং থিম্পুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জিষ্ণু রায় চৌধুরী।
এ সময় তাকে খাদার (স্কার্ফ) উপহার দেয়া হয়। ভুটান সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেন। বিমানবন্দর থেকে বর্ণাঢ্য মোটর শোভাযাত্রাসহ প্রধানমন্ত্রীকে লা মেরিডিয়ান থিম্পু হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ভুটান সফরকালে এখানেই অবস্থান করবেন। সেখানে ভুটানের রয়েল প্রিভি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান লিয়েনপো চেনকাব দর্জি তাকে অভ্যর্থনা জানান। প্যারো বিমানবন্দর থেকে ভুটানের রাজধানীর ৭০ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ এবং শিশু-কিশোর দুই দেশের পতাকা হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান। সম্মেলন উপলক্ষে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে স্বাগত জানিয়ে রাজধানী শহরকে বাংলাদেশ ও ভুটানের পতাকা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভুটানের রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। পরে দুই প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। থিম্পুর গ্যালয়ং শংখানে শীর্ষ বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনার মধ্যে যেগুলো জোরালোভাবে উঠে এসেছে সেগুলো হল দু’দেশের কানেকটিভি ধরে ব্যবসা ও বাণিজ্য বৃদ্ধি। দু’দেশের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, এই এমওইউ সইয়ের ফলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা হল। বিশেষ করে দ্বৈত করের ক্ষেত্রে। এতে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। একাত্তরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদাতা দেশ হিসেবে ভুটানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
সেই সম্পর্ককে ধরে রাখার জন্য ভুটানের রাজা বাংলাদেশকে একখণ্ড জমি দিচ্ছেন যেখানে বাংলাদেশের দূতাবাস গড়ে তোলা হবে। সে বিষয়ে আজ একটি সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে শহীদুল হক জানান। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী ভুটানের সমর্থন চেয়েছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জলবিদ্যুতে সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে শেখ হাসিনার। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, হাইড্রো বিদ্যুতের যে সম্ভাবনা আছে, সেটা একটা গেম চেঞ্জার হতে পারে এ অঞ্চলে। ভুটানে তিন দেশের সহযোগিতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং এটা রিজিওনালি ট্রান্সমিট করবে। তিনি জানান, ভুটানের সরকার একটা ‘হেলথ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করেছে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য। এই তহবিলে সহযোগিতা চেয়েছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশি ডাক্তারদের থিম্পুতে সরকারিভাবে চাকরির বিষয়েও দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় উঠে আসে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জানান, বিদেশি ডাক্তাররা এখানে চাকরি করলে মাসে তিন হাজার ডলার পর্যন্ত বেতন দেয়া হবে। বাংলাদেশি ডাক্তাররা উৎসাহী হলে তাদের চাকরির সম্ভাবনা এখানে আছে। রংপুর মেডিকেল কলেজে ভুটানি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ আসন বরাদ্দের কথাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জানান। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল নিয়ে বিবিআইএন নামে যে উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের কাজ চলছে তা নিয়েও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। শেখ হাসিনা বলেছেন, বিবিআইএন এ এলাকার কানেকটিভিটির প্রধান করিডোর। এর বাস্তবায়নে ভুটানকে তিনি তাগিদ দেন। শহীদুল হক বলেন, কুয়াকাটা ও কক্সবাজারের সঙ্গে ভুটানকে নিয়ে একটি ‘টুরিজম করিডোর’ কীভাবে তৈরি করা যায় তা খুঁজে দেখতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাবে বলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ভারতের মধ্য দিয়ে ফাইবার অপটিকসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা প্রস্তাব ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা- এটা সবাই মিলে যৌথভাবে করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল মিলে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। তোগবে বলেন, বিমসটেকের একটা বড় সম্ভাবনা আছে। তারা ভাবে যে, এই বিমসটেককে কাঠামো করেই এ এলাকার উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা দানা বাঁধতে পারে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দেন ভুটানকে। দু’দেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালিক, অটিজম এবং নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বিষয়ক সরকারের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে দ্রুক এয়ারের ভিভিআইপি ফ্লাইটটি মঙ্গলবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। বিমানবন্দরে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানান।
শেখ হাসিনাকে ভুটানের রাজার বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা : বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার ন্যামগিল ওয়াংচুক এবং রানী জেটসুন পেম রাজপ্রাসাদ তাশিহোডজংয়ে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দিয়েছেন। বিকালে প্রধানমন্ত্রী রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকে পৌঁছলে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়। পরে তাকে ভুটানের একজন মন্ত্রী ও সিনিয়র কর্মকর্তারা প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে যান। এখানে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ভুটানের রাজা ও রানীর সঙ্গে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হন। পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক ও প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী ভুটানের রাজা ও রানীর সঙ্গে কিছু সময় একান্তে কাটান। শহীদুল হক বলেন, রাজা প্রথমবারের মতো তার ১৪ মাস বয়সী শিশুকে প্রধানমন্ত্রীকে দেখান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার পুত্রের ‘দাদি’ বলে উল্লেখ করেন।
আজ অটিজম সম্মেলন শুরু : ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে আজ থেকে শুরু হওয়া অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে ভুটানের রাজা ও রানীর দেয়া ভোজে যোগ দেবেন। বিকালে শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে অটিজম ও অন্যান্য নিউরোডেভেলপমেন্ট সমস্যার যথাযথ সমাধানে সক্ষমতা অর্জন শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন। শেখ হাসিনা হেজোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক উন্মোচন করবেন।

No comments

Powered by Blogger.